যাকাতের নিসাব ও সম্পদের হিসাব
মুফতি ইসমাঈল সিদ্দিক
যাকাত ইসলামের ফরজ বিধান। যদি কেউ যাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে, সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। আর ফরজ স্বীকার করে তা আদায় না করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী তা আদায় না করার ঘোষণা দিলে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে হলেও তা আদায়ে বাধ্য করা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য।
স্বর্ণের ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব, ২০ মিসকাল। (সুনানে আবু দাউদ ১/২২১) আধুনিক হিসাবে সাড়ে সাত ভরি। রুপার ক্ষেত্রে, ২০০ দিরহাম। (বুখারি, ১৪৪৭) আধুনিক হিসাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা। এই পরিমাণ সোনা-রুপা থাকলে যাকাত দিতে হবে। প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা বা বাণিজ্যদ্রব্যের মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হয়, তাহলে যাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়েছে ধরা হবে এবং এর যাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৯৯৩৭)
উল্লেখ্য, বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। (আদ্দুররুল মুখতার ২/৩০২)
এবার আমরা দেখব কী কী জিনিসের ওপর যাকাত ফরজ হয়: ১. সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর যাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকাপয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরজ হয়। ২. হিরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতে যাকাত ফরজ হয় না। ( মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক ৭০৬১-৭০৬৪) ৩. মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার যাকাত আদায় করা ফরজ হয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, ৭০৯১) তদ্রূপ ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকাপয়সার মতোই। এসবের ওপরও যাকাত ফরজ হয়। ৪. টাকাপয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরজ হয়। (আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৭) ৫. হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে, তাও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে এবং নিসাবের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত ফরজ হবে। বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা যদি খরচ হয়ে যায়, তাহলে যাকাত ফরজ হবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৩২) ৬. দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যদ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ ১/২১৮) ৭. ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন—জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর যেমন—মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি বাণিজ্যদ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরজ হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, ৭১০৩ )
কারো ঋণ যদি এত হয়, যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকে, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরজ নয়। (মুয়াত্তা মালেক ১০৭) কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, এই প্রসিদ্ধ মাসআলাটি সব ঋণের ক্ষেত্রে নয়। ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। (ক) প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়। প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব বাকি থাকে কি না, তার হিসাব করতে হবে। নিসাব থাকলে যাকাত ফরজ হবে, অন্যথায় নয়। কিন্তু যেসব ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয়, যেমন—কারখানা বানানো, কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে যাকাতের হিসাবের সময় সেই ঋণ ধর্তব্য হবে না। অর্থাত্, এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস ৭০৮৭)।
স্বামী যদি স্ত্রীর অনাদায়কৃত মহর চলতি বছরই আদায়ের ইচ্ছা করে, কেবল সে ক্ষেত্রে তা ঋণ ধর্তব্য করে যাকাতযোগ্য সম্পদের সমষ্টি থেকে বিয়োগ দেওয়া যাবে। (ফাতওয়া হিন্দিয়া: ১/১৭৩) উল্লেখ্য, বিনা ওজরে মোহরানা আদায়ে বিলম্ব করা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এছাড়া অন্যকে যে টাকা কর্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে বা ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করেছে, এই পাওনা টাকা পৃথকভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে মিলিতভাবে নিসাব পূর্ণ করলে তারও যাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, ৭১১১) পাওনা উসুল হওয়ার পর ঐ টাকার যাকাত আদায় করা ফরজ হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ১০৩৪৭)
স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও তা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে যাকাত ফরজ হয় না। হস্তগত হওয়ার পর যদি আগে থেকেই ঐ নারীর কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ না থাকে, তাহলে এখন থেকে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।