হিংসার উৎস, ক্ষতি ও প্রতিকার
মাওলানা আবদুল্লাহ আলহাসান
ভালোর প্রতি আগ্রহ ও টান, মন্দের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা মানুষের স্বভাবজাত। কিন্তু মানুষ কখনো উল্টো পথে চলে; মন্দের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, মন্দের পেছনে ছোটে। ভালোর প্রতি অনীহা প্রদর্শন করে, ভালো থেকে দূরে থাকে। কিন্তু এটা মানুষের স্বভাবজাত নয় এবং তার সফলতার পথও নয়। স্বভাববিরুদ্ধ নিজের অকল্যাণের পথ থেকে ফেরাতে আল্লাহ বহুভাবে তাঁর বান্দাদের উৎসাহিত করেছেন। পুরস্কার ও পরিণাম তুলে ধরেছেন।
এ অবস্থার কেন্দ্র যেহেতু নফস ও আত্মা, তাই আল্লাহ তাআলা এ নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন- ভালো পথে পরিচালিত করতে বলেছেন, মন্দ পথ থেকে ফেরাতে বলেছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا، وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا. অবশ্যই সে সফল হয়েছে, যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা বিনষ্ট করেছে। -সূরা শামস (৯১) : ৯-১০ قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰي. নিশ্চয়ই সফল হয়েছে সে, যে পরিশুদ্ধ হয়েছে। -সূরা আ‘লা (৮৭) : ১৪
যেসকল মন্দ চরিত্র ও স্বভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল হাসাদ-হিংসা। আসুন আমরা আমাদের আত্মাকে হিংসা থেকে পরিশুদ্ধ করি। জেনে নিই এর উৎস, ক্ষতি ও প্রতিকার।
হিংসা তৈরি হয় দৃষ্টির অপব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা থেকে। একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
আল্লাহ তাআলা হলেন রাযযাক- মহা রিযিকদাতা। তিনি হাকীমও-প্রাজ্ঞ হেকমতওয়ালা। কাউকে ধনী বানান, কাউকে দরিদ্র। এই শ্রেণিভেদ তাঁর হিকমাহ ও প্রজ্ঞারই অংশ। এরই ওসিলায় সচল থাকে জীবনের চাকা। বান্দার কাজ হল, আল্লাহর বণ্টনের প্রতি রাজি থাকা- শোকর ও সবরের মাধ্যমে। আমরা যেন অকৃতজ্ঞ ও অধৈর্য না হই, তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন- পার্থিব বিষয়ে যেন নিজের চেয়ে নিচের ব্যক্তির দিকে তাকাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ، وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ، فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ.
তোমাদের চেয়ে যে উপরের অবস্থানে আছে তার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে যে নিচের অবস্থানে আছে তার প্রতি দৃষ্টি দাও। তাহলে তোমাদের প্রতি আল্লাহ্-প্রদত্ত নিআমত ও অনুগ্রহকে তুচ্ছ মনে হবে না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫১৩
নবীজীর এই নির্দেশনা অনুযায়ী যে চলে তার জীবন হয় কৃতজ্ঞতা ও সবরের, উদারতা ও মহানুভবতার। কিন্তু যখনই কেউ এই নির্দেশনাটি অমান্য করে; বঞ্চিত হয় শোকর ও সবরের অমূল্য সম্পদ থেকে, আক্রান্ত হয় হিংসার মত ভয়াবহ মরণব্যাধিতে।
হিংসার ক্ষতি
হিংসা দ্বারা না হিংসুকের রিযিক বাড়ে আর না যার প্রতি হিংসা করা হয় তার রিযিক কমে। অধিকন্তু এতে হিংসুকের জন্য রয়েছে সমূহ ক্ষতি। যেমন :
১. হিংসা অভিশপ্ত ইহুদী জাতির স্বভাব
কুরআন কারীমে যত জায়গায় হিংসার আলোচনা রয়েছে অধিকাংশই ইহুদী জাতির দুষ্কৃতির ফিরিস্তি।
উদাহরণস্বরূপ সূরা বাকারা ৯০, ১০৯। সূরা আলে ইমরান ১৯। সূরা নিসা ৫৪ ও সূরা ফালাকের ৫ নং আয়াত। মূলত এই হিংসা ও হঠকারিতাই ওদের গলায় অভিশাপের বেড়ি পরিয়েছে।
২. হিংসা অন্তর্জগতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে
হিংসুকের অন্তর আমরণ অস্থিরতায় ভোগে। কারণ হিংসা আগুন। হিংসুক যখন অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না; হিংসার আগুনে নিজেই জ্বলে মরে।
৩. হিংসা নেকী ধ্বংস করে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: إياكُم والحَسَدَ، فإنَّ الحَسَدَ يأكُلُ الحَسَناتِ كما تأكُلُ النَارُ الحَطَبَ.
হিংসা থেকে সাবধান! কেননা হিংসা নেকীকে এমনভাবে ধ্বংস করে; যেমন আগুন লাকড়ি ধ্বংস করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯০৩
৪. হিংসা বহু হারাম কাজের দরজা খুলে দেয়
অন্তর যখন হিংসায় আক্রান্ত হয়; হাত-পা, মুখ-মাথা ইত্যাদি অঙ্গগুলোও এর থেকে রেহাই পায় না। মাথায় অন্যের ক্ষতিসাধনের চিন্তা, চোখে দোষ খেঁাজা, মুখে দোষ চর্চা ও নিন্দা এবং হাত-পা ও মুখ দ্বারা জান, মাল ও ইজ্জত আব্রুতে আঘাত করা যেন হিংসুকের যথারীতি অভ্যাসে পরিণত হয় ।
হায়, এক হিংসা কতগুলো হারাম কাজের দরজা খুলে দেয়!
৫. হিংসা ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
হিংসার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল. এটি ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারণ ঈমানের দাবি হল, আল্লাহ তাআলাকে রব বলে স্বীকার করা এবং তাঁর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। হিংসার সারকথা হল, আল্লাহর ফয়সালা ও বণ্টনের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা। বান্দার এ অবস্থা যে তার ঈমানকে মারাত্মকরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা বলাই বাহুল্য। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- وَلَا يَجتَمِعُ فِي جَوفِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالحَسَدُ.
.কারো অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্র হতে পারে না। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৬০৬
হিংসা দমনের পদ্ধতি
১. কারো প্রতি হিংসা অনুভব হওয়া মাত্রই দুটি কথা চিন্তা করা :
ক. এই হিংসা দ্বারা না আমার রিযিক বাড়বে আর না যার প্রতি হিংসা করছি তার রিযিক কমবে। উপরন্তু এর কারণে আমার ঈমান আমল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হবে।
খ. আমার কল্যাণ-অকল্যাণ আমার চেয়ে আমার আল্লাহ্ই ভালো জানেন। সুতরাং আমার নসীবে তিনি যা দিয়েছেন তা-ই আমার জন্য কল্যাণকরা। তাতেই আমার তুষ্ট থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
عَسٰۤی اَنْ تَكْرَهُوْا شَیْـًٔا وَّ هُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ وَ عَسٰۤی اَنْ تُحِبُّوْا شَیْـًٔا وَّ هُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَ اللهُ یَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.
হতে পারে, তোমরা একটি জিনিস অপছন্দ কর; অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং একটি জিনিস পছন্দ কর; অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। -সূরা বাকারা (২) : ২১৬
২. অর্থের প্রতি খেয়াল করে এই আয়াত তিলাওয়াত করা-
وَ لَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللهُ بِهٖ بَعْضَكُمْ عَلٰی بَعْضٍ، لِلرِّجَالِ نَصِیْبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُوْا وَ لِلنِّسَآءِ نَصِیْبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ، وَ سْـَٔلُوا اللهَ مِنْ فَضْلِهٖ، اِنَّ اللهَ كَانَ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا.
তোমরা এমন জিনিসের বাসনা করো না, যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের একজনকে অন্য জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষদের জন্য রয়েছে তাদের উপার্জনের অংশ আর নারীদের জন্য রয়েছে তাঁদের উপার্জনের অংশ। আর তোমরা আল্লাহর নিকট তাঁর দয়া প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। -সূরা নিসা (৪) : ৩২
৩. আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের এবং যার প্রতি হিংসা অনুভব হয় তার জন্য কল্যাণের দুআ করা। সাথে সাথে হিংসা থেকে আরোগ্যের জন্যও দুআ করা।
৪. হিংসার চাহিদার বিপরীত কাজ করা। যেমন নিন্দার পরিবর্তে প্রশংসা করা। ক্ষতি না করে উপকার করা। দোষ না খুঁজে গুণ খোজা।
তার সাথে ঐ সকল কাজ করা, যেগুলো দ্বারা পারস্পরিক হৃদ্যতা ও ভালবাসা তৈরি হয়; যথা সালাম দেওয়া, হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা, মাঝেমধ্যে হাদিয়া দেওয়া ইত্যাদি। এ বিষয়ে হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. লেখেন- যার প্রতি হিংসা হয় মানুষের নিকট তার প্রশংসা করা, সামনে পড়লে তার তাযীম করা এবং মাঝে মাঝে তার কাছে হাদিয়া পাঠানো.. এ এমন এক এলাজ, যা বিশেষ এলাজসমূহের চেয়ে দ্রুত ও সহজলভ্য।… -আশরাফ চরিত, ৩৫৫
এগুলো করতে বেশ কষ্ট হবে। কিন্তু এই কষ্ট তো আমার ঈমান-আমল রক্ষার জন্য, আমার চিরস্থায়ী শান্তির জন্য। এ তো রহমতের বারিধারা বর্ষণের পূর্বে ধুলোবালি ওড়া, ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও মেঘগর্জন।
অতএব আসুন আমরা হিংসা দমন করি। হিংসার আগুন আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা করি নিজেকে। শান্তিময় জীবনের অধিকারী হই। প্রতিজ্ঞা করি, আমাকে বাঁচতেই হবে এ মরণব্যাধি থেকে।
সূত্র : মাসিক আল কাউসার