ইবাদত

ইতিকাফ

ইতিকাফের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য, স্থান

ইতিকাফ কাকে বলে?

ইতিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা, কোন বস্তুর ওপর স্থায়িভাবে থাকা। ইতিকাফের মধ্যে নিজের সত্তাকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয় এবং নিজেকে মসজিদ হতে বের হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফের নিয়তে পুরুষের ঐ মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা হয় অথবা কোন মহিলার নিজ ঘরে নামাযের স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয় ।

ইতিকাফের উদ্দেশ্য

ইতিকাফের উদ্দেশ্য জানা যায় হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রা. বর্ণিত বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস থেকে। তিনি বর্ণনা করেন : “রাসূলুল্লাহ সা. রমযানের প্রথম দশকে ইতিকাফ করলেন । তারপর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করলেন। তারপর তিনি তুর্কী তাঁবুর ভিতরে অবস্থান করেছিলেন তা থেকে মাথা বের করে বললেন; “আমি এ রাতটি অর্থাৎ শবে কদরের সন্ধানে প্রথম দশক ইতিকাফ করলাম, তারপর মাঝের দশকও ইতিকাফ করলাম, তারপর জনৈক আগন্তুক (ফেরেশতা) মারেফতে আমাকে বলা হলো, রাতটি শেষ দশকে নিহিত রয়েছে; সুতরাং আমার সাথে যারা ইতিকাফ করেছে তাদের শেষ দশকে ইতিকাফ করা উচিত। (ফাজায়েলে রমযান, উর্দু- ৫২) এ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শবে কদরের মাহাত্ম্য রাতটি পাওয়াই ইতিকাফের উদ্দেশ্য। কেননা ইতিকাফকারী সাধারণত ইবাদত- বন্দেগীর মাধ্যমেই রাত কাটিয়ে থাকেন। সুতরাং শেষ দশকের যে রাতেই শবে কদর হোক ইতিকাফকারী তার মহাপুণ্য থেকে বঞ্চিত থাকার কোনই কারণ নেই ।

ইতিকাফের স্থান

যে মসজিদে নিয়মিতভাবে আযান, ইকামত সহকারে জামাতের সাথে নামায আদায় হয় সেই মসজিদেই ইতিকাফ করা সহীহ হবে।

ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপর মসজিদে আকসা।

এরপর ঐ জুমু’আর মসজিদ যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা হয়। এরপর সে মসজিদে যেখানে মুসল্লীর সংখ্যা অধিক হয়ে থাকে (শামী)।
ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইতিকাফ সহীহ্ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় (হিদায়া)। ইমাম জালালুদ্দীন যায়লাঈ রহ. ‘কেফায়া’ গ্রন্থে হিদায়া কিতাবে উল্লিখিত কথাটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. এর বক্তব্যে জুমু’আর মসজিদ ব্যতীত অন্য মসজিদের কথা বুঝাতে চেয়েছেন। কারণ যেখানে জুমা’আর নামায আদায় করা হয় সেখানে অবশ্যই ইতিকাফ সহীহ্ হয় (ফাতহুল কাদীর)। মহিলাগণ নিজ ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় ইতিকাফ করবেন। নামাযের জন্য জায়গা নির্ধারিত না থাকলে ইতিকাফে বসার সময় তা নির্ধারিত করে নিলেও সহীহ্ হবে। মসজিদে ইতিকাফ করা তাদের জন্য মাকরূহ।(শামী)

মান্নতের ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত। সুতরাং মান্নতের ইতিকাফ কমপক্ষে একদিন করতে হবে। কেননা একদিনের কম সময়ের রোযা সহীহ হয় না। এ ছাড়া রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। নফল ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত কোন সময় নেই এবং এর জন্য রোযা রাখাও শর্ত নয়। এ ইতিকাফ অল্প কিছুক্ষণের জন্যও হতে পারে; এমনকি মসজিদে না বসে মসজিদ অতিক্রম করার সময়েও নফল ইতিকাফের নিয়ত করলে তা সহীহ্ হবে। (তাহতাবী)

তথ্যসূত্রঃ রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি।

হাদীসের আলোকে ইতিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা

ইতিকাফের ফজিলত

হযরত আয়েশা রা. বলেন, রমযানের শেষ দশদিন নবীজি সা. ইতিকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত তিনি এই আমল করে গেছেন। তারপর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেন। (বুখারী- ১/২৭১)

হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, নবীজি সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তাআলা তার মধ্যে এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (মু’জামুল আওসাত- ৫/২৭৯) <strong>ফায়দা</strong> : সুবহানাল্লাহ! এক দিনের ইতিকাফের এই ফজিলত! তাহলে রমযানের শেষ দশ দিনের ইতিকাফের ফজিলত কত বেশী হবে? সৌভাগ্যবান তারা যারা রমযানের বরকতময় মুহুর্তগুলো ইতিকাফে কাটায় এবং উল্লেখিত ফজিলতের হকদার হয়। হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন,ইতিকাফকারী গুনাহ হতে মুক্ত থাকে। আর তার সকল নেকীগুলো সেভাবে লেখা হয়, যেভাবে সে অন্যান্য দিন কাটিয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ- ১২৮) <strong>ফায়দা</strong> : এই হাদীসে ইতিকাফের দুটি ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে- ১. ইতিকাফকারী যতদিন ইতিকাফ করবে, ততদিন গুনাহ হতে বেঁচে থাকবে । ২. যে সব নেককাজ সে বাইরে করত, যেমন রুগীর শুশ্রূষা করা, জানাযায় শরীক হওয়া, দরিদ্রের সাহায্য করা, আলেমদের মজলিসে বসা ইত্যাদি। ইতিকাফে থাকার ফলে এগুলো করতে না পারলেও সে এসবের সাওয়াব পেতে থাকবে ।

ইতিকাফের উপকারীতা

রাসূল সা. রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমাযানের ২১তম রাত এল (অর্থাৎ যে রাত গিয়ে সকালে তিনি ইতিকাফ থেকে বের হবেন) তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকেও ইতিকাফ করে । কারণ আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে, তা শেষ দশকের অমুক রাত) এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা শবে কদর শেষ দশকে খোঁজ কর এবং তা প্রতি বেজোড় রাতে তালাশ কর । (সহীহ বুখারী, হাদীস- ২০২৭)

ইতিকাফকারীর অবসর সময়ে কোন আমল না করলেও তার দিন- রাত মসজিদে অবস্থান করাটাই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।

ইতিকাফের বদৌলতে অনেক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। পাপাচারের সয়লাব থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তাআলার ঘর একটি মজবুত দূর্গ।

ইতিকাফকারী নিজেকে দুনিয়ার নানাবিধ ঝামেলা থেকে মুক্ত করে পুরোপুরী আল্লাহ তাআলার কাছে সমর্পণ করে। রোযার দরুন পুরোদিন পানাহার ও যৌনকর্ম বর্জন করার কারণে ফেরেশতাদের সঙ্গে তার সামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হয়। তার ইতিকাফ দ্বারা ২৪ঘণ্টা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়, ফলে ফেরেশতাসূলভ গুণাবলী শক্তিশালী হয়।

রোযার যাবতীয় আদব ও হক যথাযথ আদায়ের ক্ষেত্রে ইতিকাফের ভূমিকা অপরিসীম।

তথ্যসূত্রঃ রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি।

ইতিকাফের মাসায়েল

মাসআলাঃ রমযানের শেষ তৃতীয়াংশের এতেকাফ সুন্নতে মুআক্কাদা আলাল কেফায়া অর্থাৎ মহল্লার (সমাজ বা পাড়ার) কিছু সংখ্যক লোক ই’তেকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে এতেকাফ আদায় হয়ে যাবে। নচেৎ সকলেই গুনাহগার হবে। (শামী-৩/৪৯৫)

মাসআলা : এক সমাজের লোক যদি স্বেচ্ছায় অন্য সমাজের মসজিদে এতেকাফ আদায় করে তাহলে উক্ত সমাজের পক্ষ থেকে ই’তেকাফ আদায় হয়ে যাবে। তবে সমাজবাসীদের কর্তব্য হচ্ছে নিজেরাই এতেকাফ করবে যেন তারা সওয়াব হতে বঞ্চিত না হয় । (মাহমুদিয়া ১০/ ২৩০, শামী-৩/৪৯৫)

মাসআলা : বর্তমানে কোন কোন সমাজে প্রচলন রয়েছে যে, এলাকাবাসী নিজেরা ইতেকাফ না করে কোন গরিব ব্যক্তিকে টাকা পয়সা ইত্যাদির বিনিময়ে ই’তেকাফে বসায়। যা সম্পূর্ণ শরীয়ত পরিপন্থী।এর দ্বারা এলাকা বাসীর পক্ষ থেকে ই’তেকাফ আদায় হবেনা। কেননা ই’তেকাফ একটি ইবাদত আর এ জাতীয় ইবাদতের জন্য বিনিময় দেয়া-নেয়া উভয়টাই নাজায়েয । (শামী-৬/৫৫)

মাসআলা : যদি কোন সমাজে একাধিক মসজিদ থাকে তাহলে প্রত্যেক মসজিদে ই’তেকাফ করা উত্তম। বিশেষভাবে জুমআ মসজিদে । (শামী ৩/৪৯৩, আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫০৮, মাহমুদিয়া ১০/২২১)

মাসআলা : ই’তেকাফ অবস্থায় মসজিদে পত্রিকা পড়া, খবর শুনা, দেখা এতেকাফের উদ্দেশ্যের বিপরীত এবং মসজিদের সম্মান ও পবিত্রতার পরিপন্থী হওয়াতে নাজায়েয। এ ছাড়াও বর্তমানে পত্রপত্রিকাগুলো ছবিতে ভরপুর যা আল্লাহ পাকের লা’নতের কারণ। সুতরাং তা পবিত্রস্থানে রাখা ও পড়া আদৌ উচিত নয়। তদ্রূপ অনেক সময় খবর গুলো ও মহিলা কণ্ঠে পরিবেশন করা হয়, যা মসজিদে ই’তেকাফে বসে শ্রবণ করা অত্যন্ত ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য। আল্লাহপাক আমাদেরকে সকল প্রকার অযথা ও অশ্বীলতা থেকে হেফাজত করুন। (শামী ৩/৫০৩, হুকানিয়া ৪/২০৮)

মাসআলা ঃ ই’তেকাফ অবস্থায় বিশেষ প্রয়োজনে জরুরী কথা-বার্তা বলা জায়েয । (শামী ৩/৫০৩, হক্কানিয়া ৪/২০৮)

মাসআলাঃ শুধু নাবালেগ বুঝদার ছেলে ই’তেকাফ করার দ্বারা এলাকাবাসী এতেকাফের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবে না। (শামী ৩/৪৯৩, বাদায়ে ২/১০৮)

মাসআলা : নির্দিষ্ট ‘ই’তেকাফকারী মুয়াজ্জিন’ ছাড়া অন্য কোন ই’তেকাফকারী আযান দেওয়ার উদ্দেশ্যে মসজিদের বাইরে গেলেও তার ইতেকাফ নষ্ট হবে না। (শামী ৩/৫০২)

মাসআলাঃ ই’তেকাফ অবস্থায় যদি মসজিদে খানা পৌঁছানোর লোক না থাকে তাহলে ইতেকাফকারী খানার জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে। আর খানা নিয়ে সাথে সাথে মসজিদে ফিরে আসতে হবে এবং খানা মসজিদে খাবে, বাইরে নয়। (শামী ২/৪৪৯, কিফায়াতুল মুফতি-8/208)

মাসআলাঃ ই’তেকাফকারী যদি তবয়ী (সৃষ্টিগত স্বভাব) বা শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোন প্রয়োজনে যথা: মায়্যিতের গোসলদেয়া, জানাযার নামায পড়া, ডুবন্ত বা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে এমন কাউকে উদ্ধারের জন্য মসজিদের বাইরে যায় তাহলে তার ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। তবে সে গুনাহগার হবে না। বরং এমন সময় বাইরে যাওয়া জরুরী। আর পরক্ষণে মাত্র একদিনের ই’তেকাফ কাযা করে নিবে । (রহীমিয়া-৭/২৮২, তাহতাবী-৪০৮ মাসায়েলে ইতেকাফ-৪১, শামী-২/৪৪৭)

ইতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হওয়া

মাসআলাঃ এতেকাফকারীদের জন্য সর্বদাই মসজিদের ভিতরে থাকা অতি জরুরী। শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ছাড়া সামান্য সময়ের জন্যও মসজিদের থেকে বের হওয়া যাবে না।কেননা এতেকাফকারী শরয়ী কোন কারণ ছাড়া বাইরে গেলে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (শামী ৩/৪৯২, আহকামে এতেকাফ ৪)<br><br>বি.দ্র. যে সকল মসজিদে ইমাম মুয়াজ্জিন ও জামাতের সময় নির্দিষ্ট রয়েছে, ফুকাহায়ে কেরামগণ এধরণের মসজিদে ২য় জামাত করাকে মাকরূহ বলেছেন। তাই ২য় জামাতের জন্য মসজিদের ঘরের বাইরে কোন স্থান নির্দিষ্ট করা হলে ইতেকাফকারী ঐ স্থানে যেতে পারবেনা ।

