মদ ও মাদকদ্রব্যের অপকারিতা
মদ ও মাদকদ্রব্য সেবনের মধ্যে বহু অপকারিতা নিহিত আছে।
১. মদ্যপায়ী ব্যক্তি যখন মদ পান করে তখন তার থেকে ঈমানের নূর ছিনিয়ে নেওয়া হয। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন- أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا يُزْنِي جِيْنَ يَزَنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَمُؤْمِنٌ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ব্যভিচারী ব্যভিচার করার সময় ঈমানদার অবস্থায় থাকে না। মদপানকারী ব্যক্তি মদ পান করার সময় ঈমানদার অবস্থায় থাকে না। এমনিভাবে চোর চুরি করার সময় ঈমানদার অবস্থায় থাকে না। [বুখারী শরীফ : পৃ. ৮৩৬]
২. মদপানকারী ব্যক্তির উপর আল্লাহ তাআলা লা’নত বর্ষণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- لَعَنَ اللهُ الْخَمْرَ وَشَارِبَهَا وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَمُبْتَا عَهَا وَعَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَها وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمولة اليه –
আল্লাহ তাআলা লা’নত করেন- ১. মদের উপর, ২. মদ্যপায়ীর উপর, ৩. মদ পরিবেশনকারীর উপর, ৪. ক্রয়কারীর উপর, ৫. বিক্রয়কারীর উপর, ৬. প্রস্তুতকারীর উপর, ৭. যার জন্য প্রস্তুত করা হয় তার উপর, ৮. বহনকারীর উপর এবং ৯. যার জন্য বহন করে আনা হয় তার উপর । [আবু দাউদ শরীফ : পৃ. ৫১৭]
৩. মদ্যপানের কারণে দুঃশ্চিন্তা, রিযকের সংকীর্ণতা, চেহারা বিকৃতি এবং ভূমিকম্প ও ভূমি ধসে যাওয়া ইত্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে। হাদীসে এর প্রতি ইংগিত বিদ্যমান রয়েছে- لَيَكُونَنَّ فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ خَسْفُ وَقَدْفٌ وَمَسْخُ وَذلِكَ إِذَا شَرِبُوا الْخَمُوْرَ وَاتَّخَذُو الْقَيْنَاتِ وَضَرَبُوا بالمعازف
এ উম্মত যখন মদ পান করবে, গায়িকাদের দ্বারা গান করাবে এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাবে তখন তাদের মধ্যে ভূমিকম্প, প্রস্তর বৃষ্টি এবং আকৃতি বিকৃত হওয়া সংঘটিত হবে । [কানযুল উম্মাল : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৪৭]
৪. মদ পানের কারণে মদ্যপায়ী ব্যক্তি সর্বপ্রকার গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। কেননা, এ হচ্ছে সমস্ত গুনাহের উৎস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- اجْتَنِبُوا الْخَمْرُ فَإِنَّهَا أُمُّ الْخَبَائِثِ . তোমরা সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য পরিহার করবে। কেননা, তা হচ্ছে সমস্ত পাপের উৎস। [কানযুল উম্মাল : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৪৮৬]
৫. মদ্যপায়ী ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন মহিলাদের জননেন্দ্রিয় থেকে নির্গত পূতিগন্ধময় পুঁজ পান করানো হবে।
৬. পাপীষ্ঠ ও গুনাহগার ব্যক্তি, যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী নয় সেই মদ পান করে থাকে।
৭. মূর্তি ও প্রতিমাপূজারীর ন্যায় মদখোর ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- شَارِبُ الْخَمْرِ كَعَابِدِ وَثَنٍ وَشَارِبِ الْخَمْرِ كَعَابِدِ اللاتِ وَالْعُزَّى
মদখোর ব্যক্তি প্রতিমাপূজারীর ন্যায় এবং মদখোর ব্যক্তি লাত ও উয্যা পূজারীর মত। [কানযুল উম্মাল : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৪৭] এই তুলনা হারাম হওয়ার দিক থেকে হতে পারে। এমনিভাবে শাস্তির দিক থেকেও হতে পারে।
৮. চরম পিপাসার্ত অবস্থায় মদখোর ব্যক্তি ময়দানে হাশরে উপস্থিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন مَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ أَتَى عَطْشَانَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – মদপানকারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন পিপাসার্ত অবস্থায় হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে। [কানযুল উম্মাল : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৪৭]
৯. মদখোর ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও তার নসীব হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- اللهُ عَلَيْهِمُ الْجَنَّةَ – مُدمِنُ الْخَمْرِ ثلَاثَةٌ قَدْ حرم وَالْعَاقِ وَالدَّيَوْتِ الَّذِي يَقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخُبُثَ তিন ব্যক্তির উপর আল্লাহ তাআলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। ১. মদখোর ব্যক্তি, ২. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, ৩. দায়ূস— যে তার পরিবারে যিনা জাতীয় পাপকর্ম জারী রাখে । [মিশকাত শরীফ : পৃ. ৩১৮]
১০. চল্লিশ দিন পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মদখোর ব্যক্তির নামায, রোযা, দুআ কোন কিছুই কবুল করেন না। ইরশাদ হয়েছে- لَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ رَجُلٌ مِّنْ أُمَّتِي فَيَقْبَلُ اللهُ مِنْهُ صَلَاةَ أَرْبَعِينَ يَوْمًا
আমার উম্মতের কোন ব্যক্তি মদ পান করলে তার চল্লিশ দিনের নামায আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। [কানযুল উম্মাল : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৫২]
১১. মদপানকারী ব্যক্তি লাঞ্ছনা ও হেয়তার উপযুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- لا تُسَلِّمُوا عَلَى شُرَبَةِ الْخَمْرِ – তোমরা মদখোর ব্যক্তিকে সালাম করবে না। [আল ফিক্হ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৪৫]
১২. মদখোর ব্যক্তি আল্লাহর ক্রোধানলে পতিত হয়। আর এ অবস্থায় মারা গেলে সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
১৩. মদখোর ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মারা গেলে এ নেশার কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং সে এর তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করবে।
১৪. মদপানকারী ব্যক্তির জন্য জাহান্নামে একটি নহর তৈরি করা হবে। তা পুঁজ, পিত্ত ইত্যাদি কষ্টদায়ক পূতিগন্ধময় বস্তুর দ্বারা ভরপুর থাকবে।
১৫. মদ্যপানকারী ব্যক্তি আল্লাহর দৃষ্টিতে মিসকীন এবং সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত । যেন সে দুনিয়ার মালিক হয়েও পরে বঞ্চিত হয়ে গেছে।
১৬. মদ্যপানের ফলে মানুষ যত পাগল হয় এবং পেটের রোগে আক্রান্ত হয় ততটা আর কিছুতে হয় না।
১৭. নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি মাতাল হয়ে আপনজনকেও হত্যা করে বসে অনেক সময়।
১৮. মদ্যপায়ী ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত সর্বহারা হয়ে যায়। ঘরের জরুরী মূল্যবান জিনিস, স্ত্রীর অলংকারাদি এবং মূল্যবান জিনিস পত্রও পানির দরে বিক্রি করে মদ ক্রয়ে বাধ্য হয়।
১৯. মদ পানের কারণে যে সব রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয় তা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। মদখোর পিতার রোগে পরবর্তী বংশধরও আক্রান্ত হয়ে থাকে।
২০. নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কেউ মারা গেলে কবরে সে নেশাগ্রস্ত থাকবে, কবর থেকে উঠবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এবং জাহান্নামে ঢুকবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়। অবশেষে জাহান্নামের মধ্যে এমন পাহাড়ে তাকে নিক্ষেপ করা হবে যাতে থাকবে পুঁজ ও পিত্ত ইত্যাদির নহর। ঐ নহর থেকে তাকে পানাহার করানো হবে। [আল ফিক্হ আলাল আযাহিবিল আরবা’আ : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৪৪-৪৫]
ফ্রান্সের জনৈক বিশিষ্ট পণ্ডিত হেনরী তার গ্রন্থ ‘খাওয়াতিরও মাওয়ানি ফির ইসলাম’-এ লিখেছেন, প্রাচ্যবাসীকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র এবং মুসলমানদেরকে খতম করার জন্য এই মদ ছিল অব্যর্থ তলোয়ার। আমরা আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু ইসলামী শরীয়ত আমাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের ব্যবহৃত অস্ত্রে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়নি। ফলে তাদের বংশ বেড়েই চলছে। এরাও যদি আমাদের এ উপঢৌকন গ্রহণ করে নিত, যেভাবে তাদের একটি বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী গ্রহণ করে নিয়েছে তাহলে ডক তারাও আমাদের কাছে পদানত ও অপদস্ত হয়ে যেত।
আজ যাদের ঘরে আমাদের সরবরাহকৃত মদের প্রবাহ বইছে; তারা আমাদের কাছে এতই নিকৃষ্ট ও পদদলিত হয়ে গেছে যে, তারা তাদের মাথাটি পর্যন্ত তুলতে পারছে না। জনৈক বৃটিশ আইনজ্ঞ ব্যান্টম লিখেছেন, ইসলামী শরীয়তের অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এও একটি বৈশিষ্ট্য যে, এতে মদ পান নিষিদ্ধ। আমরা দেখেছি আফ্রিকার লোকেরা যখন এর ব্যবহার শুরু করে তখন থেকেই তাদের মধ্যে উন্মাদনা সংক্রামিত হতে থাকে। আর ইউরোপের লোকেরা যখনই এই বস্তুতে চুমুক দিতে শুরু করেছে তখনই তাদের জ্ঞানবুদ্ধির বিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। কাজেই আফ্রিকার লোকদের জন্য যেমন এর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন, তেমনি ইউরোপের লোকদের জন্যও এর কারণে কঠিন শাস্তি বিধান করা অপরিহার্য। [মা’আরিফুল কুরআন (সংক্ষিপ্ত) পৃ. ১১৬]