গীবত কি?
মাওলানা আবদুল হাই লাখনাবী (র)
কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষত্রুটি বর্ণনা করা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়, তাকে শরীআতের পরিভাষায় গীবত বলে, তা বাচনিক অথবা লেখনীর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে অথবা অন্য কোন পন্থায়ই বর্ণনা করা হোক না কেন, সে ব্যক্তি মুসলমান হোক অথবা অমুসলিম। যদি এমন দোষ বর্ণনা করা হয়, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে নেই তবে তা মিথ্যা অপবাদ হিসাবে গণ্য হবে, কুরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় বুহতান।
এই প্রসঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের কতিপয় বাণী উল্লেখ করা হলো :
১. কোন প্রয়োজনে একটি বেঁটে স্ত্রীলোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে। সে চলে যাওয়ার পর আয়েশা (রা) তার দৈহিক কাঠামো বেঁটে হওয়ার ত্রুটি বর্ণনা করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : হে আয়েশা! তুমি ঐ স্ত্রীলোটির গীবত করলে। তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি বাস্তব ঘটনার বিপরীত কিছু বলিনি, অবশ্য আমি তার বেঁটে হওয়ার কথা বলেছি এবং এই ত্রুটি তার মধ্যে রয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আয়েশা! যদিও তুমি সত্য কথা বলেছ কিন্তু তুমি তার ত্রুটি বর্ণনা করায় তা গীবত হয়ে গেল (ফকীহ আবুল লাইস, বাবুল গীবত)।
২. তাবিঈ ইবরাহীম (র) বলেন : اذا قُلْتَ فِي الرَّجُلِ مَا فِيهِ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ قُلْتَ مَا لَيْسَ فِيهِ فَـ “কারো প্রকৃত দোষ বর্ণনা করলে তুমি তার গীবত করলে। তোমার বর্ণিত দোষ তার মধ্যে না থাকলে তুমি তাকে অপবাদ দিলে।” (ইমাম মুহাম্মাদের কিতাবুল আছার)।
৩. একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন, গীবত কাকে বলে তা কি তোমরা জানো? সাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন, আমাদের জানা নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ذكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ “তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সমালোচনা করা হলো গীবত, যা শুনলে সে অপছন্দ করবে।” সাহাবাগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি সেই দোষ তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবুও কি তা গীবত হবে? তিনি বলেন : তুমি যদি কারো সত্যিকার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো তবেই তো তার গীবত করলে। আর তুমি যা বললে তা যদি বাস্তবিকই তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করলে (ইমাম বাগাবীর মাআলিমুত তানযীল)।
৪. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আখাকা’ (তোমার ভাই) শব্দের ব্যবহার করে ইশারা করেছেন যে, তুমি যার গীবত করছো সে তোমার নিকটাত্মীয় না হলেও মূলত তোমার ভাই।
একদা মহানবী (স) বলেন ঃ “গীবত এই যে, তুমি অপর ব্যক্তির এমন দোষত্রুটি বর্ণনা করছো যা প্রকৃতই তার মধ্যে রয়েছে।” সাহাবাগণ বলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা তো মনে করতাম যে, কারো মধ্যে যে দোষ নাই তার সাথে সেই দোষ সংশ্লিষ্ট করে বর্ণনা করাই হচ্ছে গীবত। তিনি বলেন ঃ এটা তো মিথ্যা অপবাদ (আব্দ ইবনে হুমাইদের সূত্রে সুয়ূতী আদ-দুররুল মানছুর গ্রন্থের বরাতে)।
বর্তমান কালে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সকলে পরচর্চায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে এবং শয়তানের আনুগত্য করে চলছে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামত গীবতের সংজ্ঞা দাঁড় করিয়ে নিয়েছে। মুসলমানগণ! আন্তরিকভাবে একটু চিন্তা করে দেখুন, কিভাবে আপনারা আবর্জনার পংকে নিমজ্জিত হচ্ছেন। কোন কোন লোক বলে যে, কারো এমন কোন দুর্নাম বর্ণনা করাকে গীবত বলা হয় যা তার সামনে বলা সম্ভব নয়। অতএব সামনে বর্ণনা করা যায় এমন কোন দুর্নাম গাইলে তা গীবত হবে না। এই সংজ্ঞা মোটেই ঠিক নয়। এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির গীবত বর্ণনা করছিল। আমি (গ্রন্থকার) বাধা দিয়ে বললাম, কেন অন্যের দোষচর্চা করছো? সে বললো, আমি যা বলছি তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সামনেও বলতে পারি, এতে আমার কোন পরোয়া নাই, অতএব এটা গীবত হবে না।
উপরে যেসব হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে পরিস্কার জানা যায় যে, কারো সামনে বলার মত দোষ হোক অথবা সামনে বলার মত দোষ না হোক—উভয় প্রকার দোষের চর্চা করাই গীবত। কতক লোক বলে যে, কারো মধ্যে যে দোষ নাই তা তার প্রতি আরোপ করাকে গীবত বলে। কিন্তু কারো সত্যিকার দোষ বর্ণনা করলে তা গীবত হবে না।
উত্তর ঃ এইমাত্র হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, যে দোষ কোন ব্যক্তির মধ্যে নাই তা তার প্রতি আরোপ করা মিথ্যা অপবাদ হিসাবে গণ্য। অতএব উপরোক্ত কথা যারা বলে তারা প্রকারান্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপ করে ।
আবার কতক লোক বলে, যে দোষটি অন্যের জানা নেই সেই ধরনের দোষ বর্ণনা করাই গীবত। অতএব কারো এমন দোষ বর্ণনা করা গীবত হবে না যা সকলে জানে। এদের যদি বলা হয়, তুমি কেন গীবত করছো তখন জবাব দেয়, এটা তো গীবত নয়, কারণ যে দোষ আমরা বর্ণনা করছি তা তো গোপন নয়, সকলেই জানে। এমন তো নয় যে, আমরা বর্ণনা করার পরই লোকেরা তা জানতে পারে।
উত্তর ঃ এটা তাদের ভ্রান্ত ধারণা। কারণ দোষ প্রসিদ্ধ হোক বা গোপন—তা বর্ণনা করার সাথে সাথে গীবত হয়ে যায়। দোষ প্রসিদ্ধ না হলে বরং তার চর্চায় দ্বিবিধ পাপ হয়,একটি গীবতের পাপ এবং অপরটি দোষ প্রচার ও প্রকাশ করে বেড়ানোর পাপ। আর যে দোষ সকলের জানা আছে তার ক্ষেত্রে কেবল গীবত করার পাপ হয় ৷