মাসআলাঃ ই’তেকাফকারী শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ছাড়া ভুলে মসজিদ থেকে বের হলে ই’তেকাফ ভেঙ্গে যাবে। তবে পরবর্তী সময়ে এক দিনের কাযা আদায় করতে হবে।(শামী ৩/৫০৩)

মাসআলাঃ শরীয়ত নিদের্শিত জরুরতের উদ্দেশ্যে এতেকাফকারী বাহিরে যাওয়ার পর রাস্তায় কাউকে সালাম করা বা সালামের জাওয়াব দেওয়া অথবা রাস্তায় কোন রোগীর সাথে কুশল বিনিময় করা জায়েয। তবে এগুলোর জন্য দাঁড়াতে পারবে না। দাঁড়ালে এতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫০৯, আহকামে এতেকাফ -১১)

মাসআলাঃ এস্তেঞ্জাখানায় ভিড় হলে হাজত পূরণার্থে কিছু সময় অপেক্ষা করা জায়েয। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫১১)

মাসআলাঃ এতেকাফকারী শরীয়তসম্মত প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। যথা:-<br>১. ফরয ও সুন্নত গোসলের জন্য ।<br>২. ফরয ও নফল অযুর জন্য বের হওয়া যদি মসজিদের ভিতরে গোসল ও অযু করার কোন ব্যবস্থা না থাকে।<br>৩. মোয়াজ্জিন আযান দেওয়ার জন্য বের হওয়া যদি মসজিদের ভিতরে আযান দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকে।<br>৪. পাঞ্জেগানা মসজিদে এতেকাফকারী জুমআর নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়া।<br>৫. মসজিদের কোন সমস্যার কারণে অন্য মসজিদে স্থানান্তরিত হওয়া ।<br>৬. প্রস্রাব পায়খানার জন্য বের হওয়া।<br>৭. জরুরী কোন জিনিস বাহির থেকে আনার জন্য বের হওয়া। যদি বিকল্প ব্যবস্থা না থাকে । (শামী ৩৫০১, ৫০২, ৫০৩, আন মুতাফ-১০৫)

তথ্যসূত্রঃ রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি। ও রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল।

ইতিকাফ অবস্থায় অযু, গোসল,জুমআ, জানাযায় অংশগ্রহণ ইত্যাদির বিধান

ইতেকাফ অবস্থায় অযু

এতেকাফকারী ফরয ও নফল অযুর জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে যদি মসজিদের ভিতরে কোন ব্যবস্থা না থাকে। (আহকামে এতেকাফ-১৪) মাসআলা ঃ এতেকাফকারী শরীয়তসম্মত প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে গেলে বিলম্ব না করে মেসওয়াক, মাজন বা টুথপেস্ট ব্যবহার করতে পারবে। তবে অযুর পরে বাইরে অপেক্ষা করা বা রাস্তায় সামান্য সময়ের জন্য যাওয়া জায়েয হবে না।

উল্লেখ্য যে, রোযা অবস্থায় মাজন বা টুথপেষ্ট ব্যবহার করা মাকরূহ। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫১০, আহকামে এতেকাফ-১৪)

ইতেকাফ অবস্থায় গোসল

ইতেকাফকারীদের জন্য ফরয ও সুন্নত তথা জুমজার গোসলের জন্য বাইরে যাওয়া জায়েয। এছাড়া ঠান্ডা বা প্রশান্তি অর্জনের প্রয়োজন হলে কোন ভিজা তোয়ালে বা গামছা ইত্যাদি দিয়ে মসজিদের ভিতরে নিজের শরীর মুছে নিবে। তবে প্রশান্তির অর্জনের উদ্দেশ্যে গোসল করার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। (শামী ৫/৩৫১, আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৮)

ইতেকাফ অবস্থায় আযান

কোন মুয়াজ্জিন যদি এতেকাফে বসে এবং আযান দেয়ার জন্য তাকে মসজিদের বাইরে যেতে হয় তাহলে যেতে পারবে। তবে আযান শেষ করার পর বাইরে অবস্থান করতে পারবে না। (শামী ৩/৫০২)

ইতেকাফ অবস্থায় জুমআ

জামে মসজিদে এতেকাফ করা উত্তম। পাঞ্জেগানা মসজিদে এতেকাফ করা জায়েয।

পাঞ্জেগানা মসিজদে ইতিকাফকারী ব্যক্তি জুমার নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজ মসজিদ থেকে বের হয়ে নিকটবর্তী জুমার মসজিদে গিয়ে জুমার নামায আদায় করতে পারবে। ইতিকাফকারী ব্যক্তি জুমার মসজিদে গিয়ে ফরজের পূর্ববর্তী সুন্নাত, খুতবা, জুমার ফরজ আদায় এবং জুমার ফরজের পরবর্তী ছয় রাকাত সুন্নাত আদায় করা পরিমাণ সময় পর্যন্ত জুমার মসজিদে অবস্থান করতে পারবে। উপরোক্ত উদ্দেশ্যে জুমার মসজিদ নিকটবর্তী হলে যাওয়ালের পরে এবং দূরবর্তী হলে এতটুকু সময় পূর্বে নিজ মসজিদ থেকে বের হবে যেন ফরজের পূর্ববর্তী সুন্নাত আদায় করা যায় এবং খুতবা শোনা যায়।

পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফকারী ব্যক্তি যদি জুমার মসজিদে নামায আদায় করতে গিয়ে নামায আদায়ের পরেও সেখানে অবস্থান করে তবে তাতে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। এমনকি যদি ঐ জুমার মসজিদে একদিন একরাত অবস্থান করে অথবা ঐ জুমার মসজিদে অবস্থান করেই ইতিকাফ পূর্ণ করে তাতেও ইতিকাফ ফাসিদ হবে না। তবে প্রয়োজন ব্যতীত এরূপ করা মাকরূহে তানযীহি। (আলমগীরী ও শামী)

ইতিকাফকারীর জানাযায় অংশ গ্রহণ

ইতিকাফকারী ব্যক্তি রোগী দেখতে অথবা জানাযার সালাত আদায় করার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না। তবে নফল ইতিকাফকারী রোগী দেখার উদ্দেশ্যে অথবা জানাযার সালাতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বেরহতে পারবে।

যদি কোন ইতিকাফকারী ব্যক্তি কোন বৈধ কাজ যেমন- মানবীয় প্রয়োজন অথবা জুমার সালাতের জন্য বের হওয়ার পর পথে কোন রোগী দেখে নেয় অথবা উপস্থিত জানাযার সালাত আদায় করে নেয় তবে তা জায়েয। (শামী) কেউ যদি ইতিকাফের মান্নত করার সময় এ নিয়ত করে যে, সে ইতিকাফ অবস্থায় রোগী দেখতে যাবে, জানাযার সালাত আদায় করতে যাবে এবং ইলমী মজলিসে উপস্থিত হবে তবে তার জন্য ইতিকাফ অবস্থায় এ কাজ সমূহের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয। (শামী ও আলমগীরী)

তথ্যসূত্রঃ
১ঃ রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল
২ঃ রোজা রাখি বেহেশত অর্জন করি।

ইতিকাফের শর্ত, রোকন, ইতিকাফ ভঙ্গ হওয়ার কারণ ইত্যাদি

ইতিকাফের রোকন বা মূল ভিত্তি

ইতিকাফের প্রধান রোকন হল, ইতিকাফকারী সর্বদাই মসজিদের সীমানার ভেতরে থাকবে । অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া একটু সময়ের জন্যও মসজিদের বাইরে যাবেনা। ইতিকাফকারী যদি শরয়ী কারণ ছাড়া কিছু সময়ের জন্যও বাইরে যায়, তাহলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. ইতিকাফে বসলে মানবীয় ‘প্রয়োজন’ (প্রাকৃতিক প্রয়োজন) ছাড়া ঘরে আসতেন না । (সহীহ বুখারী, হাদীস-২০২৯)

উল্লেখ্য : শরীয়তের দৃষ্টিতে মসজিদ শুধু এতটুকু অংশকে বলা হয়, যতটুকু কে মসজিদ নির্মাতাগণ মসজিদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাই অযুখানা, গোসলখানা, ইস্তেঞ্জাখানা, জানাযার নামাযের জায়গা, ইমাম সাহেবের কক্ষ ইত্যাদি কোনোটিই মসজিদের অংশ নয়। ইতিকাফকারীর জন্য শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া এসব স্থানে (অর্থাৎ যা মসজিদ নয়) যাওয়া জায়েয নয়। শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া এসব জায়গায় সামান্য সময় অতিবাহিত করলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। মসজিদের সিঁড়ি যা অতিক্রম করে মুসল্লিগণ মসজিদে প্রবেশ করেন, তাও সাধারণত মসজিদের বাহিরের অংশ হিসেবে গণ্য হয়। এ জন্য ইতিকাফকারী শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া সিঁড়িতে যেতে পারবেনা। তবে যদি সিঁড়ি এমন জায়গায় বানানো হয়, যা মসজিদের অন্তর্ভুক্ত বলেই বিবেচিত হয়, যেমন দোতলায় যাওয়ার জন্য মসজিদের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি বানানো হল, তাহলে সেখানে যেতে অসুবিধা নেই । কোনো কোনো মসজিদে চট, চাটাই ইত্যাদি আসবাবপত্র রাখার জন্য আলাদা রুম বানানো হয়ে থাকে। যদি প্রতিষ্ঠাতাগণ বলেন যে, এটা মসজিদ এবং সেখানে মুসল্লিরা নামাযও পড়ে, তাহলে মসজিদের হুকুমে হবে এবং ইতিকাফকারী সেখানে প্রবেশও করতে পারবে। অন্যথায় মসজিদের হুকুমে আসবেনা। ইতিকাফকারী মসজিদের মেহরাবে যেতে পারবে। কেননা সকল মসজিদের মেহরাব মসজিদের অন্তর্ভুক্ত এবং মসজিদের অংশ হয়ে থাকে।

উপরের আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, মসজিদের সিমানা নির্ধারণ করা কতটুকু প্রয়োজন । ইতিকাফকারীর জন্য ইতিকাফে বসার আগে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেওয়া উচিত। শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া সামান্য সময়ের জন্য মসজিদের সীমানার বাইরে থাকলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যাবে। তাই খুব সাবধান থাকা জরুরী।

ইতিকাফের শর্তাবলী

নিয়ত করা । নিয়ত করা ব্যতীত ইতিকাফ করলে ইতিকাফ সহীহ হবে না।

পুরুষের জন্য এ রকম মসজিদ হতে হবে, যেখানে জামাতের সাথে পাঁচওয়াক্ত নামায আদায় করা হয়। (তবে নফল ইতিকাফ যে কোন মসজিদেই হতে পারে) মহিলাগণ নিজেদের ঘরের সালাত আদায়ের স্থানে ইতিকাফ করবে । তারা প্রয়োজন ব্যতীত এ স্থান থেকে বের হবে না।

রোযা রাখা। তবে নফল ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত নয়।

মুসলমান হওয়া। কেননা কোন অমুসিলম ব্যক্তি ইবাদতের যোগ্যতা রাখে না।

আকেল- জ্ঞানবান হওয়া। প্রাপ্তবয়স্ক বা বালিগ হওয়া ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত নয়। এজন্য জ্ঞানবান অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকার ইতিকাফও সহীহ হয়, যেমনিভাবে তাদের নামায ও রোযা দুরস্ত হয়।

নারী- পুরুষ সকলের জানাবত বা গোসল ফরজ হয় এমন অপবিত্রতা থেকে এবং নারীদের হায়িয ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া। (আলমগীরী)

তথ্যসূত্রঃ
রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি।

মহিলাদের ইতিকাফ

ফজিলত

ইতেকাফের ফজিলত শুধু পুরুষদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় বরং মহিলারাও এর দ্বারা উপকৃত হতে পারবে কেননা হাদীস শরীফে মহিলাদের ই’তেকাফের বিষয়ে অনেক গুরুত্ব এসেছে এবং মহিলা সাহাবীগণ (রা.) যে এতেকাফে বসেছেন এরও অনেক প্রমাণ রয়েছে।

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।(বুখারি: ২০২৬; মুসলিম: ১১৭২)

কিন্তু বর্তমান সমাজের অনেক মহিলা উক্ত সওয়াবের কাজ থেকে বঞ্চিত। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেও ইতেকাফের সওয়াব অর্জন করার তৌফিক দান করুক। আমিনঃ

মাসায়েল

মাসআলাঃ মহিলারা পবিত্রাবস্থায় রমযানের শেষ তৃতীয়াংশের সুন্নত ইতেকাফ আদায় করবে এমন স্থানে যেখানে তারা নামায আদায় করে অথবা অন্য কোন স্থানকে নির্দিষ্ট করে নিবে। উক্ত নির্দিষ্ট স্থান ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ছাড়া চলে গেলে এতেকাফ ভেঙ্গে যাবে যেমনিভাবে পুরুষদের মসজিদ থেকে বের হলে এতেকাফ ভেঙ্গে যায়। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে,ইতেকাফ অবস্থায় যেন তারা স্বামী-স্ত্রী সূলভ আচার-আচরণ থেকে বেঁচে থাকে। (শামী ৩/৪৯৪, হিন্দিয়া ১/২১১)

মাসআলাঃ নারীদের সুন্নত ইতিকাফে বসার আগেই হায়েজ নেফাসের দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশ করে বসাই উচিত। যাতে ইতিকাফ শুরু করার পর হায়েজ শুরু হয়ে না যায়। তবে কারও যদি রমজানের শেষ দশকে হায়েজ হওয়ার নিয়ম থাকে তা হলে তিনি হায়েজ শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতিকাফ করতে পারেন। হায়েজ শুরু হওয়ার আগেই ওষুধ খেয়ে হায়েজ বন্ধ রেখে রোজা রাখলে এবং ইতিকাফ করলে সহিহ হবে।

মাসআলাঃ বিবাহিতা নারীরা স্বামীর অনুমতিক্রমে ইতেকাফে বসবে। তবে ইতেকাফে বসার পর স্বামী যদি বাধা দেয় তাহলে এক্ষেত্রে স্বামীর হুকুম পালন করা জরুরী নয়। (শামী ৩/৪৯৪, হিন্দিয়া ১/২১১)

মাসআলাঃ ইতেকাফ অবস্থায় মহিলার হায়েজ বা নেফাস এসে গেলে তার ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে এতে শুধু ঐ দিনের কাযা আদায় করতে হবে। (শামী ৩/৪৯৫, হিন্দিয়া ১/২১১, তাতার খানিয়া ২/১৩৫)

মাসআলাঃ অনেক স্থানে দেখা যায় মহিলারা ইতেকাফ অবস্থায় সেলাই ইত্যাদির কাজ করে থাকে শরীয়তে যদিও বিনিময় ছাড়া সেলাই এর অনুমতি রয়েছে তারপরও ইতেকাফ অবস্থায় এধরনের কাজে ব্যস্ত হওয়া একেবারেই অনুচিত। বরং সর্বদাই জিকির, ফিকির, তেলাওয়াত ইত্যাদির মধ্যে মগ্ন থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।(আহকামে এতেকাফ পৃ: ২৪)

মাসআলাঃ যদি এলাকাবাসী থেকে শুধু মহিলারা ইতেকাফ করে তাহলে পুরুষদের পক্ষ থেকে ইতেকাফ আদায় হবে না। বরং পুরুষদের জন্য ইতেকাফ করা অত্যাবশ্যক। (মাহমুদিয়া ১০/২৮৭)

মাসআলাঃ নারীরা ইতিকাফ অবস্থায় ঘরের নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বের হতে পারবেন। ওজুর জন্যও বাইরে যেতে পারবেন। খাবার পৌঁছে দেওয়ার লোক না থাকলে খাবার আনার জন্য বাইরে যেতে পারবেন। বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮২, হেদায়া ১/ ২৩০; ফাতাওয়া শামি ৩/৪৩৫।<br>পানাহার ইতিকাফের জায়গায় করতে হবে। বাইরে করা যাবে না। হেদায়া ১/২৩০।

মাসআলাঃ যেসব নারীর ছোট বাচ্চা আছে এবং তাদের লালন-পালনের জন্য অন্য কেউ নেই, তার জন্য ইতিকাফে বসার চেয়ে তাদের লালন-পালন, আদব শিক্ষা দেওয়া ইত্যাদিতে সময় ব্যয় করা উচিত। কেননা ইতিকাফে বসার দ্বারা এ ধরনের বাচ্চাদের লালন-পালনে ত্রুটি তৈরি হবে। যে নারীর স্বামী অসুস্থ তার সেবা করতে হয়, ওই নারীর জন্য ইতিকাফ করার চেয়ে স্বামীর সেবা করাই উত্তম। এমনকি ইতিকাফের নিয়ত করলে ইতিকাফের সওয়াব ও পাবে। জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া ১/৩৫।

তথ্যসূত্রঃ রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল। ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *