ইসলাম

দৃষ্টি সংরক্ষণ: কুরআন হাদিস কি বলে?

দৃষ্টিসংরক্ষণ : পবিত্র কুরআন কী বলে?

এ সুবাদে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন- قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ ‘হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতা। তারা যা করে মহান আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।'(সূরা নূর : ৩০) পবিত্র কুরআনের আয়াতটি মুমিনদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। তাফসীর বিশারদগণ লিখেছেন, আয়াতটিতে রয়েছে শিষ্টাচার, সতর্কতা ও চ্যালেঞ্জের বিবরণ। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হল-

ক. আয়াতের প্রথমাংশে রয়েছে শিষ্টাচারের বিবরণ। অর্থাৎ যেসব বস্তু দেখা মুমিনদের জন্য অবৈধ, তা থেকে যেন দৃষ্টিকে অবনত রাখে। গোলামের কৃতিত্ব হল মনিবের আনুগত্য করা। আয়াতটিতে এ শিক্ষাও রয়েছে যে, দৃষ্টির হেফাজত প্রথম কাজ। লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সর্বশেষ কাজ। একটির জন্য অপরটি অপরিহার্য। সুতরাং দৃষ্টির লাগাম ধরতে না পারলে লজ্জাস্থানও অনিবার্যভাবে নিয়ন্ত্রণের গন্ডিতে রাখা যায় না৷

খ. ذلك ازكى لهم অর্থাৎ এতে রয়েছে তাদের জন্য পবিত্রতা। আয়াতের এ অংশে রয়েছে সতর্কতা। দৃষ্টির হেফাজতে রয়েছে অন্তরের পবিত্রতা। ফলে গুনাহের কুমন্ত্রণা অন্তরে ইতিউতি করে না। ইবাদতে মনোযোগ আসে। প্রবৃত্তিপনা, শয়তানিপনা, পাশবিকতাড়না ও কুমন্ত্রণা প্রভৃতি থেকে অন্তপ্রাণকে বাঁচানো যায়। পক্ষান্তরে কুদৃষ্টির কারণে অন্তরের প্রশান্তি চলে যায়। অব্যক্ত অনুশোচনার অব্যাহত ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ফেতনায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তীব্রতর হয়ে ওঠে।

. আয়াতের শেষাংশ ان الله خبير بما تصنعون “নিশ্চয় মহান আল্লাহ তাআলা তারা যা করে তা সম্পর্কে জানেন।’ এর মাঝে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। আল্লাহর পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে যে, বান্দা যদি উক্ত দিকনির্দেশনার তোয়াক্কা না করে তাহলে যেন মনে রাখে যে, মহান আল্লাহ অসচেতন নন। তিনি বান্দার প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে জানেন। অবাধ্যদেরকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়- তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন।

মনে রাখবেন, পুরুষদের মতই নারীদেরকেও সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারাও যেন দৃষ্টি সংযত রাখে। কারণ নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীরই সৃষ্টির উপকরণ অভিন্ন। সুতরাং যৌনতার প্রতি আকর্ষণ নারীপ্রকৃতিতেও রয়েছে। তাই আল্লাহ তাআলা নারী জাতির উদ্দেশে বলেছেন- وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ ‘হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করে।’ উক্ত আয়াতদ্বয়ের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এ বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণহীনতা বেহায়াপনার বিস্তৃতি ঘটায় এবং লজ্জাস্থানের শিহরণ তৈরি করে। এ জাতীয় প গারিস্থিতিতে মানুষের বিবেকের ওপর পর্দা পড়ে যায়। মানুষ তখন বিবেক বুদ্ধির দিক থেকে অন্ধ হয়ে যায়। গুনাহে জড়িয়ে পড়ে লাঞ্ছণার অতল সাগরে ডুব দিয়ে বসে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতই নারীদের অবস্থা হয়। বরং নারীরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। অল্পতেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে।

সুতরাং তাদের দৃষ্টি কোনোদিকে ঝুঁকে পড়লে ক্ষতির আশঙ্কা অধিক থাকে। সুতরাং তাদের দৃষ্টি অবনত রাখার গুরুত্বটা একটু বেশি। ইমাম গাযালী রহ. বলেন- ثُمَّ عَلَيْكَ وَفَّقَكَ اللهُ وَإِيَّانَا بِحِفْظِ الْعَيْنِ فَإِنَّهَا سَبَبُ كُلَّ فِتْنَةٍ وَافَةٍ

‘অতঃপর তুমি দৃষ্টির সংরক্ষণ অবশ্যই করবে। আল্লাহ তোমাকে এবং আমাকে তাওফিক দান করুন। কেননা, এটা প্রত্যেক ফেতনা ও আপদের কারণ।’ (মিনহাজুল আবিদীন, পৃষ্ঠা : ২৮) এর দ্বারা জানা গেল, চোখের ফেতনা নিদারুণ ভয়াবহ। সমূহ ফেতনার মূল উৎস এটি।

দৃষ্টি সংযত রাখা সম্পর্কে হাদীসে যা রয়েছে

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- غُضُّوا أَبْصَارَكُمْ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ ‘তোমরা দৃষ্টি অবনত রাখো এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত কর।'(আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা : ২০৪) হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. লিখেছেন, দৃষ্টি জৈবিকচাহিদার পিয়ন ও রাহবার হয়ে থাকে। দৃষ্টির সংরক্ষণ মূলতঃ লজ্জাস্থান ও যৌনচাহিদা পূরণের অবাধ সুযোগের সংরক্ষণ হয়ে থাকে। যে দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণ করতে দিয়েছে সে নিজেকে ধ্বংসের মাঝে ফেলে দিয়েছে। মানুষ যেসব আপদে নিমজ্জিত হয় এর মূলভিত্তি হল দৃষ্টি।'(আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা-২০৪)

. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- النَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ إِبْلِيْسَ ‘দৃষ্টি হল ইবলিসের বিষাক্ত তীরসমূহের অন্যতম।’ (প্রাগুক্ত)

৩. জনৈক মনীষী বলেছেন- النَّظْرُ سَهْمٌ سَمَّ إِلَى الْقَلْبِ ‘দৃষ্টি একটি তীর যা অন্তরে বিষ ঢেলে দেয়।’(ইবনুকাছীর, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ২৮৩)

. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- الْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ ‘চোখের ব্যভিচার হল দেখা।’ (মুসলিমশরীফ)

এসব হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়, যেব্যক্তি পরনারীর চেহারার প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকায় সে তার সঙ্গে মনে মনে ব্যাভিচারও করে ফেলে। পূর্বসূরী বুযুর্গানেদীন দৃষ্টিকে বলেছেন, ‘ভালোবাসার বাহক’ জুলাইখা ইউসুফ আলাইহিস সালামের চেহারার প্রতি না তাকালে নিজের জৈবিক কামনার কাছে এভাবে নেতিয়ে পড়ত না এবং গুনাহের প্রতি আহবানও করত না। ক্ষণিকের লাগামহীন আচরণের কারণে পবিত্র কুরআনে তার নাম লাঞ্ছণার সাথে আলোচিত হয়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত তার দিকে নির্লজ্জা কাজের জন্য ইঙ্গিত করা হবে। শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত, কত ভয়াবহ ও করুণ হয় কুদৃষ্টির লাঞ্ছণা।

দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যাওয়া ক্ষমাযোগ্য

অনেক সময় এমন হয়, পথে-ঘাটে আচমকাভাবে পরনারী সামনে এসে পড়ে। হঠাৎ তাদের চেহারার দিকে দৃষ্টি পড়ে যায়। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলী রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন- يَا عَلِيُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ. فَإِنَّ لَكَ الْأُوْلِى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةَ ‘হে আলী! আচমকা দৃষ্টি পড়ে গেলে তুমি পুনরায় দৃষ্টি দিওনা। কেননা, প্রথমদৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য এবং দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়।’ (মেশকাত শরীফ)

বোঝা গেল, একবার দৃষ্টি পড়ে গেলে তা ক্ষমাযোগ্য। তবে যদি প্রথমবারের দৃষ্টিপাতটাও স্বেচ্ছায় হয় তাহলে এটাও হারাম। প্রথমদৃষ্টিপাত বৈধ হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অপলক নয়নে গভীরভাবে একবার দেখা। কারণ এটাও হারাম। জারীর ইবনু আবদিল্লাহ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, যে দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যায় তার বিধান কী? তিনি বলেন-দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নাও।’ (মেশকাত শরীফ) অনেক সময় শরীয়তসম্মত কোনো অপারগতার কারণে বিচারক, ডাক্তার ও জজ পরনারীর চেহারা দেখতে হয়। এক্ষেত্রে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হবে।

তথ্যসূত্র: বই: কুদৃষ্টি

লিখক: আল্লামা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী (রহ:)

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
1
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *