ওয়াদা পালনে হযরত মু’আবিয়া (রাযি.)-এর বিরল একটি ঘটনা
হযরত মুআবিয়া (রাযি.) ছিলেন শামের গভর্নর। যদ্দরুন তৎকালীন রোমের সাথে তার যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। রোম সাম্রাজ্যকে তৎকালীন সুপার পাওয়ার মনে করা হত। অসাধারণ সামরিক শক্তির অধিকারী ছিল। একবার হযরত মু’আবিয়া (রাযি.)-এর সাথে তাদের যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।
একটি মেয়াদ স্থির করা হয় যে, এ মেয়াদ পর্যন্ত আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে-আগে হযরত মু’আবিয়া (রাযি.)- এর মাথায় একটি কৌশল জাগল। তিনি চিন্তা করলেন, মেয়াদের ভেতর যুদ্ধ করা তো জায়েয নয়, কিন্তু প্রস্তুতি গ্রহণে দোষ কী? কাজেই আমার সৈনিকদের সীমান্ত এলাকায় জড়ো করে রাখি, যাতে মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র আক্রমণ শুরু করে দেওয়া যায়। তাতে জয়লাভ খুব সহজ হবে। কেননা, শত্রুরা তো ভাববে মুসলিম সৈন্যরা মেয়াদের ভেতর যেহেতু হামলা করবে না, তাই তাদের কোনও রকম রণপ্রস্তুতিও থাকবে না। তারা প্রস্তুত হবে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর তখন প্রস্তুতি নিয়ে এই এলাকায় পৌঁছাতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।
এই ভাবনায় রোমান সৈন্যরা নিশ্চিন্ত বসে থাকবে। আক্রমণ ঠেকানোর কোন প্রস্তুতি তাদের থাকবে না। ফলে মুসলিম বাহিনী বিনা বাধায় তাদের দেশ দখল করতে পারবে। কৌশলটি হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর খুব পছন্দ হল। তিনি তাঁর সৈন্যদেরকে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে ছাউনি ফেলতে বললেন। সেমতে বিপুল সৈন্য সেখানে সমবেত হল।
অতঃপর যেই না মেয়াদ শেষ হল অমনি তিনি তাদেরকে সামনে অগ্রসর হওয়ার হুকুম দিলেন। বাহিনী এগিয়ে চলল এবং এলাকার পর এলাকা তাদের দখলে চলে আসল। কেননা, শত্রুসৈন্য এই আক্রমণের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তারা বিনা বাধায় একটির পর একটি নগর ও একের পর এক জনপদ মুসলিমদের হাতে ছেড়ে দিতে থাকল। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের বহু দূর পর্যন্ত তারা পৌছে গেল। বিজয়ের নেশায় তখন তারা দুর্নিবার। সামনে চলছে তো চলছেই। এই উম্মাতাল অবস্থায় অকম্মাৎ এক ঘোড়সওয়ারের প্রতি নজর পড়ল। পেছন দিক থেকে দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে আসছে। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) তার অপেক্ষায় থেমে গেলেন। হযরত আমীরুল-মু’মিনীনের দূত কোন নতুন ফরমান নিয়ে আসছে। ঘোড়সওয়ার যখন আরও কাছে এসে পৌঁছাল তখন তার আওয়াজ শোনা গেল- الله أكبرُ اللهُ أَكْبَرُ قِفُوا عِبَادَ اللَّهِ قِفُوا عِبَادَ اللهِ ‘আল্লাহু আকবার-আল্লাহু আকবার। আল্লাহর বান্দাগণ তোমরা থাম। আল্লাহর বান্দাগণ ! তোমরা থাম।’
যখন সে আরও কাছে আসল হযরত মু’আবিয়া (রাযি.) তাকিয়ে দেখেন এ যে হযরত ‘আমর ইবনে আবাসা (রাযি.)। জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী ? তিনি বললেন- وَفَاء لَا غَدْرٌ وَفَاء لَا غَدْرُ চুক্তিরক্ষাই মুমিনের কাজ, বিশ্বাসঘাতকতা নয় ; চুক্তিরক্ষাই মুমিনের কাজ বিশ্বাসঘাতকতা নয় । হযরত মু’আবিয়া (রাযি.) বললেন, আমি তো চুক্তি ভংগ করিনি । আমি যুদ্ধবিরতির মেয়াদের ভেতর আক্রমণ করিনি ; বরং মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই করেছি।
হযরত ‘আমর ইবনে ‘আবাসা (রাযি.) বললেন, যদিও হামলার আগে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আপনি আপনার সীমান্তে সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছিলেন তার আগেই। এবং কিছু সংখ্যক সৈন্য তখনই সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। এটা স্পষ্টতই চুক্তির লংঘন ছিল। আমি নিজ কানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- مَنْ كَانَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ قَوْمٍ عَهْدٌ فَلَا يَحُلَنَهُ وَلَا يَشْئَنَّهُ إِلَى أَنْ يَمْضِيَ أَجَلٌ لَّهُ أَوْ يَنْبِلَ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ
কোন সম্প্রদায়ের সাথে যার কোন চুক্তি হয়েছে, সে তা খুলবেও না এবং বাঁধবেও না (অর্থাৎ যথাযথভাবে তা রক্ষা করবে)-যাবত না তার মেয়াদ শেষ হয় বা খোলাখুলি ঘোষণা করে দেয় যে, আমরা চুক্তি বাতিল করলাম।(তিরমিযী, হাদীছ নং ১৫০৬)
সুতরাং মেয়াদ শেষ না হতেই কিংবা চুক্তি বাতিলের ঘোষণা না করেই সীমান্তে সেনাসমাবেশ ঘটানো এবং কিছু সংখ্যক সৈন্যের সীমান্ত অতিক্রম করা কিছুতেই বৈধ ছিল না। এ হাদীছের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ নাজায়েয কাজ হয়েছে।
হযরত মু’আবিয়া (রাযি.) আর একটি কথাও বাড়ালেন না। তখনই সৈন্যদেরকে ফিরে আসার হুকুম দিলেন এবং বিজিত সবটা এলাকা বিজিতদের হাতে প্রত্যার্পণ করলেন।
একবার ভেবে দেখুন, বিজয় নেশায় বুঁদ একটি বাহিনী, যারা নগরের পর নগর দখল করে চলেছে, বিনা বাধায় শত্রু দেশের বিস্তৃত এলাকা করতলগত করে ফেলেছে, তাদের পক্ষে নিঃশর্ত ভাবে সেইসব এলাকা প্রত্যার্পন করে নিজ দেশের সীমানার মধ্যে ফিরে যাওয়া কতটা কঠিন কাজ হবে। বিশ্ব ইতিহাসে কেউ কোনও জাতির ভেতর এমন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে না যে, কেবল ওয়াদা ভংগের আশংকায় নিজেদের জয় করে নেওয়া এলাকা শত্রুর হাতে প্রত্যার্পন করেছে।
এটা দীনের সেবকগণেরই ঐতিহ্য। এখানে তো ভূমি দখল ও রাজ্য বিস্তার লক্ষবস্তু নয়। লক্ষবস্তু কেবল আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভ। সে কারণেই যখন আল্লাহ তা’আলার বিধান জানা গেল যে, ওয়াদা ভংগ জায়েয নয় এবং এক্ষেত্রে তাই হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, তাই এত বড় ত্যাগ স্বীকার করে তারা নিজ দেশে ফিরে গেলেন । এটাই হল ওয়াদা রক্ষা। যখন মুখ থেকে একটা কথা বের হয়ে গেছে, তখন যে কোনও মূল্যে তার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে ।
বই : মন্দচরিত্র ও তার সংশোধন
লিখক : জাস্টিজ আল্লামা তাকী উসমানী