রমজানের আদবসমূহ
ইখলাস অবলম্বন করা
কোন কাজে ইখলাস অবলম্বন করার অর্থ হল কাজটা করার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও জাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন।(সূরা আল-বাইয়েনা:৫)
আর সিয়াম পালনে এখলাসের বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘যে রমজান মাসে ঈমান ও এখালাসের সাথে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।‘ বোখারি(৩৮)ও মুসলিম(৭৬০)
সাহরি খাওয়া :
সিয়াম পালনের জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরিতে বরকত রয়েছে। বোখারি:(১৯২৩) ও মুসলিম:১০৯৫
তবে সেহরি না খেয়ে সিয়াম পালন করলে ও সিয়াম আদায় হয়ে যাবে। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন’মোমিনের উত্তম সেহরি হল খেজুর। (আবু দাউদ :২৩৪৫)
তিনি আরো বলেন : ‘সেহরি হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সেহরি করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও ফেরেস্তাগণ সেহরিতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন।‘ (মুসনাদে আহমদ:১১০০৩)
চোখকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা
আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরের ৩০-৩১ নং আয়াতে পুরুষ ও নারী উভয়কে তাদের দৃষ্টি সংযত রাখার আদেশ দিয়েছেন।
(হে নবী) আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। … আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে।” এ আয়াতটি সরাসরি দৃষ্টি সংযত রাখার সাথে সম্পর্কিত।
যেকোনো ধরনের বড় পাপে বান্দার নিমজ্জিত হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে দৃষ্টি। পথেঘাটে হাটবাজারে বিপণী-বিতানে বেগানা নর-নারীর ওপর ভুলক্রমে আমাদের দৃষ্টি নিপতিত হতেই পারে। পরক্ষণে সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি অবনমিত করতে হবে। ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিকে সেখানে প্রলম্বিত করা যাবে না।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলী (রা.) রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন, উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন : ‘হে আলী, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি পড়ে গেলে পুনরায় তুমি দৃষ্টি দিও না। কেননা প্রথম দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য কিন্তু পুনরায় দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়।’ (তিরমিজি: ২৭৭৭)
তাই চোখকে সর্বদা গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে,অপাতে দৃষ্টিপাত করা যাবে না।
জবানকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা:
একজন উত্তম মুসলিমের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার হাত ও জবান (মুখ) থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে তিনিই হলেন প্রকৃত মুসলিম। (বুখারি-০৯)।
সূরা কফ এর ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ইমান এনেছে, সে যেন উত্তম বা ভালো কথা বলে বা চুপ থাকে। (মুসলিম-৪৭)।
এজন্য জবানকে গিবত, শেকায়েত, অপবাদ, ঝগড়া-ফাসাদ, গানবাদ্য, মিথ্যা কথাসহ সব ধরনের পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।
কানকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা:
দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো কান। কানের মাধ্যমে আমরা শুনতে পাই, অপরের কথা বুঝতে পারি। মানুষের বোধ ও উপলব্ধির মাপকাঠি এ কান। এটি পঞ্চেন্দ্রিয়ের অন্যতম একটি অঙ্গ।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বলো, তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণশক্তি ও অন্তঃকরণ। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা মুলক, আয়াত : ২৩)
আল্লাহ তাআলা এ নিয়ামতের কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, ‘বলো, আসমান ও জমিন থেকে কে তোমাদের রিজিক দেন? অথবা কে তোমাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিগুলোর মালিক?’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৩১)
কিয়ামতের দিন কান সম্পর্কে মানুষ আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই চোখ-কান ও আত্মা এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬)
রাসুল (সা.) হাদিসে বারবার এই অঙ্গের গুনাহ সম্পর্কে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা চোখ ও কানের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো।’
বর্তমান সমাজে এই অঙ্গের মাধ্যমে অসংখ্য গুনাহ হয়ে থাকে। গান-বাজনা এবং গিবত শ্রবণ এর অন্যতম। তাই আমাদের এসব গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে।
শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা:
শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা অর্থাৎ হাত, পা, অন্তর, পেট, লজ্জাস্থানসহ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। সূরা আনআমের ১২০ নম্বর আয়াতে আছে,
তোমরা প্রকাশ্য ও গুপ্ত উভয় প্রকার পাপ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই যারা পাপ কামাই করে, তাদেরকে শীঘ্রই সেই সমস্ত অপরাধের শাস্তি দেওয়া হবে, যাতে তারা লিপ্ত হয়।
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীতে আছে, প্রকাশ্য গুনাহ হল সেইগুলো যা মানুষ তার বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা করে, যেমন মিথ্যা বলা, গীবত করা, ধোঁকা দেওয়া, ঘুষ খাওয়া, মদ পান করা, ব্যভিচার করা ইত্যাদি। আর গোপন গুনাহ হল সেইগুলি যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, রিয়া, অহংকার, অন্যের অনিষ্ট কামনা ইত্যাদি।
ইফতারির সময় হালাল সম্পদ থেকে পরিমিত আহার করা:
ইফতারির সময় হালাল সম্পদ থেকে পরিমিত আহার করা।
আল্লাহ তায়ালা সূরা মুমিনুনের ৫১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন হে রসূলগণ, পবিত্র বস্তু হতে আহার করুন এবং সৎকাজ করুন আপনারা যা করেন সে বিষয়ে আমি পরিজ্ঞাত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধুলামলিন। সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার প্রভু, হে আমার প্রতিপালক, অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এ অবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৮৯)
অথচ ‘দোয়া’ মহান আল্লাহর পছন্দনীয় ইবাদতগুলোর একটি। বোঝা গেল হারাম ভক্ষণ মানুষের নেক আমলকে প্রভাবিত করে। মানুষের জন্য জাহান্নামকে অবধারিত করে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী। ’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১৭২৩, তিরমিজি, হাদিস : ৬১৪)
তাই সাহরি ও ইফতারে হারাম উপার্জনের সম্পদ থেকে ভক্ষণ করাও রোজার মহিমা ক্ষুণ্নকারী কাজ। অতএব রোজাদারের উচিত, মহান আল্লাহর এই প্রিয় ইবাদতটি যেন কলুষমুক্ত হয়, সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া।
ইফতারিতে বিলম্ব না করা
সূর্যের গোলক সম্পূর্ণ অদৃশ্য হলেই ইফতারের সময় হয়ে যায়। আর ইফতারের সময় হলে বিলম্ব না করে দ্রুত ইফতার করাটা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি অহেতুক বিলম্ব করে অথবা অন্ধকার হওয়ার অপেক্ষা করে অথবা আরও অধিক সওয়াব লাভের উদ্দেশে পানাহার বর্জনের সময়কাল বাড়ানোর জন্য ইফতারকে বিলম্বিত করে তবে সে গোনাহগার হবে।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দ্বীন ততদিন পর্যন্ত ঠিক থাকবে, যতদিন পর্যন্ত মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কেননা, ইহুদি-খ্রিস্টানরা বিলম্বে ইফতার করে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৩৫৫)
মানুষ কল্যাণের ওপর থাকবে যতক্ষণ তারা দ্রুত ইফতার করবে।(সহীহ বুখারী: ১৯৫৭)
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের নামাজ পড়ার আগে পাকা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি পাকা খেজুর না থাকতো তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর যদি তা-ও না থাকতো তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করতেন।’(সুনানে আবু দাউদ: ২৩৫৮)
ইফতারের পূর্বের সময়টা অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ এক সময়। এটা দোয়া কবুলের মোবারক সময়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে ও নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া।(ইবনে মাজাহ: ১৭৫২)
তাই ইফতারের বেশ আগে থেকেই ইফতারি নিয়ে বসে দোয়া-মোনাজাতে মশগুল থাকা দরকার। ইফতারির আয়োজনে ব্যস্ত থেকে অনেকেই এ মোবারক সময়ের দোয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেন।