জুয়া : সংজ্ঞা ও পরিচয়
ইসলাম বাস্তববাদী জীবন-বিধান। তাই ইসলাম মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদা তথা আমোদ-ফুর্তি এবং বিনোদনের প্রতিও বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে এবং এ ব্যাপারে বিধান দিয়েছে। এ বিধান প্রবর্তন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষকে নভোমণ্ডলে বিচরণকারী ফিরিশতা মনে করে কর্মবিধান তৈরি করেনি। বরং খাদ্য-পানীয় গ্রহণকারী ও হাটে বাজারে বিচরণকারী মানুষ মনে করেই তার জন্য বিধান দেওয়া হয়েছে।
মোদ্দা কথা হল, এ বিধান দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের স্বভাবজাত বিষয়গুলোকে অস্বীকার করা হয়নি। তাই বিনোদন বা আমোদ-ফুর্তি ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন, স্বেচ্ছাচারিতা এবং গর্হিত পন্থা অবলম্বনেরও কারো জন্য অবকাশ নেই।
বিশেষভাবে যে সব খেলা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন বানায় এবং সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়; তা কোনক্রমেই জায়েয নেই। জুয়া এ সবের মধ্যে অন্যতম। জুয়াকে আরবীতে মায়সির বলা হয়। একে কিমার ও বলা হয়। মায়সির বা কিমার এমন খেলাকে বলা হয় যা লাভ ও ক্ষতির মধ্যে আবর্তিত থাকে। অর্থাৎ যার মধ্যে লাভ-ক্ষতির কোনটাই স্পষ্ট নয়। [জাওয়াহিরুল ফিক্হ : ২য় খণ্ড : ৩৩৬]
জুয়ার পরিচয়
জুয়া এমন এক খেলা, যা লাভ-লোকসানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে। জুয়া খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা বস্তু (যা পুরস্কার হিসেবে ধার্য করা হয়) নির্ধারণ করা হয়। এরপর কোনো একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হার-জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায়, সে পক্ষ অপর পক্ষকে পূর্বনির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে। জুয়া খেলায় তিনটি উপাদান থাকা প্রয়োজন—বিবেচনা (বাজির পরিমাণ), ঝুঁকি (সুযোগ) ও পুরস্কার।
জুয়ার আরবি প্রতিশব্দ মাইসির ও কিমার। মাইসির মানে সহজলভ্যতা। জুয়ার মাধ্যমে খুব সহজে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা যায় বলে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে। কিমার মানে হার-জিতের খেলা, বাজি ধরা, ঝুঁকি নেওয়া। কিমার মূলত কমর ধাতু থেকে উদগত, যার অর্থ চাঁদ। জুয়া খেলায় সম্পদ চাঁদের মতো বাড়ে-কমে বলে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে। (আল বাহরুর রায়েক)
ইসলামে এমন প্রতিটি বিষয়কে জুয়া বলা হয়, যার ফলাফল হয়তো লাভ নয়তো ক্ষতি। (জাওয়াহিরুল ফিকহ) অর্থাৎ প্রতিটি এমন প্রতিযোগিতা বা খেলা, যেখানে ফলাফল নিজের পক্ষে এলে অংশগ্রহণকারী লাভবান হবে, আর বিপক্ষে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা জুয়া হবে। যদি এমন হয় যে ফলাফল নিজের পক্ষে এলে লাভবান হবে, কিন্তু বিপক্ষে গেলে কোনো ক্ষতি হবে না, সেটা জুয়া নয়। (আল কিমার ওয়া সোয়ারুহুল মুহাররামাহ)
তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে, যে ব্যাপারে কোন মালের মালিকানায় এমন সব শর্ত আরোপিত হয় যাতে মালিক হওয়া না হওয়া উভয় সম্ভাবনাই সমান থাকে। আর এরই ফলে এতে লাভ কিংবা লোকসান উভয় দিকই বজায় থাকে। [শামী : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৫৫]
যেমন দুই ব্যক্তি পরস্পর একে অপরকে বাজি ধরে বলল, যদি তুমি দৌড়ে অগ্রসরমান হও তবে তোমাকে এক হাজার টাকা দিব। আর যদি আমি সগ্রসরমান হই তবে তুমি আমাকে এক হাজার টাকা প্রদান করবে। অথবা পরস্পর বাজি ধরে এরূপ বলল যে, যদি আজ বৃষ্টি হয় তবে তুমি এক হাজার টাকা আমাকে প্রদান করবে। আর যদি না হয় তাহলে আমি তোমাকে প্রদান করবো। অথবা কতগুলো মুখ বন্ধ করা পট। এগুলোর কোনটার মধ্যে দশ টাকার নোট, কোনটার মধ্যে আরো বেশি, আবার কোনটার মধ্যে মোটেই নেই। এ জাতীয় পট প্রতিটি এক টাকা করে বিক্রি করা। এ-ও এক জাতীয় জুয়া। এ ক্ষেত্রেও লাভ লোকসান অস্পষ্ট।
জাহিলী আমলে নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল। তন্মধ্যে এক প্রকার জুয়া ছিল এই যে, উট যবাহ করে তার অংশ বণ্টন করার ব্যাপারে জুয়ার আশ্রয় গ্রহণ করা হত। অর্থাৎ দশ নামে দশটি তীর তৈরি করা হত । প্রতিটি তীরে হিস্যা নির্ধারিত থাকত। কোনটার মধ্যে এক হিস্যা, কোনটায় দুই, কোনটায় তিন আবার কোনটায় কোন হিস্যার কথা উল্লেখ থাকতো না।
লটারীর মাধ্যমে যার নামে যেটি আসত সে অনুপাতে সে হিস্যা পেত। হিস্যাহীন তীরটি যার ভাগে পড়ত সে উটের গোশত থেকে বঞ্চিত থাকত। কিন্তু বঞ্চিত ব্যক্তিকেও উটের মূল্য দিতে হত। এ জাতীয় জুয়াকে মায়সির বলা হয়েছে। তৎকালীন যুগে বেচাকেনার ক্ষেত্রে এছাড়াও আরো বহু প্রকারের জুয়া প্রচলিত ছিল। যেমন মুলামাসা (১%) কোন বস্তুর মালিকানা হাসিলের জন্য পরস্পর এভাবে প্রতিযোগিতা করা যে, যে আগে তা স্পর্শ করতে পারবে সে এর মালিক হবে। অথবা মুনাবাযা মালিকানা হাসিলে এমনভাবে প্রতিযোগিতা করা যে- এর প্রতি আগে কোন বস্তু নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবে সে এর মালিক বলে গণ্য হবে ইত্যাদি।
ইসলামের আবির্ভাবের আগে জুয়া শুধু বৈধই ছিল না বরং একে মান- সম্মানযোগ্য কাজ বলে বিবেচনা করা হত। এমনকি নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশের জন্য জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত হিস্যা নিজে ভোগ না করে গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হত। যেমন বর্তমানে কোথাও লটারীর টাকা দিয়ে করা হয়ে থাকে। [জাওয়াহিরুল ফিক্হ (তাফসীরে কবীর) ২য় খণ্ড : পৃ. ৩৩৬-
বর্তমানকালে প্রাচীন পদ্ধতি ছাড়াও জুয়ার ক্ষেত্রে আরো বহু নব নব পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সবগুলোই হারাম। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শুধু নাম পরিবর্তনের কারণে বস্তুর হাকীকত (আসল) এবং হুকুম পরিবর্তিত হয় না। কাজেই প্রাচীনকালে প্রচলিত জুয়া সম্পর্কে যে হুকুম প্রযোজ্য ছিল, আধুনিককালের জুয়ার ক্ষেত্রেও সে হুকুম প্রযোজ্য হবে।