হিংসার দ্বিতীয় চিকিৎসা
এই হিংসা ব্যাধির আরেকটি কার্যকরী চিকিৎসা আছে। সেটা হচ্ছে এই যে, হিংসাকারী এটা চিন্তা করবে, যার ব্যাপারে আমি হিংসা করছি যে, তার থেকে ঐ নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হোক। কিন্তু ব্যাপার সব সময় বিপরীত টাই ঘটে। ফলশ্রুতিতে যার ব্যাপারে হিংসা করা হয়, তার তো উপকার অবশ্যই হয়। দুনিয়াতেও,আখেরাতেও।
পক্ষান্তরে হিংসুক ব্যক্তির শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি। যার ব্যাপারে হিংসা করা হয়, তার দুনিয়ার ফায়েদা এই যে, যখন তুমি দুনিয়াতে তাকে শত্রু বানিয়ে নিয়েছ তো মূলনীতি এটাই যে, শত্রুর কামনা এটাই থাকে যে, আমার শত্রু সব সময় দুঃখ-কষ্টে নিপতিত থাকুক। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি হিংসা করবে, দুঃখ কষ্টে লিপ্ত থাকবে। আর এটা ভেবে সে খুশী হতে থাকবে যে, তুমি দুঃখ কষ্টে পতিত আছ ৷
এটা তো হল তার দুনিয়াবী ফায়েদা। আর আখেরাতের ফায়েদা হচ্ছে এই যে, তুমি তার সাথে যত হিংসা করবে, ততটুকুই তার আমলনামা নেকীর মধ্যে সংযুক্ত হবে। আর যেহেতু সে মাযলূম এজন্য আখেরাতে তার দারাজাত বুলন্দ হবে। আর হিংসার অনিবার্য পরিণতি এই যে, এই হিংসা মানুষকে পরনিন্দা, দোষচর্চা, চোগলখুরী এবং অসংখ্য গুনাহে উদ্ধুদ্ধ করে। যার ফলে খোদ হিংসুক ব্যক্তির নেকীগুলো ঐ মাযলূমের আমলনামায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। কেননা যখন তুমি তার গীবত করবে এবং তার জন্য বদ দু’আ করবে, তখন তোমার নেকীগুলো তার আমলনামায় চলে যাবে। যার মানে হল তুমি যতটুকু হিংসা কর, ততটুকুই স্বীয় নেকীসমূহের প্যাকেট প্রস্তুত করে তার কাছে প্রেরণ করছ। যদ্দরূন তার উপকার হচ্ছে। এখন এই হিংসুক যদি সারাজীবন হিংসা করে, তবে তার সমস্ত নেকী বরবাদ হয়ে যাবে। আর ঐ মাযলূমের আমলনামা সমৃদ্ধ হবে।
এক বুযুর্গের ঘটনা
কিতাবের মধ্যে জনৈক বুযুর্গের ঘটনা লেখা হয়েছে যে, একবার এক ব্যক্তি ঐ বুযুর্গের কাছে এসে বলল যে, হযরত! অমুক মানুষ আপনার সমালোচনা করে। এটা শুনে ঐ বুযুর্গ নীরব হয়ে গেলেন। কোন উত্তর দিলেন না। যখন মজলিস খতম হল, তখন তিনি নিজ বাসায় চলে আসলেন এবং যে লোকটি তাঁর সমালোচনা করছিল তার জন্য বিশাল বড় একটি হাদিয়া প্রস্তুত করে তার বাসায় পাঠিয়ে দিলেন । লোকেরা বলল, হযরত! সে তো আপনার সমালোচনা করে অথচ তার কাছেই কিনা আপনি হাদিয়া পাঠালেন? বুযুর্গ বললেন: আরে সে তো আমার উপর অনুগ্রহকারী। কেননা সে আমার দোষচর্চা করে আমার নেকী বাড়িয়ে দিয়েছে। কাজেই সে তো আমার উপর অনুগ্রহ করেছে। এজন্য আমি তার অনুগ্রহের সামান্য বদলা দিতে চেয়েছি। যেহেতু সে আমার আখেরাতের নেকীসমূহ বাড়িয়ে দিয়েছে, আমি চাইলাম কমপক্ষে দুনিয়াতেই তাকে সামান্য হাদিয়া দিয়ে দেই।
ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর গীবত হতে সতর্কতা
আর এটা একটা প্রসিদ্ধ কথা যে, হযরত ইমাম আবূ হানীফা হরহ. এর মজলিসে কোন ব্যক্তি কারো গীবত করতে পারত না। কেননা তিনি না তো কারো গীবত করতেন আর না কারো গীবত শুনতেন।তাঁর মজলিস সব সময় গীবতমুক্ত হত। একদিন ইমাম আবূ হানীফা রহ. নিজ শিষ্যদের মজলিসে গীবত ও হিংসার ক্ষতি বর্ণনা করেন এবং তাঁদেরকে এটা বুঝানোর জন্য যে,গীবতের দ্বারা নেকীসমূহ নষ্ট হয়ে যায়। বলছিলেন যে, এ গীবত এমনই এক জিনিস যা গীবতকারীর নেকীসমূহকে ঐ ব্যক্তির দিকে স্থানান্তরিত করে দেয় যার গীবত করা হয়েছে। এ জন্য আমি কখনো গীবত করিনা। কিন্তু আমার অন্তরে যদি কখনো এই খেয়াল আসে যে, আমি কারো গীবত করব, তো ঐ সময় আমি আমার মা-বাবার গীবত করব। কেননা যদি গীবতের পরিণামে আমার নেকীসমূহ নষ্ট হয়ে যায়, তো মা বাবার আমল নামায় যাবে। কিন্তু ঘরের জিনিস ঘরে থাকবে। বাইরের কারো কাছে যাবে না।
তো হযরত ইমামে আযম রহ. এদিকে ইঙ্গিত করে দিলেন যে,এই গীবত ও হিংসাকারী নিজের অন্তরে তো অন্যের ক্ষতি কামনা করছে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সে তার দুনিয়া ও আখেরাত উভয়জগতের উপকার পৌঁছাচ্ছে এবং নিজেই নিজের সর্বনাশ করছে।এজন্য এই গীবত ও হিংসা কতইনা নির্বুদ্ধিতা মূলক কাজ
ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর আরেকটি ঘটনা
হযরত সুফিয়ান ছাওরী রহ. হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহ. এরসমকালীন বিখ্যাত বুযুর্গ। উভয়ে একই যুগের মানুষ। আর উভয়েরইস্ব স্ব হালকায়ে দরস ছিল।একদিন হযরত সুফিয়ান ছাওরী রহ. এর নিকট কেউ একজন জিজ্ঞেস করল যে, ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর ব্যাপারে আপনার কী অভিমত? উত্তরে হযরত সুফিয়ান ছাওরী রহ. বললেন, তিনি খুব কৃপণ মানুষ । তখন ঐ ব্যক্তি বলল যে, আমরা তো তাঁর ব্যাপারে শুনেছি যে,তিনি অত্যন্ত দানশীল মানুষ। হযরত সুফিয়ান ছাওরী রহ. বললেন,তিনি এতই কৃপণ যে, নিজের নেকী কাউকে দেয়ার জন্য প্রস্তুত নন ।অথচ অন্যের নেকীসমূহ তিনি খুব নিতে থাকেন। সেটা এভাবে যে,মানুষ তাঁর খুব গীবত করতে থাকে এবং তাঁর বদনাম করতে থাকে ।যদ্দরূন মানুষের নেকীসমূহ তাঁর আমলনামায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়।আর তিনি ব্যক্তিগতভাবে কারো গীবত করেন না এবং শুনেন না।এজন্য স্বীয় নেকীসমূহ কাউকে দেয়ার জন্য প্রস্তুত নন। এ কারণেই আখেরাত এর দৃষ্টিকোণে তাঁর থেকে অধিক কৃপণ মানুষ আর কেউনেই ৷ বাস্তব কথা হল, যার সাথে হিংসা করা হয় অথবা যার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হয় অথবা যার গীবত করা হয় সত্য কথা হল হিংসুক এবং গীবতকারী নিজ নেকীসমূহের প্যাকেট বানিয়ে বানিয়ে ঐ ব্যক্তির কাছে প্রেরণ করছে আর নিজেই রিক্তহস্ত হয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃত নিঃস্ব ব্যক্তি কে?
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম রাযি. কে উদ্দেশ্য করে বললেন: আচ্ছা বলতো নিঃস্ব কোন্ ব্যক্তি? সাহাবায়ে কিরাম রাযি. আরয করলেন,নিঃস্ব তো হল ঐ ব্যক্তি যার কাছে টাকা-পয়সা নেই। প্রিয়নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, এ লোক প্রকৃত নিঃস্ব নয়। বরং প্রকৃত নিঃস্ব হল ঐ ব্যক্তি যে স্বীয় আমলনামায় প্রচুর নেকী,অসংখ্য নামায ও রোযা, অনেক যিকির আযকার ও তাসবীহাত নিয়ে দুনিয়া হতে বিদায় নিবে। কিন্তু যখন কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর নিকট হিসাব কিতাবের জন্য হাযির হবে, তখন সেখানে মানুষের ভীড় লেগে যাবে। একজন বলবে: এই লোক আমার ঐ হক নষ্ট করেছিল।আরেকজন বলবে: সে আমাকে অমুক পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে। এভাবে তৃতীয়জন, চতুর্থজন। এখন আখেরাতের কারেন্সী এই নোট তো আর হবে না যে,সেগুলো দিয়ে হক পুরো করে দিবে। সেখানের কারেন্সী হল নেকীসমূহ।তাইতো আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিবেন যে, ঐসব মানুষের হকসমূহের বদলায় এ লোকের নেকীগুলো দিয়ে দেয়া হোক। এখন কেউ তার নামায নিয়ে চলে যাবে, কেউ নিয়ে যাবে রোযা,কেউ নিয়ে যাবে তার যিকর আযকার । এভাবে তার সমস্ত নেকী খতমহয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের হক পুরা হবে না। ফলশ্রুতিতে মহানআল্লাহ বলবেন: যখন তার নেকীসমূহ শেষ হয়ে গেছে, তো হকওয়ালাবা পাওনাদারদের গুনাহগুলো তার আমলনামায় দিয়ে তাদের হকসমূহআদায় করো।পরিণতি হল এটাই যে, যখন সে এসেছিল, তখন তার আমলনামানেকীর দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। আর যখন ফেরত যাচ্ছে, তখন শুধুএতটুকু নয় যে, হাতখালী বরং গুনাহের বোঝা নিজের সাথে নিয়েযাচ্ছে। এই লোকটাই হল প্রকৃত নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত ব্যক্তি।
যাইহোক, হিংসার দ্বারা এভাবে নেকীসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়।যদি আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে কাউকে আয়নার মত স্বচ্ছ একটি অন্তর দান করেন, যার মধ্যে না আছে হিংসা, না আছে বিদ্বেষ,বা কারো প্রতি গীবত। তো এমতাবস্থায় যদি তার আমলনামায় অনেক বেশি নফল এবং অনেক বেশি যিকর-আযকার ও তাসবীহ-তাহলীল নাও থাকে কিন্তু তার অন্তরটা আয়নার মত পরিস্কার হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা এত বেশি বাড়িয়ে দেন যার কোন সীমা পরিসীমা নেই ৷ জান্নাতের সুসংবাদ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযি.বলেন: একবার আমরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে মসজিদে নববীতে বসা ছিলাম। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বললেন, এখন যে ব্যক্তি মসজিদের ঐপাশ দিয়ে প্রবেশ করবে সে জান্নাতী। আমরা ঐদিকে দৃষ্টিপাত করলাম। তো কিছুক্ষণপর এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে এমনভাবে প্রবেশ করলেন যে, তার চেহারা হতে উযূর পানি টপকাচ্ছিল। আর তিনি বাম হাতে জুতা বহন করছিলেন। তাঁর ব্যাপারে আমাদের দারুণ ঈর্ষা হল । যেহেতু প্রিয় নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রাযি. বলেন, যখন মজলিস খতম হল, তখন আমার অন্তরে খেয়াল আসল যে, আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখব যে, তাঁর কোন্ আমলটি এমন যেটার ভিত্তিতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত গুরুত্বের সাথেতাঁর জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ শুনিয়েছেন।ফলশ্রুতিতে যখন তিনি নিজ বাসায় যেতে উদ্যত হলেন, তখন আমিও তাঁর পিছে পিছে চলতে লাগলাম আর রাস্তায় তাঁকে বললাম যে, আমি দুই তিন দিন আপনার বাসায় থাকার অনুমতি চাই। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। আমি তাঁর ঘরে চলে গেলাম। যখন রাত হল এবং তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন, তখন আমি সারারাত বিছানায় শুয়ে জেগে থাকলাম। ঘুমালাম না, এটা দেখার জন্য যে, রাত্রে তিনি ঘুমথেকে উঠে কী আমল করেন? কিন্তু সারা রাত পার হয়ে গেল । তিনি ঘুম ছেড়ে উঠলেনই না। পড়ে পড়ে ঘুমালেন। তাহাজ্জুদের নামায ও পড়লেন না। ফজরের সময় উঠলেন। এরপর দিনেও আমি তাঁর কাছে কাটালাম। তো দেখলাম যে, পুরো দিনেও তিনি বিশেষ কোন আমল করেননি। না নফল, না যিকর আযকার, না তাসবীহ, না তিলাওয়াত ।ব্যস যখন নামাযের সময় হত, তখন মসজিদে গিয়ে নামায পড়েনিতেন। যখন দুই তিনদিন আমি সেখানে থেকে দেখে নিলাম যে,ইনিতো বিশেষ কোন আমলই করেন না। শুধু ফরয ওয়াজিবগুলো যথাযথভাবে আদায় করেন আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। তখন তিনি বললেন যে, যদি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার জন্য এ সুসংবাদ দিয়ে থাকেন তবে সেটা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমার দ্বারা তো কোন আমল হয় না। আর আমি নফল নামাযও বেশি পড়তে পারিনা। কিন্তু একটা কথা। সেটা হল আমার অন্তরে কারো ব্যাপারে কোন হিংসা বা বিদ্বেষ নেই। সম্ভবত একারণে মহান আল্লাহ আমাকে এ সুসংবাদের লক্ষ্যস্থল বানিয়েছেন।কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, এ মহা সৌভাগ্যবান মানুষটি ছিলেন হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযি.। যিনি আশারায়ে মুবাশশারাহ তথা পৃথিবীর বুকেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মধ্যে একজন।২৬৬. শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৬১৮৩তার উপকার, আমার ক্ষতি২৭যাই হোক, আপনি দেখলেন যে, এসব আমলের মধ্যে খুব বেশিনফল, যিকর-আযকার কিন্তু নেই। কিন্তু অন্তর হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত।দিল আয়নার মত স্বচ্ছ। তো হিংসার দ্বিতীয় চিকিৎসা হল এই যে,মানুষ এটা চিন্তা করবে যে, আমি যার সাথে হিংসা করছি, এই হিংসার
ফলে তার তো উপকার হবে, কিন্তু আমার তো ক্ষতি। এভাবে চিন্তা করলেও এ ব্যাধি হ্রাস পায় ৷
বই : হিংসা ও গোস্বা: দুটি ধ্বংসাত্বক ব্যাধি