ইসলাম

মিথ্যা কথা পরিহার করার উপায়

মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া গর্হিত অপরাধ। মিথ্যাবাদীর পক্ষে যেকোনো ধরনের অপরাধ করা সম্ভব। কেননা সে খুব সহজে তা অস্বীকার করতে পারে। ইসলামে মিথ্যা বলা হারাম। এমনকি অনুমানভিত্তিক কথা বলারও অনুমতি ইসলামে নেই।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পেছনে পড়ে থেকো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয়—এসবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘(অনুমানভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক।’ (সুরা জারিয়াত: ১০)

মিথ্যুক আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। মুবাহালাসংক্রান্ত আয়াতে এসেছে, ‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহর কাছে) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত পতিত হোক।’ (সুরা আলে ইমরান: ৬১)

মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কাছে মিথ্যুক হিসেবে পরিগণিত হয়। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত হয়।’ (মুসলিম: ২৬০৭)

কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু বদভ্যাস বাদ দিলে মিথ্যা থেকে বাঁচা সম্ভব। যেমন—

১) কোনো কথা যাচাইবিহীন প্রচার না করা

মানুষের মধ্যে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা আছে যে, অন্যের কাছ থেকে শোনা বিষয় যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রচার করা। অথচ এটি মিথ্যাবাদী হওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা মানুষের কাছ থেকে শোনা কথা সত্য নাও হতে পারে। তাই মিথ্যা থেকে বাঁচতে হলে শোনা কথা যাচাই না করে প্রচার করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কোনো লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (যাচাই না করে) তাই বলে বেড়ায়’। (সহিহ মুসলিম: ৫)

২) মন্দ ধারণা না করা

কোনো বিষয়ে সঠিক কিছু না জেনে শুধু ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে কথা ও কাজের কারণে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক পরিবারে ও সংসারে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। তাই মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। নিশ্চয়ই

কিছু কিছু ধারণা পাপ।’ (সুরা হুজরাত: ১২)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা সবচেয়ে বড় মিথ্যা।’ (সহিহ বুখারি: ৬০৬৪)

৩) মিথ্যাবাদীকে নেতা হিসাবে গ্রহণ না করা

মিথ্যাবাদীকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করলে তার প্রভাব অনুসারীদের উপর পড়বে। ফলে অনুসারীরাও মিথ্যায় অভ্যস্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কাজেই আপনি মিথ্যাবাদীদের অনুসরণ করবেন না।’ (সুরা আল কলম: ৮)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা মুনাফিককে নেতা হিসাবে গ্রহণ কর না। কেননা মুনাফিক যদি নেতা হয়, তাহলে তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে অসন্তুষ্ট করলে।’ (আবু দাউদ: ৪৯৭৭; মেশকাত: ৪৭৮০)

৪) ওয়াদা পালন করা ও আমানত রক্ষা করা

ওয়াদা রক্ষা করা ও আমানত পূর্ণ করা মিথ্যা থেকে বাঁচার অন্যতম মাধ্যম। এর দ্বারা মানুষ ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে বাঁচতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘..তোমরা ওয়াদা পূর্ণ করো। কেননা ওয়াদা সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩৪)

৫) শিশুকে ধোঁকা না দেওয়া

পিতা-মাতা বা অন্য কেউ শিশুদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো কিছু দেওয়ার আশ্বাস দিলে অবশ্যই তাকে তা দিতে হবে। অন্যথা সে মিথ্যুকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিশোর সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনু আমির (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের বাড়িতে বসা ছিলেন, এমতাবস্থায় আমার মা আমাকে ডেকে বললেন, এসো তোমাকে একটি জিনিস দেব। রাসুলুল্লাহ বললেন, তুমি তাকে কী দিতে চাও? মা বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দিতে চাই। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘তুমি যদি তাকে কিছু না দিতে তবে তোমার নামে একটি মিথ্যার গুনাহ লেখা হত।’ (আবু দাউদ: ৪/২৯৮)

৬) অধিক ওয়াদা করা হতে বিরত থাকা

শপথ বা ওয়াদা করা জায়েজ। তবে ওয়াদা পালন না করা মুনাফিকের আলামত। তাই অধিক পরিমাণে ওয়াদা করার অভ্যাস পরিহার করা উচিত। তাহলে মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে অধিক শপথ করে, যে লাঞ্ছিত, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কালাম: ১০)

৭) ঠাট্টা ও কৌতুক বর্জন করা

ইসলামি শরিয়তে নির্দোষ কৌতুক নিষিদ্ধ নয়। রাসুলুল্লাহ (স.) সত্য কথা ও বাস্তব বিষয় নিয়ে কৌতুক ও রসিকতা করেছেন। কিন্তু মিথ্যা, ঘৃণ্য বা তিরস্কারমূলক ঠাট্টা ও কৌতুক হারাম। অনেকে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা হাস্যকর কথা বলে থাকে। মিথ্যা থেকে দূরে থাকতে ওগুলো সর্বোতভাবে বর্জন করা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সেই লোক ধ্বংস হোক! যে মানুষকে হাসানোর উদ্দেশ্যে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে। সেই লোক নিপাত যাক, সেই লোক নিপাত যাক!’ (তিরমিজি: ২৩১৫)

৮) স্বল্পভাষী হওয়া

মিথ্যা থেকে বাঁচার অন্যতম পথ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় কথা ত্যাগ করা। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে; নচেৎ চুপ থাকে।’ (বুখারি: ৬০১৮; মুসলিম: ১৮২)

অনিয়ন্ত্রিত লাগামহীন কথাবার্তা ঝগড়াঝাটিরও মূল কারণ। তাই যত কম কথা বলা যায় ততই কল্যাণকর। ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, যে নীরবতা অবলম্বন করে সে মুক্তি পায়। (তিরমিজি: ২৪৮৫)

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, মিথ্যাই সব অধঃপতন, অশান্তির মূল। ইহকাল ও পরকালে মিথ্যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। জাতির উত্তরণের জন্য সর্বস্তরে সততা ও সত্যবাদিতার চর্চা হওয়া জরুরি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সত্যবাদিতা অবলম্বন করার এবং মিথ্যা থেকে নিজেকে হেফাজত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *