ইসলাম

রাগ বা গোস্বা গুনাহের অন্যতম একটি উপলক্ষ

গুনাহের দু’টি উপলক্ষ: গোস্বা ও কু-প্রবৃত্তি

দুনিয়াতে যত গুনাহ হয় চাই সেটা মহান আল্লাহর হক সংশ্লিষ্ট হোক বা বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হোক। মানুষ চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, এসব গুনাহের নেপথ্যে দু’টি স্পৃহা কাজ করে। একটি হল “গোস্বা”। আর অপরটি হল মনের মন্দ বাসনা।

উদাহরণস্বরূপ: বেশি খাওয়ার বাসনা, চুরি করার বাসনা, বারবার গুনাহ করার বাসনা, ডাকাতি করার বাসনা, কুদৃষ্টি করার বাসনা ইত্যাদি। বুঝা গেল যে, অনেক গুনাহ মানুষ করে মনের মন্দ বাসনার তাড়নায় তাড়িত হয়ে। অথবা এভাবেও বলা যায় যে, অসংখ্য গুনাহ আছে যেগুলো মন্দ বাসনার তাড়নায় সৃষ্টি হয়।

আবার অনেক গুনাহ আছে যেগুলো রাগ বা গোস্বার দ্বারা পয়দা হয়।

উদাহরণস্বরূপ: রাগ থেকে সৃষ্টি হয় অনীহা, অনীহা থেকে সৃষ্টি হয় ঘৃণা। ঘৃণার কারণে মানুষ হিংস্র্র আচরণ করে। রাগের কারণে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক আচরণ প্রকাশ পায়। পারিবারিক কলহ, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সাথে বিবাদ, সহকর্মীদের সাথে মারমুখো আচরণ এ সবের অন্তর্ভুক্ত।

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কোন উপদেশ দিন তবে লম্বা উপদেশ দিবেন না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : গোস্বা করবে না ৷ (”সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬১১৬)

আগন্তুক সাহাবী উপদেশ প্রদানের দরখাস্ত করেছেন। পাশাপাশি শর্ত আরোপ করেছেন যেন ঐ উপদেশ সংক্ষিপ্ত হয়। লম্বা চওড়া না হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ শর্তের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি যে, উপদেশ চাও আবার সংক্ষেপ করতে বল। এ কারণেই এ হাদীসে পাকের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসীনে কিরাম লিখেছেন: যে ব্যক্তি উপদেশপ্রার্থী, সে যদি একথা বলে যে, আমাকে সংক্ষিপ্ত উপদেশ প্রদান করুন। তাহলে সেটা আদব পরিপন্থী হবে না। কারণ হতে পারে সে মানুষটির তাড়াহুড়ো আছে। যদ্দরূন তিনি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করছেন। এখন যদি আপনি তার সামনে লম্বা উপদেশ প্রদান শুরু করেন, তাহলে ঐ বেচারা পেরেশানীতে পড়ে যাবে।

তো যাই হোক, এটা আদব পরিপন্থী কোন কাজ নয়। তাইতো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সংক্ষিপ্ত উপদেশ প্রদান করে বলেছেন: “তুমি গোস্বা করনা”। যদি মানুষ এই সংক্ষিপ্ত উপদেশের উপর আমল করে তাহলে সম্ভবত শত সহস্ৰ গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে ।

“গোস্বা” একটি প্রকৃতিগত জিনিস

আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই “গোস্বা” বা রাগ রেখে দিয়েছেন। পৃথিবীর কোন মানুষ এমন নাই যার মধ্যে গোস্বার প্রকৃতি নাই। মহান আল্লাহ নিজ হেকমতের কারণেই এই প্রকৃতি ও স্বভাব মানুষের মধ্যে রেখেছেন। এই স্বভাবটাকেই যদি মানুষ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তাহলে এটাই মানুষকে অগণিত বালা-মুসীবত থেকে সংরক্ষিত রাখার একটি মাধ্যম হয়ে যায় ৷

যদি মানুষের মধ্যে এই রাগের স্বভাব না থাকে, তাহলে কোন শত্রু যদি তার উপর আক্রমণ করে তবুও তার রাগ বা গোস্বাও আসবে না। অথবা কোন হিংস্র প্রাণী তার উপর হামলা করলেও তার কোন গোস্বাই আসবে না। এমনকি সে আত্মরক্ষাও করতে পারবে না। এজন্য বৈধ আত্মরক্ষার জন্য গোস্বার ব্যবহার জায়িয আছে। শরীয়ত এ ব্যাপারে কোন বাধ্য-বাধকতা আরোপ করেনি। কেননা গোস্বা তো দেয়াই হয়েছে এজন্য যেন সে মানুষ স্বীয় জান-মাল হেফাযত করতে পারে। নিজ স্ত্রী-সন্তানদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে প্রতিহত করতে পারে। এগুলো হল গোস্বার বৈধ ক্ষেত্রসমূহ।

গোস্বার ফলে সৃষ্ট গুনাহসমূহ

এই গোস্বা যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে এর পরিণামে যে গুনাহ সৃষ্টি হয় সেগুলোর সংখ্যা অনেক। এই গোস্বার দ্বারাই “অহংকার” সৃষ্টি হয়, গোস্বার কারণেই “হিংসা” সৃষ্টি হয়। গোস্বার ফলেই “বিদ্বেষ” সৃষ্টি হয়, গোস্বার দরূনই “শত্রুতা” সৃষ্টি হয়। এগুলো ছাড়াও না জানি কত খারাবী এই গোস্বার কারণে সৃষ্টি হয়।

যদি গোস্বা কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণে না থাকে আর সেই গোস্বা কোন মানুষের উপর এসে যায়, এখন যার উপর গোস্বা এসেছে সে নিয়ন্ত্রণে আছে। উদাহরণস্বরূপ সে অধীনস্ত, তাহলে এই গোস্বার ফলে হয়ত তাকে কষ্ট দিবে অথবা মারবে অথবা ধমক দিবে কিংবা গালি দিবে বা সমালোচনা করবে বা মনে ব্যথা দিবে ইত্যাদি।

বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এই প্রত্যেকটি কাজ গুনাহ। যা গোস্বার ফলে তার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কেননা অন্যকে অন্যায়ভাবে মারপিট করা মারাত্মক গুনাহ। অনুরূপভাবে যদি গোস্বার কারণে কাউকে গালি দিয়ে দেয়। তো হাদীসে পাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে বলেছেন কোন মুসলমানকে গালি দেয়া নিকৃষ্টতম ফাসেকী কাজ, আর তাকে হত্যা করা কুফরী কাজ ।”*

অনুরূপভাবে যদি গোস্বার কারণে অন্যের সমালোচনা বা নিন্দাবাদ করে, যদ্দরূন অন্য মানুষের অন্তর ভেঙ্গে যায়, তাহলে এটাও অনেক বড় গুনাহ। এই সব গুনাহ ঐ সময় হয়েছে যখন এমন ব্যক্তির উপর গোস্বা এসেছে যিনি আপনার অধীনস্ত ছিলেন।

“বিদ্বেষ” গোস্বার কারণে সৃষ্টি হয়

আর যদি এমন কারো উপর গোস্বা এসে যায় যিনি আপনার অধীনস্ত নন এবং তিনি আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, তাহলে তো গোস্বার ফলে আপনি তার গীবত করবেন। উদাহরণস্বরূপ যার উপর গোস্বা এসেছে তিনি আপনার থেকে যে কোন দিক দিয়ে বড় এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তার সামনে কিছু বলার সাহস আপনার নেই, মুখ খুলেনা। ফলশ্রুতিতে যেটা হবে সেটা হল আপনি তার সামনে তো চুপ থাকবেন ঠিক, কিন্তু যখন তিনি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবেন, তখন তার বদনাম গাওয়া আরম্ভ করে দিবেন। আর তার গীবত করতে থাকবেন।

এখন এই যে গীবত হচ্ছে কিসের কারণে হচ্ছে? ঐ গোস্বার কারণে। আবার অনেক সময় এমন হয় যে, মানুষ অন্যের যত গীবতই করুক, তবুও তার গোস্বা ঠান্ডা হয় না বরং গোস্বার কারণে মনে চায় যে, তার চেহারা খামচে ধরি। তাকে কষ্ট দেই। কিন্তু যেহেতু সে প্রভাবশালী ও বড়, এজন্য তাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এর ফলে অন্তরে এক মারাত্মক ক্ষোভ জন্ম নেয়। সেই ক্ষোভের নামই হল “বিদ্বেষ”।

এখন মনের মধ্যে সব সময় এ চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে যে, যদি সুযোগ হয়, তাহলে তাকে কষ্ট দিব। আর যদি আপনা আপনি তার কোন বিপদ আসে তাহলে খুশী হয় যে, ভালই হয়েছে যে, তার কষ্ট হচ্ছে, বিপদ এসেছে। এটাই “বিদ্বেষ”। যা স্বতন্ত্র একটি গুনাহ। যা ঐ গোস্বার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে।

“হিংসা” গোস্বার কারণে সৃষ্টি হয়

আর যদি যে ব্যক্তির উপর গোস্বা আসবে তার কষ্ট পাওয়ার পরিবর্তে আরাম ও খুশী হাসিল হয়ে যায়। যেমন কোন স্থান হতে সে মোটা অংকের টাকা পেয়ে গেল অথবা সে কোন বড় পদমর্যাদার অধিকারী হয়ে গেল, তো এখন অন্তরে এই চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে যে, এই পদমর্যাদা তার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হোক। এই ধন-সম্পদ টাকা- পয়সা যে কোন ভাবেই যেন তার কাছে নষ্ট হয়ে যায়। এটার নামই হল “হিংসা”। এই “হিংসাও” ঐ গোস্বার ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে।

যাই হোক, যার উপর গোস্বা আসছে যদি তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে, তাহলেও অনেক গুনাহ এর দ্বারা প্রকাশ পায়, আর যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তবুও অনেক গুনাহ প্রকাশ পায়। এই সব গুনাহ ঐ “গোস্বা” নিয়ন্ত্রণে না থাকার ফলে সষ্টি হচ্ছে। যদি গোস্বা নিয়ন্ত্রণে থাকত তাহলে মানুষ এই সব গুনাহ হতে নিরাপদ থাকত। এ কারণেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন“গোস্বা করোনা”।

তাইতো কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা নেক মুসলমানদের প্রশংসা করে ইরশাদ করেছেন “নেক মুসলমান হলেন তারা যারা গোস্বাকে সংবরণ করেন আর মানুষদেরকে ক্ষমা করে দেন। ”সূরা আলে ইমরান: আয়াত :১৩৪)

গোস্বার ফলে বান্দার হকসমূহ নষ্ট হয়

যেমনটি আমি আরয করেছি যে, গুনাহের উৎসমূল হল দুটি জিনিস। একটি হল গোস্বা। অপরটি হল মনের মন্দ বাসনা। কিন্তু মন্দ বাসনার তাড়নায় যে গুনাহ সংঘটিত হয়, সেটা যদিও বড় মারাত্মক কিন্তু সেই গুনাহও খালেস দিলে তাওবা করলে মহান আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করে দেন এবং তার তাওবা কবূল করে নেন। শুধু তাই নয় বরং তার আমলনামা হতে ঐ গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু গোস্বার ফলে যে গুনাহ সংঘটিত হয়, সেগুলোর বেশিরভাগের সম্পর্ক হল বান্দার হকের সাথে। উদাহরণস্বরূপ গোস্বার ফলে কাউকে মারল বা বকা দিল বা কারো মনে ব্যথা দিল বা কারো সমালোচনা করল ইত্যাদি। এসবের সম্পর্ক হল বান্দার হকের সাথে । অনুরূপভাবে যদি গোস্বার ফলে কারো গীবত করে অথবা কারো সাথে “বিদ্বেষ” রাখে বা কারো সাথে “হিংসা” সৃষ্টি হয়, তো এ সব ও বান্দার হক নষ্ট করা।

অতএব গোস্বার ফলে যত গুনাহ হয়, সবগুলোর সম্পর্ক হল বান্দা বা বান্দীর হকের সাথে। আর বান্দার হক নষ্ট করা এমন মারাত্মক একটি গুনাহ যে, যদি পরবর্তীতে মানুষ এর থেকে ফিরেও আসে এবং তাওবা করে নেয়, তবুও তার তাওবা ঐ সময় পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত যে বান্দার হক নষ্ট করেছে, সে মাফ না করবে। অতক্ষণ পর্যন্ত ঐ গুনাহ মাফ হবে না।

আল্লাহ তাআলা বলেন: তাওবা করলে আমি আমার হক তো অবশ্যই মাফ করব কিন্তু আমার বান্দাগণের যে সব হক তোমরা নষ্ট করেছ, সেগুলো আমি অতক্ষণ পর্যন্ত মাফ করব না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ বান্দাদের থেকে মাফ করিয়ে না নিবে | এখন তুমি কার কার কাছে মাফের জন্য ছুটাছুটি করবে? এজন্য বান্দার হক নষ্ট করা বড় মারাত্মক গুনাহ। এ কারণেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভমূলক উপদেশ প্রদান করে বলেছেন : গোস্বা করবে না” ।

যখন মানুষ স্বীয় গোস্বার উপর কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে এবং সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তখন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: যখন আমার বান্দা গোস্বাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তো এখন আমিও তার সাথে গোস্বাসুলভ আচরণ করব না।

বই : হিংসা ও গোস্বা: দুটি ধ্বংসাত্বক ব্যাধি

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *