ইসলাম

মদের যাবতীয় বিধান

১, প্রাণ রক্ষার নিমিত্তে মদ পান করা

চরম পিপাসা বা ক্ষুধার অবস্থায় পানাহারের কোন বস্তু না পাওয়া গেলে এবং এতে প্রাণনাশের আশংকা দেখা দিলে এ অনন্যোপায় অবস্থায় প্রাণ রক্ষার লক্ষ্যে মদ পান করা জায়েয। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الميتة والدَّمَ وَلَحْمَ الخِنْزِيرِ وَمَا اهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ فَمَنِ اضْطَرَّ غَيْرَبَاغِ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌo

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং যার উপর আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নাম উচ্চারিত হয়েছে তা তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। যে অনন্যোপায় অথচ নাফরমান কিংবা সীমালঙ্ঘনকারী নয় তার কোন পাপ হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [২: বাকারা : ১৭৩]

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা অনন্যোপায় ব্যক্তির জন্য মৃত জন্তু, রক্ত এবং শূকরের মাংস ভক্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন। আর মদের বিষয়টিও এগুলোর মতই। কাজেই অনন্যোপায় অবস্থায় মদ পান করা জায়েয। অবশ্য এ ক্ষেত্রে নাফরমানী বা সীমালঙ্ঘনমূলক কোন আচরণ করা জায়েয হবে না। উল্লেখ্য যে, এ অবস্থা চলে যাওয়ার পর পূর্ববৎ তা হারাম হিসাবেই গণ্য হবে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- اِنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ الدَّاءَ وَالدَّوَاء وَجَعَلَ لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءً فَتَدَاوُوا وَلَا تَدَاوُوا بِحَرَامٍ রোগ এবং প্রতিষেধক আল্লাহ তাআলা উভয়ই নাযিল করেছেন। আর তিনি সর্বপ্রকারের রোগের জন্যই প্রতিষেধকের ব্যবস্থা রেখেছেন। সুতরাং রুগ্‌ণ অবস্থায় তোমরা ঔষধ ব্যবহার করবে। কিন্তু হারাম বস্তুকে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করবে না। [আল ফিক্হ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৩]

২, মদের ব্যবসা

এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মদ হারাম। কেউ যদি একে হালাল মনে করে তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে। কেননা, এর হারাম হওয়ার বিষয়টি অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। অনুরূপভাবে মদ হচ্ছে নাপাক। আর এ কথাটিও অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং তা বেচাকেনা করা বা উৎপাদন করা সবই হারাম। কেউ যদি কারো নিকট থেকে মদ ছিনিয়ে নিয়ে যায় বা তা নষ্ট করে দেয় তাহলে এ কারণে তার উপর কোন জরিমানা ওয়াজিব হবে না। মদের উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি হারাম হওয়া প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- لَعَنَ اللهُ الْخَمْرُ وَشَارِبَهَا وَسَاقِيهَا وَبَائِعَهَا وَمُبْتَاعَهَا وَعَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَحَامِلَها وَالْمَحْمُولَة إِلَيْهِ – আল্লাহ তাআলা লা’নত করেন মদের উপর, মদ্যপায়ীর উপর, মদ পরিবেশনকারীর উপর, ক্রয়-বিক্রয়কারীর উপর, প্রস্তুতকারীর উপর, যার জন্য প্রস্তুত করা হয় তার উপর, বহনকারীর উপর এবং যার জন্য বহন করে আনা হয় তার উপর। [আবু দাউদ : পৃ. ৫১৭]

অপর এক হাদীসে আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- إِنَّ الَّذِي حُرِمَ شُرْبُهَا حُرِمَ بَيْعُهَا وَأَكْلُ ثَمَنِهَا যা পান করা হারাম তা বেচাকেনা করা এবং বেচাকেনার পর এর মূল্য ভক্ষণ করাও হারাম। [আল ফিক্হ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ : ৫ম খণ্ড : পৃ. ২৬]

ফকীহগণের মতে মুসলিম দেশে অমুসলিমদেরকে প্রকাশ্যে মদের ব্যবসার অনুমতি দেওয়া এবং এর সুযোগ প্রদান করা জায়েয নেই । [প্রাগুক্ত]

এমনি গাঁজা, আফিম, হাশীশ ইত্যাদি মাদকদ্রব্যের ব্যবসাও জায়েয নেই। সেবন করা ছাড়া অন্য কোন কাজে মদের ব্যবহার জায়েয নেই। মদ পান করা যেমনিভাবে হারাম অনুরূপভাবে পান করা ছাড়া অন্য কাজে মদ ব্যবহার করাও হারাম। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদেরকে ঔষধ হিসাবে মদ পান করানো নাজায়েয এবং হারাম। এরূপ করলে যে পান করাবে সে গুনাহগার হবে।

হযরত ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনিবলেন- اِنَّ اَوْلَا دَكُمْ وَلَدُوْا عَلَى الْفِطْرَةِ فَلَا تَدَاوُوهُمْ بِالْخَمْرِ وَلَا تَعُدُّوهُمْ بِهَا فَإِنَّ اللَّهَ لَمْ يَجْعَلْ فِي

তোমাদের সন্তানগণ ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে মদ দ্বারা চিকিৎসা করবে না এবং তাদেরকে তা খাওয়াবে না। কেননা, আল্লাহ তাআলা নাপাক বস্তুতে প্রতিষেধক রাখেননি। ১৯-২০]

শরীরের ক্ষতস্থানে মদ ব্যবহার করা জায়েয নেই। এমনিভাবে কোন প্রাণীকে ঔষধ হিসাবে তা সেবন করানোও জায়েয নেই। মদের দ্বারা ডুস গ্রহণ করা এবং জননেন্দ্রিয়ের ছিদ্রে তা ব্যবহার করা নাজায়েয। জীব- জানোয়ারকে মোটা-তাজা করার নিমিত্তে মদ বা মাদকদ্রব্য সেবন করানো হারাম । [মাওসূ’আতুল ফিক্হ আল ইসলামী : ১২তম খণ্ড : 2.

মদ বা এ জাতীয় হারাম বস্তু ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করার ব্যাপারে ফকীহগণ বলেন, অনন্যোপায় অবস্থায় প্রাণনাশের আশংকা দেখা দিলে এ ক্ষেত্রে হারাম বস্তু ঔষধ হিসাবে সেবন করা জায়েয। কিন্তু অনন্যোপায় না হলে শুধু কেবল রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের লক্ষ্যে হারাম বস্তু ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা জায়েয কি না এ সম্বন্ধে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, যদি কোন বিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন যে, এ ঔষধ ব্যবহার করা ছাড়া তার রোগ নিরাময় হবে না, তাহলে তার জন্য এই হারাম ঔষধ এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা জায়েয হবে। [মা’আরিফুস সুনান : মাওলানা ইউসুফ বিনৌরী : ১ম খণ্ড : পৃ. ২৭৭]

উপরোক্ত ক্ষেত্রসমূহে মাদকদ্রব্যের হুকুমও মদের হুকুমের অনুরূপ। যে যে অবস্থায় মদের ব্যবহার হারাম, মাদকদ্রব্যও সে সে অবস্থায় হারাম। আর যে যে ক্ষেত্রে মদের ব্যবহার জায়েয সে সে ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারও জায়েয।

৩, মদ রোগ : ঔষধ নয়

মদ ঔষধ হিসাবে সেবন করাও জায়েয নেই। কেননা, প্রকৃতপক্ষে মদ বা মাদকদ্রব্য ঔষধই নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করার পর তিনি বলেছেন- إِنَّهُ لَيسَ بِدَواء لَكِنَّهُ دَاءً মদ মূলত কোন ঔষধই নয়; বরং তা হচ্ছে ব্যাধি।

অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- إِنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ الدَّاءَ وَالدَّوَاء وَجَعَلَ لَكُمْ دَاءً وَدَوَاء فَتَدَاوُوا وَلَا تَدَاوُوا بِحَرَامِ

আল্লাহ তাআলা রোগ-ব্যাধি ও তার ঔষধ উভয়ই নাযিল করেছেন। তোমাদের রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। অতএব, তোমরা চিকিৎসা করবে। তবে হারাম জিনিস দ্বারা নয়। মদ ও মাদকদ্রব্য সম্পর্কে হযরত ইবন মাসউদ (রা.) বলেছেন- إِنَّ اللهَ لَمْ يَجْعَلْ شِفَاءَ كُمْ فِيْمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ যে সব জিনিস তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে আল্লাহ তাতে তোমাদের রোগের আরোগ্য রাখেননি।

‘হারাম জিনিস তথা মাদকদ্রব্য ইত্যাদি দ্বারা চিকিৎসা করা হারাম’ এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা, কোন জিনিসকে হারাম করার অর্থ হচ্ছে তা থেকে দূরে থাকা অপরিহার্য। এ অবস্থায় যদি এর দ্বারা চিকিৎসা করার অনুমতি প্রদান করা হয় তবে হারাম ঘোষণা করার বিষয়টি নিরর্থক হয়ে দাঁড়াবে। আল্লামা ইবন কায়্যিম (রহ.) এ সম্পর্কে যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে বলেছেন, হারাম জিনিস ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি থাকলে তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। এহেন অবস্থায় হারাম ঘোষণার কথাটি অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। [আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম : পৃ. ৭৩-৭৪]

৪, শরীয়তের দৃষ্টিতে নেশাগ্রস্ত লোকের কথা বা কাজ

ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কোন মাতাল ব্যক্তি যদি মদ বা মাদকদ্রব্য পান করেছে বলে স্বীকার করে তবে তার উপর দণ্ড প্রদান করা যাবে না। তবে এ অবস্থায় সে যদি কোন মাল চুরি করার কথা স্বীকার করে সুরা তা তাহলে এ বক্তব্যের ভিত্তিতে তার উপর জরিমানা ওয়াজিব হবে। কেননা, এ হচ্ছে বান্দার হক। সুতরাং তা এ অবস্থায়ও ওয়াজিব হবে। কেউ যদি মাতাল অবস্থায় যিনা করে এবং এ ব্যাপারে সাক্ষীগণ সাক্ষ্য প্রদান করে তবে তার উপর হদ্দ কায়েম করা হবে। আলিমগণ বলেন, মাতাল- নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি হক্কুল ইবাদ সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি প্রদান করলে তার উপর দণ্ড জারী হবে। কোন পুরুষ বা মহিলার উপর অপবাদ আরোপ করেছে বলে কেউ স্বীকারোক্তি প্রদান করলে সুস্থ হওয়ার পর তাকে দণ্ড প্রদান করা হবে। তালাক প্রদান, দাস মুক্ত করা, কিসাস, দিয়াত এবং মালী হক-এর ব্যাপারে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির কথা ধর্তব্য হবে। মাতাল অবস্থায় ধর্ম ত্যাগ করলে তা ধর্তব্য হবে না। [আল ফিক্হ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ : ৫ম খণ্ড : পৃ. ২৮-২৯]

৫, এলকোহল বা স্পিরিট মিশ্রিত ঔষধ সেবন করা

বর্তমানে ঔষধ, আতর এবং আরো বিভিন্ন জিনিসের সাথে এলকোহল এবং স্পিরিট মিশানো হয়ে থাকে। এগুলো যদি আঙুর এবং খেজুর থেকে তৈরি করা হয় তবে তা পাক ও হালাল বস্তু হিসাবে আদৌ গণ্য হবে না। আর যদি এ ছাড়া অন্য কোন পদার্থ থেকে তৈরি করা হয় তবে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা জায়েয হবে; যদি তাতে নেশা সৃষ্টি না হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানকালের অধিকাংশ এলকোহল পেট্রোল এবং বিভিন্ন খাদ্যশস্য থেকে তৈরি করা হয়; আঙুর এবং খেজুর থেকে নয়। তাই এগুলোর ব্যবহার বৈধ। শরীয়তের দৃষ্টিতে এতে কোন অসুবিধা নেই। [তাকমিলা : মাওলানা তকী উসমানী : ৩য় খণ্ড : পৃ. ৬০৮]

৬, মদ গিফ্ট (GIFT) করা

মদ পান করা, মদ বিক্রি করা এবং বিক্রি করে এর মূল্য ভক্ষণ করা যেমন হারাম তেমনিভাবে কাউকে তা গিফ্‌ট (GIFT) করাও হারাম। কেননা, মদ উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করা হারাম বস্তুর প্রতি সন্তুষ্টির আলামত। এতে পাপ কাজে সহায়তা দান করা হয়। অথচ কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالعدوان তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সাহায্য করবে না। [৫ : মায়িদা : ২]

অধিকন্তু মুসলমান হল পবিত্র। সে পবিত্র বস্তু ছাড়া নাপাক বস্তু কাউকে হাদিয়া দিতে পারে না এবং নিজেও তা গ্রহণ করতে পারে না। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাদিয়া হিসাবে মদের পেয়ালা পেশ করার ইচ্ছা করলে তিনি তাকে বললেন, আল্লাহ তাআলা মদ হারাম করেছেন। তখন লোকটি বলল পোর্তা তাহলে আমি তা বিক্রি করে দিই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- إِنَّ الَّذِي حَرِمَ شَرِبَهَا حُرِمَ بَيْعُهَا আল্লাহ তাআলা তা পান করা যেমন হারাম করেছেন তেমনি বিক্রি করাও হারাম করেছেন। তখন লোকটি বলল- أَفَلَا أَكَارِمُ بِهَا الْيَهُودُ তবে কি কোন ইয়াহুদীকে হাদিয়া হিসাবে দিয়ে দিব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- إِنَّ الَّذِي حُرِمَهَا حُرِمَ أَنْ الْكَارِمَ بِهَا الْيَهُودُ যিনি তা পান করা হারাম করেছেন তিনিই তা কোন ইয়াহুদীকে হাদিয়াস্বরূপ দেওয়াও হারাম করেছেন। তখন লোকটি বলল- فكيف اصنع بها তাহলে আমি তা নিয়ে কী করবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- شَنْهَا عَلَى الْبَطْحَاءِ বাম হাতে তা ঢেলে দাও। [আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম : আল্লামা ইউসুফ আল কায্যাভী : পৃ. ৭২-৭৩]

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *