ইসলাম

খেয়ানতের বিভিন্ন রূপ ,বেঁচে থাকার চেষ্টা করি

মাসিক আল কাউসার থেকে সংগৃহীত

মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমানত। যা ছাড়া ঈমানই পূর্ণ হয় না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ.

যার মধ্যে আমানত নেই তার ঈমান নেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৩৮৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩০৯৫৬

ঈমানের অপরিহার্য দাবি- আমানত ও বিশ্বস্ততা। ঈমানদার হবে আমীন ও বিশ্বস্ত, নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন। যার ভেতর ও বাহির অভিন্ন। খেয়ানতকে হাদীসে মুনাফেকের নিদর্শন বলা হয়েছে। আমানত ও খেয়ানতের বিষয়টি ইসলামে অনেক বিস্তৃত। কুরআন-সুন্নাহ্র আলোকে এখানে খেয়ানতের কিছু দিক পেশ করা হল।

১, কুফর খেয়ানতের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ

মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, মেধা-প্রতিভা সবই আল্লাহর অনন্য দান ও আমানত। তাই সুস্থ ও স্বচ্ছ বিবেকের দাবি- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে সমর্পিত হওয়া। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সকল বিধানকে শিরোধার্য করা। অন্যথা এর চেয়ে বড় খেয়ানত আর কী? কুরআন কারীমে এটিকে খেয়ানত আখ্যা দিয়ে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِنْ یُّرِیْدُوْا خِیَانَتَكَ فَقَدْ خَانُوا اللهَ مِنْ قَبْلُ فَاَمْكَنَ مِنْهُمْ، وَ اللهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ.

(হে নবী!) তারা যদি আপনার সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের ইচ্ছা করে থাকে, তবে তারা তো ইতিপূর্বে আল্লাহর সঙ্গেও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, যার পরিণামে আল্লাহ তাদেরকে (আপনাদের) আয়ত্তাধীন করেছেন। বস্তুত আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। -সূরা আনফাল (৮) : ৭১

২, সকল গোনাহই খেয়ানত

ছোট হোক আর বড়, প্রতিটি গোনাহই খেয়ানত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَخُوْنُوا اللهَ وَ الرَّسُوْلَ وَ تَخُوْنُوْۤا اَمٰنٰتِكُمْ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.

হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনে-শুনে নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। -সূরা আনফাল (৮) : ২৭

আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, আয়াতের প্রেক্ষাপট যাই হোক, ‘খেয়ানত’ এখানে ব্যাপকার্থে। ছোট-বড়, সংক্রামক ও অসংক্রামক, সকল গোনাহই এখানে শামিল। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৪১

কুরআন কারীমে কুদৃষ্টিকে চোখের খেয়ানত বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

یَعْلَمُ خَآىِٕنَةَ الْاَعْیُنِ وَ مَا تُخْفِی الصُّدُوْرُ.

আল্লাহ জানেন চোখের অসাধুতা এবং বুকের ভেতরের গুপ্ত বিষয়। -সূরা মু’মিন (৪০) : ১৯

এখানে চোখের খেয়ানতের কথা বলা হয়েছে। আসলে কেবল চোখ নয়, আল্লাহর দেওয়া প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই আমানত। কোনো অঙ্গ আল্লাহর নাফরমানীতে ব্যবহার করা- উক্ত আমানতের খেয়ানত। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন-

أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ تَعَالَى مِنَ الْإِنْسَانِ فَرْجَهُ وَقَالَ هَذِهِ أَمَانَةٌ اسْتَوْدَعْتُكَهَا، فَلَا تَلْبَسْهَا إِلّا بِحَقٍّ. فَإِنْ حَفِظْتَهَا حَفِظْتُكَ فَالْفَرْجُ أَمَانَةٌ، وَالْأُذُنُ أَمَانَةٌ، وَالْعَيْنُ أَمَانَةٌ، وَاللِّسَانُ أَمَانَةٌ، وَالْبَطْنُ أَمَانَةٌ، وَالْيَدُ أَمَانَةٌ، وَالرِّجْلُ أَمَانَةٌ، وَلَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ.

আল্লাহ মানুষের যে অঙ্গ সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন তা হল, গুপ্তাঙ্গ। তা সৃষ্টির পর বনী আদমকে আল্লাহ বলেছেন, এটি তোমার কাছে আমানত রাখলাম; ন্যায়পথ ছাড়া তুমি তা ব্যবহার করবে না। যদি তুমি এ আমানতের হেফাযত কর তাহলে আমি তোমার হেফাযতের জামিন হয়ে যাব। সুতরাং গুপ্তাঙ্গ আমানত। কান, চোখ, জিহ্বা, পেট, হাত, পা সবই আমানত। যার আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই।  -দ্র. তাফসীরে কুরতুবী ১৪/২৫৪

৩, ওয়াদা ভঙ্গ করা চরম খেয়ানত

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা গুরুতর অপরাধ এবং চরম খেয়ানত। বিষয়ের বিবেচনায় সেই অপরাধের মাত্রা বাড়তেও থাকে। ওয়াদা যদি হয় আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের সঙ্গে, তো এর চেয় বড় খেয়ানত আর কী হতে পারে? আহ্লে কিতাবরা এমনই করেছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِّیْثَاقَهُمْ لَعَنّٰهُمْ وَ جَعَلْنَا قُلُوْبَهُمْ قٰسِیَةً، یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ وَ نَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهٖ.

তারপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তো আমি তাদেরকে আমার রহমত থেকে বিতাড়িত করি ও তাদের অন্তর কঠিন করে দেই। তারা (তাওরাতের) বাণীসমূহকে তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে দেয় এবং তাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তার একটি বড় অংশ ভুলে যায়। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৩

এরপর আল্লাহ বলেন-

وَ لَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلٰی خَآىِٕنَةٍ مِّنْهُمْ اِلَّا قَلِیْلًا مِّنْهُمْ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَ اصْفَحْ، اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.

(ভবিষ্যতেও) আপনি তাদের অল্পসংখ্যক ব্যতীত সকলেরই কোনো না কোনো খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে থাকবেন। সুতরাং (এখন) তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহ্সানকারীদের ভালবাসেন। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৩

অর্থাৎ খেয়ানত তাদের পুরোনো চরিত্র। তবে এখনই আপনাকে এই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না যে, সমস্ত বনী ইসরাঈলকে সমষ্টিগতভাবে কোনো শাস্তি দেবেন। সময় যখন হবে, আল্লাহ নিজেই তাদেরকে শাস্তি দেবেন।

এই আয়াতে ওয়াদা ভঙ্গ করাসহ কয়েকটি গুরুতর গোনাহ্র পর ‘খায়িনা’ শব্দ উল্লেখিত হয়েছে। কারণ প্রতিশ্রুতি ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ভঙ্গ করা নেহায়েত গাদ্দারি ও অনেক বড় খেয়ানত।

ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন- তাদের খেয়ানত ছিল রাসূলুল্লাহ ও তাদের মাঝে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করা আর যুদ্ধে মুশরিকদের সহযোগিতা করা। -তাফসীরে কুরতুবী ৬/১১৬

৪, অন্যায়ের পক্ষপাতিত্ব গুরুতর খেয়ানত

অন্যায় ও মিথ্যার সহায়তা বা পক্ষপাতিত্ব করা খেয়ানত। এমনকি কারো দাবির বৈধতা নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার পক্ষে সাক্ষ্য বা সাফাই গাওয়াও এক ধরনের খেয়ানত। কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَا تَكُنْ لِّلْخَآىِٕنِیْنَ خَصِیْمًا.

আর আপনি খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হবেন না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৫

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-

وَ لَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِیْنَ یَخْتَانُوْنَ اَنْفُسَهُمْ ، اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا اَثِیْمًا.

আর যারা নিজেদের সঙ্গেই খেয়ানত করে আপনি তাদের পক্ষে বাক-বিতণ্ডা করবেন না। আল্লাহ কোনো খেয়ানতকারী পাপিষ্ঠকে পছন্দ করেন না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৭

অন্যায়ের পক্ষপাতিত্ব যেমন হতে পারে ব্যক্তির ক্ষেত্রে, হতে পারে নির্দিষ্ট গোত্র বা দলের ক্ষেত্রেও।

৫, অযোগ্যের হাতে দায়িত্ব দেওয়া খেয়ানত

যোগ্য লোকের নিপুণ হাত ছাড়া কোনো কাজই সুন্দর ও সুচারু হয় না। অতএব যে কোনো কাজের দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্য, দক্ষ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত। দুর্বল বা অযোগ্য ব্যক্তির কাঁধে দায়িত্ব ছেড়ে দিলে সকলেরই ক্ষতি। প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু যর রা. বলেন, একদিন আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেছিলাম, আপনি  কি আমাকে প্রাদেশিক গভর্নর বানাবেন? তখন নবীজী হাত দিয়ে আমার বুকে একটা (মৃদু) থাপ্পড় দিয়ে বললেন-

يَا أَبَا ذَرٍّ، إِنَّكَ ضَعِيفٌ، وَإِنَّهَا أَمَانَةُ، وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ، إِلّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا، وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا.

আবু যর! তুমি দুর্বল আর এটি আমানত। কিয়ামতের দিন এটি মানুষের লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ হবে। হাঁ, দায়িত্বটাকে যে ভালোভাবে গ্রহণ করবে এবং অর্পিত দায়িত্বের হক যথাযথ আদায় করবে সে বেঁচে যাবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৩২০৭

ইমাম নববী রাহ. বলেন, দায়িত্বের আকাঙ্ক্ষা থেকে বেঁচে থাকার জন্য এটি অনেক বড় মূলনীতি। বিশেষত দায়িত্ব আদায়ে যাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে, তাদের জন্য রয়েছে এখানে অনেক শিক্ষা।

দায়িত্ব গ্রহণ বা প্রদান হালকা কোনো বিষয় নয়। অযোগ্যের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া অনেক বড় খেয়ানত। নবীজী বলেছেন, এটি কিয়ামতেরও আলামত। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন এক গ্রাম্যলোক এসে প্রশ্ন করল, কিয়ামত কবে?

নবীজী তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। এতে উপস্থিত অনেকের ধারণা হয়েছিল, নবীজী তার প্রশ্ন শুনেও জবাব দেননি। কারণ অপছন্দ করেছেন। আবার কারো কারো মনে হয়েছিল, নবীজী সম্ভবত তার কথা শুনতেই পাননি!

আলোচনা শেষ হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোঁজ করলেন- কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী কোথায়?

লোকটি বলল, এই যে আমি!

তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমানত যখন নষ্ট হওয়া শুরু হবে তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা করো!

লোকটি বলল, আমানত আবার নষ্ট হয় কীভাবে?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ.

অযোগ্য ব্যক্তির কাছে যখন দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হবে তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯; শরহুস সুন্নাহ, বাগাভী, হাদীস ৪২৩২

৬, ভুল পরামর্শ প্রদান খেয়ানত

জীবন চলার পথে সুখে-দুঃখে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে একে-অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। অনেক সময় পরামর্শেরও প্রয়োজন হয়। দেখা যায়, সময়মতো সুন্দর একটি পরামর্শের দাম লাখ টাকার চেয়েও বেশি। তেমনি একটি ভুল পরামর্শ ডেকে আনতে পারে বিরাট ক্ষতি। কাজেই পরামর্শদাতাকে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَنْ أَشَارَ عَلَى أَخِيهِ بِأَمْرٍ يَعْلَمُ أَنَّ الرُّشْدَ فِي غَيْرِهِ فَقَدْ خَانَهُ.

যে ব্যক্তি তার ভাইকে কোনো বিষয়ে পরামর্শ দিল, অথচ সে জানে কল্যাণ এর বিপরীতে, তবে সে তার সঙ্গে খেয়ানত করল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৫৭; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৫০

আবু হুরায়রা রা. নবীজী থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন-

إِنَّ الْمُسْتَشَارَ مُؤْتَمَنٌ.

যার কাছে কোনো বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয় সে আমানতদার। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৬৯; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ২৫৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১২৮

হযরত মাওলানা মনযুর নুমানী রাহ. বলেন- যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় পরামর্শ গ্রহণকারী তাকে নির্ভরযোগ্য মনে করেই তো তার কাছে যায়। নিজের একটি আমানত তার কাছে সোপর্দ করে। অতএব তার উচিত, আমানতের হক আদায়ে ত্রুটি না করা। অর্থাৎ ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করেই তাকে কল্যাণমূলক পরামর্শ দেওয়া এবং বিষয়টির গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করা। অন্যথায় সে এক ধরনের খেয়ানতের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। -মাআরিফুল হাদীস ২/১৫১ (২১০)

৭, মিথ্যা বলা খেয়ানত

একজন আমার প্রতি পূর্ণ আস্থার সঙ্গে আমার কথা শুনছে বা আমার দেওয়া তথ্য গ্রহণ করছে, কারণ আমি একজন মুসলিম। অথচ তার সঙ্গে বলা হল মিথ্যা, অথবা চালিয়ে দেওয়া হল মিথ্যা তথ্য। এটি তার সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা নয় তো কী? উপরন্তু এটি নিজের ব্যক্তিত্বকেও তো প্রশ্নবিদ্ধ করে। হাদীসে একে ‘অনেক বড় খেয়ানত’ বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

كَبُرَتْ خِيَانَةً تُحَدِّثُ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ مُصَدِّقٌ، وَأَنْتَ بِهِ كَاذِبٌ.

এটা অনেক বড় খেয়ানত যে, তুমি তোমার ভাইকে কোনো কথা বলছ, সে এটাকে সত্য বলে বিশ^াস করে নিচ্ছে, অথচ তুমি এতে মিথ্যাবাদী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৬৩৫; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৩৯৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৭১

৮, স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক ও একান্ত বিষয়াদি অন্যের নিকট প্রকাশ করা খেয়ানত

প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنَّ مِنْ أَعْظَمِ الْأَمَانَةِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الرَّجُلَ يُفْضِي إِلَى امْرَأَتِهِ، وَتُفْضِي إِلَيْهِ، ثُمَّ يَنْشُرُ سِرَّهَا، وَقَالَ ابْنُ نُمَيْرٍ:إِنَّ أَعْظَمَ.

কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট যে আমানতের খেয়ানত সবচেয়ে বড় বলে গণ্য হবে- তা এই যে, কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়, স্ত্রীও স্বামীর সাথে মিলিত হয়, তারপর (স্বামী-স্ত্রীর) একান্ত বিষয়গুলো অন্যদের কাছে প্রকাশ করে দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৬৫৫

৯, মজলিসের কথাবার্তা আমানত, তথ্য ফাঁস করে দেওয়া খেয়ানত

এমন অনেক হয় আমাদের মাঝে, কেউ একটা কথা বলেছে। মুখে হয়তো কাউকে জানানোর জন্য নিষেধ করেনি, কিন্তু তার ভাব-ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, সে চায় না- কথাটি অন্যরা জানুক, তাহলে তার কথাটি আমানত স্বরূপ থাকবে এবং আমাকে আমানতের মতোই এর হেফাজত করতে হবে। নতুবা খেয়ানত হবে। জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِذَا حَدَّثَ الرَّجُلُ بِالْحَدِيثِ ثُمَّ الْتَفَتَ فَهِيَ أَمَانَةٌ.

যখন কোনো ব্যক্তি কারো কাছে কিছু বলার সময় এদিক-ওদিক তাকায়, তখন এ কথা শ্রোতার জন্য আমানত হয়ে যায়। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৬১১১; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৬৮

তবে হাঁ, সেটি যদি অন্য কারো হক নষ্ট, ষড়যন্ত্র বা ক্ষতি সাধনমূলক কিছু হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই জানিয়ে দেওয়া জরুরি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই নির্দেশও দিয়েছেন।

জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْمَجَالِسُ بِالْأَمَانَةِ إِلّا ثَلَاثَةَ مَجَالِسَ: سَفْكُ دَمٍ حَرَامٍ، أَوْ فَرْجٌ حَرَامٌ، أَوْ اقْتِطَاعُ مَالٍ بِغَيْرِ حَقٍّ.

قَالَ الْمَنَاوِيُّ : إِسْنَاده حَسَن. (عون المعبود ১৩/২১৮)

সকল মজলিস আমানতস্বরূপ। (অর্থাৎ কোনো মজলিসে গোপনীয়তার সাথে যে পরামর্শ অথবা সিদ্ধান্ত হয়, মজলিসে উপস্থিত লোকজন যেন এটাকে আমানত মনে করে গোপন রাখে।) কিন্তু তিনটি মজলিসের বিধান এর ব্যতিক্রম ।

এক. যে মজলিসের সম্পর্ক কারো অন্যায় হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে।

দুই. যে মজলিসে কারো সম্ভ্রমহানির পরামর্শ করা হয়।

তিন. যে মজলিসের সম্পর্ক অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ কেড়ে নেওয়ার সাথে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৬৯; আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী, হাদীস ২১১৬২

বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া কারো ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়া বা বয়ান রেকর্ড করে প্রচার করে দেওয়ার মতো কাজগুলোও খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত।’ (বিস্তারিত দ্র. ইসলাহী খুতুবাত, খণ্ড-৩; ইসলাম ও আমাদের জীবন ৭/৬৩, ৬৭)

এছাড়াও আরো বহুভাবে আমানতের খেয়ানত হতে পারে। হযরত তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, চাকরির নির্ধারিত সময়ে অন্য কাজ করা, পদ-পদবি ও দাপ্তরিক দায়িত্বে অবহেলা, অপব্যবহার করা, অফিসের আসবাবপত্র ও সরকারি জিনিসপত্র ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা- সবই খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি যে সড়কে আমরা চলাচল করি তা আমাদের কাছে আমানত। যেই বাস বা ট্রেনে ভ্রমণ করা হয় তাও আমানত। ঘর বা বাসাভাড়া নেওয়া হয়, সেটিও মালিকের পক্ষ থেকে আমানত। কাজেই এসবের ব্যবহার করতে হবে বৈধ উপায়ে। নয়তো খেয়ানতের গোনাহ হবে। (বিস্তারিত দ্র. ইসলাহী খুতুবাত, খ–৩; ইসলাম ও আমাদের জীবন, ৭/৬৩, ৬৭)

১০, খেয়ানতকারীর সঙ্গেও খেয়ানত নয়

খেয়ানতকারীর সঙ্গেও খেয়ানতসূলভ কাজ করা যাবে না। খেয়ানতের জবাব খেয়ানত দেয়ে দিব না। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَدِّ الأَمَانَةَ إِلَى مَنْ ائْتَمَنَكَ، وَلاَ تَخُنْ مَنْ خَانَكَ.

যে তোমার কাছে আমানত রেখেছে তার আমানত আদায় করে দাও! যে তোমার সঙ্গে খেয়ানত করেছে তার সঙ্গেও খেয়ানত করো না! -জামে তিরমিযী, হাদীস ১২৬৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৫৩৫

আসুন, সব ধরনের খেয়ানত থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি! আল্লাহই তাওফীক দেওয়ার মালিক।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *