সুদের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় সুদকে (ربا) ‘রিবা’ বলা হয়। এই শব্দের মূল ধাতু হল (ر ب و ) যার আভিধানিক অর্থ হল, বাড়া, বৃদ্ধি, আধিক্য, স্ফীতি প্রভৃতি। رَبَاঅর্থাৎ বেড়েছে বা বৃদ্ধি পেয়েছে। ربا السويق অর্থাৎ ছাতু ঘোলার পর ফেঁপে উঠেছে। ربا في حجره অর্থাৎ সে তার কোলে প্রতিপালিত (বড়) হয়েছে। أربى الشيء সে জিনিসটাকে বাড়িয়েছে ইত্যাদি অর্থ অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদেও উক্ত শব্দ ‘বৃদ্ধি’র অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: يَمْحَقُ اللهُ الرِّبا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ অর্থাৎ, আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাহকে বৃদ্ধি দেন।
শরীয়তের ফিক্হবিদ্দের পরিভাষায় সুদের সংজ্ঞা হল,
هو زيادة أحد البدلين المتجانسين من غير أن يقابل هذه الزيادة عوض.
অর্থাৎ, একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের পরস্পর আদান-প্রদান করার সময় একজনের অপরজনের নিকট এমন বেশী নেওয়া যাতে এ বেশী অংশের বিনিময়ে কোন জিনিস থাকে না। (আল বুনূকুল ইসলামিয়্যাহ বাইনান নাযারিয়্যাতি অত্তাত্ববীক্ব ৪৪ পৃঃ)
ফতোয়া আলামগীরীতে সুদের নিম্নরূপ সংজ্ঞা করা হয়েছে,
الربا عبارة عن فضل مال لا يقابله عوض في معاوضة ما بمال.
অর্থাৎ, এক মালের বদলে অন্য মালের আদান-প্রদানকালে সেই অতিরিক্ত (নেওয়া) মালকে সূদ বলা হয়; যার কোন বিনিমেয় থাকে না।
হেদায়াতে সুদের সংজ্ঞা এইভাবে করা হয়েছে;
الربا هو الفض المستحق لأحد المتعاقدين في المعاوضة الخالي من عوض شرط فيه
অর্থাৎ, লেন-দেন করার সময় সেই অতিরিক্ত মালকে সুদ বলা হয়; যা কোন একপক্ষ শর্ত অনুসারে কোন বিনিময় ছাড়াই লাভ করে থাকে।
উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহ থেকে বুঝা গেল যে,মূল থেকে যে পরিমাণ অংশ বেশী নেওয়া বা দেওয়া হবে সেটাকেই সুদ বলা হবে। সুতরাং সুদের সংজ্ঞা হল এইরূপ; ‘‘ঋণে দেওয়া মূল অর্থের চেয়ে সময়ের বিনিময়ে যে অতিরিক্ত অর্থ নির্দিষ্টরূপে নেওয়া হয় তার নাম হল সুদ।’’
মূল অর্থ থেকে কিছু বৃদ্ধি, সময়ের দৈর্ঘ্য অনুসারে বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ধারণ এবং এই লেন-দেনে বৃদ্ধি শর্ত হওয়া—এই তিন উপাদানে গঠিত বস্তুর নাম সুদ হবে। আর প্রত্যেক সেই ঋণের আদান-প্রদান যার মধ্যে উক্ত তিন প্রকার উপাদান পাওয়া যাবে তাকে সুদী আদান-প্রদান বা কারবার বলা হবে। এখানে দেখার বিষয় এ নয় যে, সে ঋণ ব্যবসার জন্য নেওয়া হয়েছে অথবা ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। এবং সেই ঋণ-গ্রহীতা ব্যক্তি গরীব নাকি ধনী, কোম্পানী নাকি সরকার। সে যাই হোক না কেন অনুরূপ ঋণের কারবার সুদের কারবার।
ইসলামী শরীয়া অনুসারে রিবা (সুদ) দুই প্রকার।
◾১. ربا النسيئة রিবা আল-নাসিয়া:
আরবি ‘নাসি‘আহ’ শব্দের অর্থ মেয়াদ বা অবকাশ, স্থগিত বা বিলম্ব, পরিশোধে বিলম্ব, পরিশোধের জন্য প্রদত্ত সময়, বাকি, ধার ইত্যাদি। কাজেই ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’ অর্থ মেয়াদি ঋণের সুদ। পরিভাষায় ঋণের ওপর চুক্তির শর্ত অনুসারে শরি‘আহ্সম্মত কোনো বিনিময় ছাড়া যে অতিরিক্ত অর্থ বা মাল আদায় করা হয় তাকে ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’ বা মেয়াদি ঋণের সুদ বলা হয়।
চুক্তির শর্ত অনুসারে ঋণের আসলের অতিরিক্ত যাই নেয়া হোক না কেন তাই হচ্ছে রিবা আন-নাসি‘আহ। এই অতিরিক্ত হতে পারে কোনো অর্থ, হতে পারে কোনো পণ্য। এমনকি তা কোনো সেবা, উপহার, উপঢৌকন আকারেও হতে পারে। যেমন, কেউ যদি ৫০০ টাকা এই ঋণ দেয় যে, ঋণগ্রহীতা ৬ মাস পর ৫০০ টাকার সাথে অতিরিক্ত ৫০ টাকা বেশি দেবে অথবা এই ৫০০ টাকার অতিরিক্ত ১০ কেজি আলু দেবে তা হলে অতিরিক্ত ৫০ টাকা বা ১০ কেজি আলু রিবা আন-নাসি‘আহ হিসেবে গণ্য হবে।
