কুরআনে কারীমের তরজমা-তাফসীর পাঠ ও তাদাব্বুর প্রসঙ্গ 3
মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ
আজকের আলোচনার শিরোনাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ- কুরআনে কারীমের তরজমা ও তাফসীর পাঠ। কিন্তু এ বিষয়ে আমার নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা কঠিন। আমি চেষ্টা করব আমাদের পূর্বসূরি মনীষী ব্যক্তিবর্গ ও বর্তমান সময়ের বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম যে আলোচনা করেছেন তা একটু গুছিয়ে উপস্থাপন করতে।
কুরআনে কারীমের তরজমা-তাফসীর পাঠ প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টা ভূমিকা হিসেবে বোঝা দরকার তা হচ্ছে, আমরা কুরআনে কারীমের তরজমা-তাফসীর পাঠের দিকে কখন যাব? অন্য ভাষায় বললে, কুরআন-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় এই বিষয়টার গুরুত্ব কতটুকু?
প্রথমেই আমাদেরকে কুরআন সংক্রান্ত আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যগুলোর পর্যায়ক্রম উপলব্ধি করতে হবে এবং সে অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এটা হচ্ছে প্রথম মূলনীতি।
শরীয়তে কাম্য বিষয়ের মধ্যে পর্যায়ক্রম থাকে। সেই পর্যায়ক্রম সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা দরকার। যেন প্রত্যেক বিষয়কে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয়া যায়। এজন্য আজকের দরসের প্রথম মূলনীতি আমরা বলব, কুরআন সংক্রান্ত আমাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য, তার মধ্যে পর্যায়ক্রম উপলব্ধি করা এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
এই মূলনীতির আলোকে একজন মুসলিমের জন্য গুরুত্বের বিচারে যে বিষয়গুলো আগে আসবে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, কুরআনে কারীমের সহীহ তেলাওয়াত শিক্ষা করা। এমনিভাবে কুরআনে কারীমের মাধ্যমে যে আকাইদ ও আহকাম অর্থাৎ যে বিশ্বাস ও বিধান আমাদের কাছে এসেছে সেই আকীদা ও আহকামকে সহজ ও সঠিকভাবে কুরআন-সুন্নাহর বিজ্ঞ আলিমদের কাছ থেকে জেনে সে অনুযায়ী আমল করতে থাকা। এই দুইটা বিষয় সরাসরি কুরআনের তরজমা-তাফসীর পাঠের আগে আসবে। আবারো বলছি, সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআনে কারীমের তেলাওয়াত শিক্ষা করা এবং কুরআনে করীমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যে আকীদা-আহকাম আমাদেরকে দান করেছেন তা সহজ-সরলভাবে ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে জেনে সে অনুযায়ী আমল করতে আরম্ভ করা।
এই পর্যায়ক্রম না বুঝলে শরীয়তের বিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং তা অবহেলিত হয়ে থাকবে। এরকমটা হওয়া উচিত না। যে বিষয়ের গুরুত্ব বেশি, সে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যে বিষয়টা আগে অর্জন করার তা আগে অর্জন করতে হবে। এটা শরীয়তের একটা স্বীকৃত মূলনীতি। সালাফের বাণীতে এই মূলনীতি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ইমাম ইবনুল জাওযী রাহ.-এর একটি কিতাব আছে ‘তালবীসে ইবলীস’। সেই কিতাবে তিনি বলেন-
أما العِلْمُ الّذِي يجب على الإنسانِ عَيْناً كَعِلْمِ ما أمَرَ اللهُ بِه و ما نَهى اللهُ عَنْه فهو مقدّم على حفظ ما لا يجب من القرآنِ فَإِنّ طلب العلم الأوّل واجب، و طلب الثاني مستحبّ و الواجب مقدّم على المستحب.
‘যে ইলম প্রত্যেক মানুষের উপর ‘ফরযে আইন’ যেমন আল্লাহ তাআলা যে বিষয়ের আদেশ করেছেন এবং যে বিষয়ে নিষেধ করেছেন তা জানা কুরআনের যে অংশ হিফয করা ওয়াজিব নয় তার চেয়ে অগ্রগণ্য। কেননা প্রথম প্রকারের ইলম অন্বেষণ ওয়াজিব আর দ্বিতীয়টি মুস্তাহাব। আর ওয়াজিব তো মুস্তাহাবের চেয়ে অগ্রগণ্য।’
কুরআনে কারীম হিফয করা, কুরআনের অর্থ-মর্ম বোঝা ভালো ও কাম্য বিষয়, কিন্তু এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কুরআনে কারীমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যে আদেশ-নিষেধ করেছেন তা জেনে সে অনুযায়ী আমল শুরু করে দেওয়া।
আরেকটি সহজ উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের শুরুতে উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব হাফিযাহুল্লাহ তাআলা ওয়া রাআহু তাঁর সারগর্ভ ভূমিকায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, কুরআনে কারীমের ব্যাপারে আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে ঈমান। এর পর কুরআনে কারীমের আদব ও সম্মান রক্ষা করা। এটাও একটি ফরজ বিষয়। এর পরে কুরআন মাজীদের তেলাওয়াত। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :
‘কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত
এটা পবিত্র কুরআনের একটি স্বতন্ত্র হক এবং আল্লাহ তাআলার অতি বড় এক ইবাদত। এর বহু আদব রয়েছে। প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হল, সে যথাযথ আদব রক্ষা করে প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করবে।
‘তাজবীদের সাথে পড়া, মাখরাজ ও সিফাতের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং পাঠরীতির অনুসরণ করা তেলাওয়াতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজকাল এ ব্যাপারে চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কুরআন মাজীদের অর্থ ও তাফসীর বুঝার জন্য সময় বের করা হয়, কিন্তু তেলাওয়াত সহীহ করার জন্য মশক করা কিংবা মশকের জন্য সময় বের করার প্রয়োজন বোধ করা হয় না। যেন মানুষের কাছে কুরআনের তেলাওয়াত সহীহ করা অপেক্ষা অর্থ বোঝাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ ধারণা সম্পূর্ণ গলত। কুরআনের প্রতি ঈমান আনার পর সর্বপ্রথম কাজই হল, অবিলম্বে কুরআনের নিত্যকার ফরজসমূহের উপর আমল শুরু করে দেওয়া এবং সহীহ শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শেখার জন্য মেহনতে লেগে পড়া।
‘এমনিভাবে লক্ষ্য করা যায়, অনেকে কুরআনের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য তো সময় বরাদ্দ করে, কিন্তু কুরআন শেখার ও তাজবীদের সাথে তেলাওয়াতের যোগ্যতা অর্জন করার জন্য সময় দিতে চায় না। এটাও এক মারাত্মক অবহেলা।” [দ্র. ভূমিকা, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন (বাংলা) প্রথম প্রকাশ, পৃ. ১৯]
আমরা যদি কুরআনের তরজমা-তাফসীর পাঠ করতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে যে, শরীয়তের বিধানের দিক থেকে বিষয়টা কোন্ পর্যায়ের? সেটা উপলব্ধি করে এর আগের করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে বা সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে পাশাপাশি এটাও করতে হবে।
দ্বিতীয় মূলনীতি
দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের স্বীকৃত তরজমা-তাফসীর পাঠ করা। যখন আমাদের তরজমা-তাফসীর পাঠ করতে হবে তাহলে নির্বাচন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা, সাহাবায়ে কেরামের নীতি-আদর্শের উপর যারা রয়েছেন উম্মাহর সেই জামাতের যারা স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব, ইলম তাকওয়া পরহেযগারী এই সকল বিষয়ে যারা স্বীকৃত তাদের স্বীকৃত তরজমা-তাফসীরই পাঠ করব। বাজারে গিয়ে যে কোনো একটি তরজমা-তাফসীর সংগ্রহ করে তা পড়া শুরু করে দিলাম এমনটা কিছুতেই উচিত নয়। আমার উদ্দেশ্য, আমি কুরআনের ইলম অর্জন করব। কিন্তু কুরআনের ইলম অর্জন করা তো অনেক উপরের ব্যাপার এটা তো সাধারণ কোনো শাস্ত্রের ইলম অর্জন করারও উপযুক্ত পন্থা নয় যে, বাজারে গিয়ে যে বই পেলাম তা-ই সংগ্রহ করলাম এবং পাঠ করতে আরম্ভ করে দিলাম। এজন্য দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে, কী পাঠ করবেন তা আপনাকে নির্বাচন করতে হবে। আর নির্বাচনের মানদণ্ড হবে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী স্বীকৃত ব্যক্তিত্বের স্বীকৃত তরজমা-তাফসীর।
তৃতীয় মূলনীতি
এটারই সম্পূরক মূলনীতি তৃতীয় মূলনীতি হিসেবে যেটা বলব সেটা হচ্ছে, আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকাহ থেকে দূরে থাকা। এক শ্রেণি হল আহলুস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ। এর বিপরীত শ্রেণি হল আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকাহ। আহলুস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ মানে, যারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরামের জামাআত এবং প্রতি যুগের আহলে হকের জামাত যে আদর্শের উপর ছিলেন, রয়েছেন তাদের অনুসারী। আর আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকাহ মানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহ থেকে যারা বিচ্যুত হয়েছে এবং আকীদা আহকাম আমল এই সকল বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর স্বীকৃত পথ থেকে, যে পথের উপর মুসলিম উম্মাহ যুগ যুগ ধরে রয়েছে, যারা বিচ্যুত হয়েছে, এদের থেকে, এদের তরজমা-তাফসীর শীর্ষক বইপত্র থেকে দূরে থাকতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা যদি না হয় তাহলে দ্বীনের সহীহ আকীদা আহকাম জানার জন্য তরজমা-তাফসীর পড়বেন, কিন্তু সূত্র ভুল হওয়ার কারণে গলদ আকীদা, গলদ আহকামের দিকে চলে যেতে পারেন।