সুদের নৈতিক ও সামাজিক কুফল
সুদের আরবি হচ্ছে ‘রিবা’। রিবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত, বর্ধিত ইত্যাদি। মূলধনের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে সুদ বলে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সুদ একটি মারাত্মক অভিশাপ। এতে মানবতা ধ্বংস হয়। বিদায় নেয় মুমিনের পারস্পরিক সহানুভ‚তি, জন্ম নেয় সীমাহীন অর্থলিপ্সা ও স্বার্থপরতা। অতিরিক্ত লোভ-লালসার কারণে সুদি কারবারিরা তখন মানুষের জানমাল ও ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে থাকে। সুদি কারবারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান যুগে সুদ মহামারী আকার ধারণ করেছে। সমগ্র বিশ্ব আজ এর রাহুগ্রাসে পতিত। সুদের কারণে শোষিত হচ্ছে সমাজ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক। সুদি সমাজের লোকদের সুখ ভোগই হয়ে পড়ে জীবনের প্রধান কর্ম। অবৈধভাবে জনগণের ধন লুটে নেওয়ার প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা দেয়। টাকাই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় বলে মনে হয়। ফলে তাদের হৃদয়ে দরিদ্রদের প্রতি দয়ামায়া স্থান পায় না। মানুষের এ রকম অভাবের মুহূর্তকে তারা নিজেদের সবচেয়ে বড় সুযোগ বলে মনে করে। দরিদ্রদের নিজের অর্থ উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাই তো সুদের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয় তাদের বেঁচে থাকার সামান্য আশাটুকুও।
সুদের কুফল সমাজ থেকে নিয়ে ধর্মীয় পর্যায়সহ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। সুতরাং সুদ থেকে বেঁচে থাকা অতীব জরুরি। সুদ শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। সুদপ্রথা ধনসম্পদকে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে কুক্ষিগত করে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সর্বপ্রকার শোষণ প্রক্রিয়া ইসলামে হারাম করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কোরআন কারিমে এরশাদ করেন ‘আমি ব্যবসাকে হালাল করেছি এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করেছি।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার।’ (ইমরান : ১৩০)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন ‘যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতে দিন দণ্ডায়মান হবে, যেভাবে দণ্ডায়মান হয় ওই ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে ক্রয়-বিক্রয়ও তো সুদ নেওয়ার মতোই। অথচ আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, আগে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই জাহান্নামে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)
আল্লাহপাক আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যেসব বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তার রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করও না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)
অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীগণ নৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুদের যে সব বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা আলোচনা করেছেন সেগুলো নিম্নরূপে পেশ করা যেতে পারেঃ
১. সুদ লোভ ও কৃপণতা সৃষ্টি করে
“সুদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অর্থ সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে সুদী ব্যবসায়ের বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত সমগ্র মানসিক কর্মকাণ্ড কার্পণ্য, সংকীর্ণমনতা, মানসিক কাঠিন্য ও অর্থপূজার পারদর্শিতার প্রভাবাধীনে পরিচালিত হয় এবং ব্যবসায়ে মানুষ যতই এগিয়ে যেতে থাকে এ পারদর্শিতা ততই তার মধ্যে বিকাশ লাভ করতে থাকে”।মধ্যযুগের সংস্কার আন্দোলনের নেতা লুথার এবং ঝিংগল মানুষের দুর্বলতার অজুহাত দেখিয়েই সুদকে সমর্থন করেছেন।[ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, ইসলাম এন্ড দি থিওরী অব ইন্টারেস্ট, পৃ: ৮।]
এ সম্পর্কে ব্যাকন তাঁর বক্তব্যে প্রকৃত সত্য কথাটি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “যেহেতু প্রয়োজনের তাকিদেই মানুষ অর্থ ধার দিতে ও নিতে বাধ্য এবং যেহেতু মানুষের হৃদয় এত শক্ত যে, কোন বিনিময় ছাড়া মানুষ ধার দেয় না, সেহেতু সুদের অনুমতি দেওয়া উচিত”।[ব্যাকন, ডিসকোর্স অন ইউসারী।] সুদের মাধ্যমে নির্ধারিত ও নিশ্চিত আয় পাবার লোভ মানুষের বিচার-বিবেচনা, আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি, এমনকি বিবেককে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলে। যারা সুদ খায়, তাদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে স্বার্থপরতা, লোভ ও কৃপণতা এমনভাবে বিকাশ লাভ করে যে, তারা সমাজের অন্যান্য লোকের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করতে কুন্ঠিত হয় না। এ অবস্থা ধীরে ধীরে গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে তখন দয়া-মায়া, সহানুভূতি, সহমর্মিতা অনেকাংশে বিলোপ হয়ে যায়। ফলে সে সমাজে সুদ দিতে না পারলে মৃত সন্তানের লাশ দাফন করার জন্য জরুরী ঋণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসায়ী নিজের আপদকালে সুদ দিতে ব্যর্থ হয় বলে দেউলিয়া হয়ে পথে বসতে বাধ্য হয়।
এক কথায় সুদী সমাজে সুদই যাবতীয় আর্থিক লেনদেন ও সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। যারা সুদ দিতে সক্ষম তাদের জন্য মহাজন এবং মহাজনদের দ্বারা গঠিত ব্যাংকগুলো ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু যারা সুদ দিতে অক্ষম তাদের পক্ষে ঋণ পাওয়া তো দুরের কথা, মৌখিক সহানুভূতিটুকুও দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়। ড.আনোয়ার ইকবাল কোরেশী সুদী ঋণের ক্ষতিকর প্রভাবের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, “এ ধরনের ঋণ সুদখোর সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়”। [ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, পূর্বোল্লেখি, পৃ: ১৪৮।]
২. সুদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে
সুদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা সুদের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয়। ঋণগ্রহীতারা দিনরাত পরিশ্রম করে যা কিছু উপার্জন করে তার সবটাই প্রায় মহাজনের সুদ পরিশোধ করার জন্য দিতে বাধ্য হয়। কখনও কখনও ঋণের দায়ে তাদের ভিটেমাটি এমনকি, স্ত্রী-কন্যাদেরকে পর্যন্ত মহাজনদের হাতে তুলে দিতে হয়। এতে সমাজে সাধারণভাবে সুদখোরদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। এছাড়া সুদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা যখন মানুষের চরম বিপদ-আপদ ও সংকটকে চড়া সুদ আদায়ের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তাদের অমানবিক আচারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলে। সুদখোরদের নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের ফলে মানুষ তাদেরকে সমাজের বন্ধু ভাবার পরিবর্তে শক্র মনে করে।
আধুনিক কালে মহাজনদের স্থান ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠাদ দখল করে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও শ্রমজীবী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর মহাজনী সুদের শোষণ বিশ্বের ধনী-দরিদ্র সব দেশিই কম-বেশি বর্তমান হয়েছে। এমনকি, বৃটেন, আমেরিকা ও জার্মানীর মত দেশে এখনও মানুল মহাজনদের খপ্পরে থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। এদিকে সুদী ব্যাংকরে বিরুদ্ধেও ইতোমধ্যেই ঘৃণা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে এবং এসব ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত করার দাবী করা হচ্ছে।
এ দাবী ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করছে এবং বিশ্বের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ এর পক্ষে ঐকমত্য পোষণ করছেন। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কোন কোন দেশে কিছু কিছু পদক্ষেপও গৃহীত হয়েছে।
এছাড়া, বিগত ৩/৪ দশক থেকে সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে; ক্রমশঃ পাশ্চাত্য দেশেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহেও সুদ ও সুদখোর পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা ও ক্ষোভ রয়েছে। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর পুঁজিপতিদের প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের বিলোপ সাধন করা হয়েছিল, যদিও পরে সে সিদ্ধান্ত তারা বহাল রাখতে পারেনি।
উল্লেখিত ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুদ সমাজে সুদখোর মহাজন, পুঁজিপতি ও ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন। পুঁজিপতিদের স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা ও অর্থলিপ্সার ফলে দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে এমন এমন রক্তাক্ত বিপ্লবের পথ বেছে নেয় যার ফলে পুঁজিপতিদের মান-সম্মান ও জীবদের সাথে সাথে তাদের সুদী সম্পদও ধ্বংস হয় ব্যাপকভাবে।
৩. সুদ নৈতিক অবক্ষয় সাধন করে
সুদী সমাজে ঋণগ্রস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প বেতনের কর্মচারিগণ সর্বদা মহাজনদের চাপের মুখে থাকে এবং তাদের কষ্টার্জিত স্বল্প উপার্জনটুকু মহাজনকে দিয়ে দেওয়ার পর স্ত্রী-পুত্র কন্যা নিয়ে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থা ক্রমে তাদের নৈতিক চরিত্রের ধ্বংস সাধন করে এবং তাদেরকে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়।
এছাড়া অর্থের অভাবে তারা তাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা দিতে পারে না। ফলে এসব ছেলেমেয়রা সুশিক্ষার অভাবে অমানুষ এবং কুমানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। এতে সমাজে অসামাজিক কার্যকলাপের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হয়।
তদুপরি সুদী সমাজে সাধারণভাবে বিনিয়োগকারীগণ পুঁজির সুদ পরিশোধ করার পর লাভ পাবার আশায় কেবল ঐসব খাতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়, যেখানে মুনাফার হার অপেক্ষাকৃত বেশি। উক্ত বিনিয়োগের দ্বারা সমাজের কতটুকু ভাল বা মন্দ হবে ও বিবেচনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে মাদকদ্রব্য, জুয়া, অশ্লীল ও চরিত্র ধ্বংসকারী ছায়াছবি, পর্নো পত্রিকা, নারী ব্যবসা ইত্যাদি নৈতিকতা বিধ্বংসী খাতে অর্থ বিনিয়োগ বেশি হয়; আর এর স্বাভাবিক পরিণতিতে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়। এমনকি, কখনও কখনও স্বাভাবিক নৈতিকতাবোধটুকুও লোপ পায় বা এর বিকৃতি ঘটতে দেখা যায়।
৪. সুদ একটি নিদারুণ জুলুম
এটি হচ্ছে সুদের সামাজিক কুফলের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বস্তুতঃ সুদী ব্যবস্থায় ঋণ প্রদানের পূর্বেই সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অতঃপর নির্ধারিত সময় শেষে ঋণগৃহিতাকে অবশ্যই উক্ত সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার লাভ-লোকসানের বিষয় আদৌ বিচেচনা করা হয় না। ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ খাটিয়ে বিপূল লাভ করলেও সে ঋণদাতাকে পূর্বনির্ধারিত সুদই কেবল পরিশোধ করে; তার অতিরক্তি কিছু সে দেয় না। এতে ঋণদাতাকে ঠকানো হয়। আবার ঋণের অর্থ খাটিয়ে ঋণগ্রহীতার বিপুল লোকসান হলে, এমনকি, তার পুঁজি সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেলে অথবা অন্য কোন কাজে সাকল্য অর্থ ব্যয় করে ফেললেও তার নিকট থেকে পূর্বনির্ধারিত হারে সুদ অবশ্যই আদায় করা হয়। ঋণগ্রহীতার পক্ষে আসল অর্থ যোগাড় করাই যেখানে প্রাণন্তকর অবস্থা হয়, সেখানে আবার এই সুদের অর্থ প্রদানে তাকে বাধ্য করা একটি নিষ্ঠুর জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। একপক্ষের মূলধনের সাকল্য ক্ষতি সত্ত্বেএ অন্যপক্ষের নির্ধারিত এ নিশ্চিত আয়ের এ ব্যবস্থার পেছনে কোন যুক্তি নেই কোন কোন ঋণদাতা অবশ্য এ দাবী করে থাকে যে, সে যে অর্থ ধার দিয়েছে, তা নিজে খাটালে তার লাভ হতো। ঋণগ্রহীতাকে ধার দেওয়ার ফলে ঋণদাতা তার সেই সম্ভাব্য লাভ থেকে বঞ্চিত হলো। সুতরাং ঋণগ্রহীতাকে ঋণদাতার সে ক্ষতি পূরণ করা উচিত। তাই সুদ দাবী করতে পারে।
কিন্তু এখানে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, ঋণদাতা নিজে অর্থ খাটালে লাভ পেত- এ কথাটাই সত্য নয়। আসলে লাভ পেতেও পারে অথবা তার লোকসানও হতে পারে। যদি তার লোকসান হয়,তাহলে এ লোকসানের বোঝা তাকেই বহন করতে হবে; বরং এক্ষেত্রে তার শ্রম, মেধা ও সময় ব্যয় করার জন্যও সে কিছুই পাবে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, এই অর্থ অন্য কেউ খাটিয়ে লোকসান দিলে, তার কোন অংশই ঋণদাতা বহন করতে রাজি হয় না; বরং পূর্বনির্ধারিত সুদসহ সাকল্য আসল আদায় করে ছাড়ে। অথচ অর্থ ঋণ দেওয়ার পর সে এ বিষয়ে আর কোন চিন্তা-ভাবনা, শ্রম ও সময় কিছুই ব্যয় করেনি। তবু তার মুনাফা হলো নিশ্চিত। অপরদিকে যে ঋণগ্রহীতা তার শ্রম, মেধা ও সময় ব্যয় করে কারবার পরিচালনা করল, সে তার শ্রম ও সময় হারাবার সাথে সাথে যে মুনাফা হয়নি তাও পরিশোধ করতে বাধ্য হবে, একে আর যাই হোক, মানবিক ইনসাফ বলা যেতে পরে না।
৫. সুদ ঋণের ভারে জর্জরিত করে
সুদী সমাজে সুদ ছাড়া ঋণ পাওয়ার কোন ব্যবস্থা থাকে না। ফলে সে সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা জরুরী প্রয়োজন, বিপদ-আপদ ও দুর্বিপাকের চরম সংকটকালে সুদখোর মহাজনদের নিকট থেকে চড়া ও চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। কার্ল মার্কস যাথার্থই বলেছেন, “The borrower, has no occasion to borrow as a producer. When he does any borrowing of money he does it for securing personal necessities.”[কার্ল মার্ক্স, দি ক্যাপিটাল।] “ঋণগ্রহীতাগণ কখনও উৎপাদনকারী হিসেবে ঋণগ্রহণ করার সুযোগ পায় না; তারা যখনই ঋণ নেয়, তখনই ব্যক্তিগত অভাব পুরণের সামগ্রী সংগ্রহের জন্য ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়”। এই অবস্থায় ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতি হয় না; বরং এ অবস্থা সুদখোরদের মুষ্টিকে আরও শক্ত করে। স্বল্প সময়েই সুদে-আসলে ঋণের বোঝা বিরাট হয়ে যায় এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকু দিয়েও ঋণের বোঝা থেকে রেহাই পায় না। কখনও ক্খনও বংশানুক্রমে ঋণের বোঝা চলতে থাকে। স্বল্প আয়ের লোকেরা সকাল-সন্ধ্যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সামান্য পয়সা রোজাগার করে, তার প্রায় সবটাই চলে যায় মহাজনদের সিন্দুকে। অতঃপর দু’বেলা পেটপুরে আহার করার মত অর্থও তাদের থাকে না। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে বাধ্য হয়।
৬. সুদ জীবনীশক্তির ক্ষয় এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস করে
ঋণের ভারে জর্জরিত বিরাট এক জনগোষ্ঠী সর্বদাই ঋণদাতাদের চাপের মুখে নিদারুণ পেরেশানী ও দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের জীবনীশক্তি ঘুণে খাওয়ার ন্যায় ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে থাকে। তাদের কর্ম-ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তাদের নিজের ও পরিবার-পরিজনের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে এবং জাতীয় উৎপাদনকে নিম্নমুখী করে দেয়।