সাধারণত ঋণ বা ধারের ক্ষেত্রে ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’র উদ্ভব হয়। ঋণের চুক্তিতে মূলধনের ওপর পূর্বশর্ত মোতাবেক যেকোনো বৃদ্ধিই হচ্ছে ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’। সরাসরি আল-কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’-কে হারাম করা হয়েছে বলে একে ‘রিবা আল-কুরআন’ বলা হয়। আবার জাহিলি যুগে এই রিবার প্রচলন ছিল বলে একে ‘রিবা আল-জাহিলিয়্যাহ’-ও বলা হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً ۖ وَاتَّقُوا اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩০)।
বিভিন্নভাবে ‘রিবা আন-নাসিআহ্’ সংঘটিত হতে পারে। নিচে এর কটি উদাহরণ দেয়া হলো :
এক : ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রিবা আন-নাসি‘আহ্ :
ঋণের আসলের ওপর চুক্তির শর্ত মোতাবেক অতিরিক্ত ধার্য করা হলে তাকে রিবা আন-নাসি‘আহ বলা হয়। যেমন একব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ১০,০০০ টাকা এক বছরের জন্য এই শর্তে ঋণ দিলো যে, সময় শেষে ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে আসলের সাথে ৫% অতিরিক্ত; অর্থাৎ আরও ৫০০ টাকা বেশি ফেরত দেবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫% বা ৫০০ টাকা ‘রিবা আন-নাসি‘আহ’ হিসেবে গণ্য হবে।
দুই : ধার দেয়ার ক্ষেত্রে রিবা আন-নাসি‘আহ :
সমজাতীয় পণ্য ধার দিয়ে তার ওপর অতিরিক্ত আদায় করাও সুদ। যেমন, ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতাকে ২০ কেজি চাল এই শর্তে ধার দেয় যে, ছয় মাস পর ঋণগ্রহীতা ২৫ কেজি চাল ফেরত দেবে, তা হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি চাল হবে ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’।
তিন : বাকিতে কেনাবেচার বেলায় রিবা আন-নাসি‘আহ্ :
কারো কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রির পর নির্ধারিত সময়ে ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সময় বাড়িয়ে দিয়ে আসলের অতিরিক্ত অর্থ বা মাল আদায় করাও রিবা আন-নাসি‘আহর অন্তর্ভুক্ত। যেমন, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির নিকট ৫ মণ ধান ৩,০০০ টাকায় ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধের শর্তে বাকিতে বিক্রি করল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতা ধানের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলো। এখন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমে মূল্য পরিশোধের সময় বাড়িয়ে ঋণের পরিমাণ ৩,৫০০ টাকা করা হলো। এখানে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা সুদ হিসেবে গণ্য হবে।
◾ ২. ربا الفضل রিবা আল-ফাদাল :
আরবি ‘ফাদাল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত, বাড়তি, বেশি ইত্যাদি। পরিভাষায় পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই রিবা আল-ফাদাল। যেমন, এক দিনারের বিনিময়ে দুই দিনার। ফিকহশাস্ত্রে নগদ কেনাবেচার ক্ষেত্রে উদ্ভূত যাবতীয় রিবাকে রিবা আল-ফাদাল বলে। কাজেই ‘রিবা আন-নাসি‘আহ্’র ন্যায় ঋণ বা ধারদেনার ক্ষেত্রে নয়; বরং নগদ বিনিময় ও কেনাবেচার ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদালের উদ্ভব ঘটে। এই রিবার ক্ষেত্রে সময় নেই; বরং বৃদ্ধি আছে। তাই একে রিবা আল-ফাদাল নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নগদ বিনিময় ও কেনাবেচার ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদালের উদ্ভব ঘটে বলে একে রিবা আল-বুয়ু বা কেনাবেচার রিবা বলা হয়। আবার কেউ কেউ একে রিবা আন-নক্দ বা নগদ রিবা বলে উল্লেখ করেছেন। রিবা আল-ফাদাল সম্পর্কে প্রসিদ্ধ হাদিস হলো, উবাদাহ বিন সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন-
«الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ، وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ، وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ، وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ، وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ، وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ، مِثْلًا بِمِثْلٍ، سَوَاءً بِسَوَاءٍ، يَدًا بِيَدٍ، فَإِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الْأَصْنَافُ فَبِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ» رَوَاهُ مُسْلِمٌ
সোনার বদলে সোনা, রূপার বদলে রূপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর ও লবণের বদলে লবণ লেনদেন (কম-বেশি না করে) একই রকমে সমপরিমাণে ও হাত বাঁ হাত অর্থাৎ নগদে বিক্রয় চলবে। যখন ঐ বস্তুগুলোর মধ্যে প্রকারভেদ থাকবে তখন নগদে তোমরা ইচ্ছানুযায়ী বিক্রয় কর।[সহীহ মুসলিম, ১৫৮৭] বেশি-কম করলে বা বাকিতে করলে, তা সুদি কারবার হিসেবে গণ্য হবে। এতে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে সামন গোনাহগার হবে।
নিচে রিবা আল-ফাদাল এর কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
এক : জাতীয় মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল :
মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে উভয় মুদ্রা যদি একই জাতীয় ও একই শ্রেণিভুক্ত হয়, তা হলে লেনদেন নগদে ও পরিমাণে সমান সমান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় কম-বেশি বা বাকিতে করা হলে রিবা হবে। যেমন, এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম বিক্রি করা।
দু্ই : জাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল :
সমজাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত নেয়া বা দেয়া হয় তা রিবা বা সুদ। সমজাতীয় পণ্য কমবেশি করে বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল সংঘটিত হয়। যেমন, এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দুই কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা হলে এখানে নিম্নমানের খেজুরের অতিরিক্ত এক কেজি হবে ‘রিবা আল-ফাদাল’।
তিন : অসমজাতীয় পণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল :
পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে উভয় পণ্য যদি ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ও শ্রেণিভুক্ত হয় এবং উভয় পণ্য যদি ওজন ও পরিমাপযোগ্য হয় আর একপক্ষ যদি তার পণ্য বাকিতে সরবরাহ করে, তা হলে এ লেনদেন রিবার অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন, কেউ ৫ ভরি সোনার বিনিময়ে ১০০ ভরি রূপা কিনতে চায়। এ ক্ষেত্রে সোনা ও রূপা হাতে হাতে বিনিময় হতে হবে। উভয় পণ্যের কোনো একটি বাকিতে সরবরাহ করা হলে হাদিসের আলোকে তা সুদি লেনদেনে পরিণত হবে।
সুদ জগণ্য অপরাধ। সুদের ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিক এবং অর্থনৈতিক কুফল মারাত্মক। তাই সুদ সম্পর্কে সবার ধারণা পরিষ্কার থাকতে হবে এবং এটি থেকে বাঁচার জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। পরবর্তী কিস্তিতে সুদের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।