নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমানত রক্ষার অনুপম দৃষ্টান্ত
মহানবি (সা.) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আমানতদার। তার কাছে শুধু মুসলমানরাই সম্পদ আমানত রাখেননি বরং অমুসলিম অবিশ্বাসীরাও তার কাছে আমানত রাখতেন। সবাই জানতেন এ মহান ব্যক্তির কাছে আমানত রাখলে আমাদের কোনো ভয় নেই। পবিত্র কুরআনের যে আয়াত প্রথমে উল্লেখ করেছি ‘আর যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি যত্নবান।’ এর ওপর সবচেয়ে বেশি আমলকারী ছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.)।
তাই তো হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেছিলেন, ‘রাসূলে করিম (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জানতে হলে কুরআনে কারিমের শিক্ষাকে দেখ। অর্থাৎ তার (সা.) প্রতিটি কাজ ছিল পবিত্র কুরআনে কারিম অনুযায়ী।’
মহানবি (সা.)-এর আমানত রক্ষার বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। বিশ্বনবি (সা.)-এর ওপরও আপত্তি করা হয়, তিনি (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য যুদ্ধ করেছেন অথবা নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধ করেছেন, নাউযুবিল্লাহ। যুদ্ধের সময়ও রাসূল (সা.) আমানতের যে উত্তম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন ইতিহাস এর সাক্ষী। যখন ইসলামি সেনাদল খায়বার ঘিরে ফেলল তখন সে সময় সেখানকার এক ইহুদি নেতার এক কর্মচারী, যে তার পশু চরাত সে পশুপালসহ ইসলামি সেনাদলের এলাকায় এলো এবং মুসলমান হয়ে গেল এবং মহানবি (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল!
আমি তো এখন মুসলমান হয়ে গেছি, ফেরত যেতে চাই না, এ ছাগপাল আমার কাছে রয়েছে, এগুলো এখন কী করব আর এর মালিক ইহুদি। তিনি (সা.) বলেন, এ ছাগপালের মুখ কেল্লার দিকে ঘুরিয়ে হাঁকিয়ে দাও তারা নিজেরাই তাদের মালিকের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। অতএব, তিনি এমনটিই করলেন আর কেল্লার মালিক ছাগপালকে কেল্লার ভেতর নিয়ে গেল। দেখুন, এটি হলো আমানতের সেই অনুপম দৃষ্টান্ত যা মানবতার নবি ও শ্রেষ্ঠনবি (সা.) প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমন কঠিন অবস্থায়ও রাসূলে কারিম (সা.)-এর অনুভূতি এমনই ছিল, এক ব্যক্তি যাকে কারও সম্পদের আমিন বানানো হয়েছে আর সে এখন মুসলমান হয়েছে আর সে মুসলমান হয়ে খেয়ানত করবে এটা কখনো হতে পারে না।
তিনি (সা.) তাকে ইসলাম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম শিক্ষা এটিই দিলেন, আমানতের কখনো খেয়ানত করবে না। অবস্থা যাই হোক না কেন তোমাদের আল্লাহ পাকের এ আদেশ সব সময় পালন করতে হবে, ‘তোমরা নিজেদের আমানতের প্রতি যত্নবান হও, তা পুরোপুরি ফেরত দাও এটির প্রতি কখনো অবহেলা প্রদর্শন কর না।’
একটু ভেবে দেখুন, সে সময় যুদ্ধ হচ্ছিল, মুসলমানদেরও খাবারের প্রয়োজন ছিল আর সেসব ছাগল তাদের কাজে আসত, এরপরও তিনি (সা.) বলেন, এমনটি করো না, এটি অবৈধ, এটি খেয়ানত আর অবৈধভাবে নেওয়া সম্পদ মুসলমানদের জন্য হারাম। সুতরাং এ শিক্ষা ও অতুলনীয় আদর্শই মহানবি (সা.) আমাদের দিয়েছেন।
আমরা জানি, যুবক বয়সেই মহানবি (সা.)-এর আমানত এতটা প্রসিদ্ধ ছিল, মক্কার কুরাইশরা তাকে (সা.) ‘আমিন’ নামে ডাকত। এমনকি তার (সা.) নবুওয়ত লাভের পরও যখন বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে এবং মক্কার বসবাসকারী নেতারাও তার (সা.) বিরোধী ছিল তখনো তারা মহানবি (সা.)-এর কাছে তাদের আমানত গচ্ছিত রাখত। কেননা তারা জানত, ইনিই একমাত্র আমানতদার ব্যক্তি, যার কাছে আমাদের গচ্ছিত আমানত কখনো নষ্ট হবে না। দেখুন, তিনি (সা.) কীভাবে এ আমানত রক্ষা করেছেন, যখন মহানবি (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করতে ছিলেন তখনো অনেকের আমানত তার কাছে ছিল আর তিনি (সা.) এসব ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন।
লোকদের আমানত যেন তাদের কাছে পৌঁছে যায়, কারও যেন এটি বলার সাহস না হয়, আমাদের আমানত না দিয়েই তিনি চলে গেছেন। আমরা তো তাকে আমিন মনে করতাম কিন্তু আজ ধোঁকা খেয়েছি। এমনটি হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। রাসূলে কারিম (সা.) এ আমানত ফেরত দেওয়ার জন্য হজরত আলীকে (রা.) নির্ধারণ করলেন এবং তার কাছে গচ্ছিত মালামাল সোপর্দ করলেন এবং বললেন, যাদের আমানত এখানে রয়েছে তাদের পৌঁছে দিও। সেই সঙ্গে তিনি (সা.) এটিও বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি মক্কাতেই থাকবে যতক্ষণ না প্রত্যেকের আমানত প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে যায়।
অতএব, এ সত্যবাদী ও আমিন রাসূল (সা.) সেই বিপদের সময়ও একজন প্রাণ উৎসর্গকারীকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তার আমানত তাকে ফেরত দাও। আর যে ব্যক্তি তোমার আমানত আত্মসাৎ করেছে, তুমি তার আমানত আত্মসাৎ করো না’ (আবু দাউদ)। আমানতদারের মর্যাদা ঘোষণায় রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘একজন সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী আখেরাতে নবি-সিদ্দিক এবং শহিদদের সঙ্গে থাকবেন’ (তিরমিজি)।