গোস্বা যেন হয় আল্লাহর জন্য
যে গোস্বা বা বিদ্বেষ আল্লাহর জন্য হয় সেটা কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতা সৃষ্টি করেনা। পয়দা করে না কোন ফিতনা। কেননা যার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা হয়, যার উপর গোস্বা করা হয় সেও জানে যে, আমার সাথে তার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। বরং বিশেষ কাজ ও বিশেষ চিন্তাধারার সাথে মতপার্থক্য। এজন্য কেউ তার কথাকে খারাপ মনে করে না। কেননা সবাই জানে যে, তিনি যা কিছু বলছেন আল্লাহর জন্য বলছেন। এটাকেই বলা হয়েছে তা অর্থাৎ যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ পোষণ করে। তো এটা গোস্বার উত্তম ক্ষেত্র। শর্ত হল এই গোস্বাটা শরীয়তের সীমার মধ্যে থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা এ নেয়ামত আমাদেরকে দান করুন। আমাদের ভালোবাসাও যেন আল্লাহর জন্য হয় আবার আমাদের বিদ্বেষও যেন একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য হয়। কিন্তু এই গোস্বার মুখে যেন লাগাম পরানো থাকে। অর্থাৎ যেখানে আল্লাহর জন্য গোস্বা করা দরকার, সেখানে করবে আর যেখানে গোস্বা করা উচিত নয় সেখানে লাগাম টেনে ধরতে হবে।
হযরত আলী রাযি. এর ঘটনা
হযরত আলী রাযি. কে দেখুন। এক ইয়াহুদী তাঁর সামনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে কোন বেআদবীমূলক কথাবলে ফেলেছে। নাউযুবিল্লাহ। হযরত আলী রাযি. কি আর এটা সহ্য করতে পারেন? সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে উপরে উঠিয়েছেন এরপর মাটিতে আছড়ে ফেলে বুকের উপর উঠে বসেছেন। ইয়াহুদী যখন দেখল যে, তার আর বাঁচার কোন পথ নেই, তখন সে শুয়ে শুয়ে হযরত আলী রাযি.এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হযরত আলী রাযি. ঐ ইয়াহুদীকে ছেড়ে দিয়ে পৃথক হয়ে গেলেন।
লোকেরা বলল! হযরত! সে তো আরো বড় গোস্তাখীর কাজ করল। কেননা সে আপনার মুখে থুথু দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আপনি তাকে ছেড়ে পৃথক হয়ে গেলেন কেন? হযরত আলী রাযি. বললেন: আসল কথা হল, প্রথমে যখন আমি তার উপর আক্রমণ করলাম তখন আমার উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করা। যেটা আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বতে করেছি। কেননা সে নবীজীর শানে গোস্তাখী করেছে। যদ্দরূন আমার গোস্বা এসেছে এবং আমি তাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু যখন সে আমার মুখে থুথু নিক্ষেপ করল, তখন আমার আরো বেশি গোস্বা আসল। কিন্তু তখন যদি আমি গোস্বার উপর আমল করে তার থেকে বদলা বা প্রতিশোধ নিতাম, তাহলে সেটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য হত না বরং আমার নিজের জন্য হত। এবং সেটা এ জন্যইহত যেহেতু সে আমার মুখে থুথু নিক্ষেপ করেছে। তাই আমি তাকে আরো বেশি মারব! তো এ অবস্থায় এ রাগ আল্লাহর জন্য হত না বরং নিজের জন্য হত, এজন্য তাকে ছেড়ে দিয়ে পৃথক হয়ে গেছি ।
মূলত এটা হল ঐ হাদীসে পাকের উপর আমল যেখানে ইরশাদ হয়েছে: مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে ও আল্লাহরই জন্য রাগ করে।’
কেমন যেন সে গোস্বার মুখে লাগাম লাগিয়ে রেখেছে যে, যে পর্যন্ত গোস্বার শরয়ী ও বৈধ সীমারেখা, সে পর্যন্ত গোস্বা করা তো জায়িয। কিন্তু যেখানে গোস্বার বৈধ ক্ষেত্র শেষ, সেখানে তার থেকে গোস্বা এমনভাবে দূর হয়ে যাবে যে, কেমন যেন তার সাথে কোন সম্পর্কই নেই। এদের ব্যাপারেই বলা হয়: كَانَ وَقَافًا عِنْدَ حُدُودِ اللهِ অর্থাৎ “এরা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার সামনে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতেন।(”সুনানে আবূ দাউদ, অধ্যায় ঈমান বাড়ে ও কমে, হাদীস ৪৬৮১)
হযরত ফারুকে আযম রাযি. এর ঘটনা
একবার হযরত ফারূকে আযম রাযি. মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। দেখলেন যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা হযরত আব্বাস রাযি. এর বাসার নল মসজিদে নববীর দিকে লাগানো। বৃষ্টির পানি মসজিদে নববীতে পড়ছিল। হযরত উমর ফারূক রাযি. চিন্তা করলেন যে, মসজিদ তো আল্লাহ তাআলার ঘর। আর কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বাসার নলের পানি মসজিদে এসে পড়ছে। এটা তো মহান আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধচরণ ।
ফলে তিনি ঐ নল ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিলেন। গোস্বার কারণেই তা ভেঙ্গে দিলেন। আর গোস্বা আসার কারণ হল মসজিদের আহকাম ও আদাবের বিরুদ্ধাচরণ। যখন হযরত আব্বাস রাযি. জানতে পারলেন যে, তার ঘরের নল ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, তখন হযরত উমর ফারূক রাযি. এর নিকটে আসলেন এবং বললেন যে, আপনি এ নল কেন ভেঙ্গে দিয়েছেন? হযরত ফারূক আযম রাযি. বললেন যে, এটা তো মসজিদের স্থান। কারো ব্যক্তিগত স্থান নয়। মসজিদের স্থানে কারো ব্যক্তিগত নল শরীয়তের বিধান পরিপন্থী কাজ ছিল।এজন্য আমি ভেঙ্গে দিয়েছি।
হযরত আব্বাস রাযি. বললেন: আপনি জানেন কি এ নল কিভাবে লাগানো হয়েছে? এ নল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে লাগানো হয়েছিল এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ নির্দেশে আমি লাগিয়েছিলাম। আপনি এটা ভাঙ্গার কে?
হযরত ফারূকে আযম রাযি. বললেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিয়েছিলেন? হযরত আব্বাস রাযি. বললেন: হ্যাঁ, অনুমতি দিয়েছিলেন। তখন হযরত ফারুকে আযম রাযি. হযরত আব্বাস রাযি. কে বললেন: আল্লাহর ওয়াস্তে আমার সাথে আসুন। ফলশ্রুতিতে ঐ নলের কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে হযরত ফারূকে ফলশ্রুতিতে ঐ নলের কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে হযরত ফারূকে আযম রাযি. রুকুর ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেলেন এবং হযরত আব্বাস রাযি. কে বললেন যে, আপনি আমার কোমরের উপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার এ নল স্থাপন করুন। হযরত আব্বাস রাযি. বললেন: আমি অন্য কারো দ্বারা লাগিয়ে নিব। হযরত ফারুকে আযম রাযি. বললেন: উমরের এত বড় দুঃসাহস যে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক লাগানো নল ভেঙ্গে দিয়েছে। আমার দ্বারা এত বড় অন্যায় হয়ে গেল। এটার ন্যূনতম শাস্তি এটাই যে, আমি রূকু অবস্থায় থাকব আর আপনি আমার কোমরের উপর দাঁড়িয়ে এ নল স্থাপন করবেন। ফলশ্রুতিতে হযরত আব্বাস রাযি. তাঁর কোমরের উপর দাঁড়িয়ে সেই নল পুনঃস্থাপন করলেন। সেই নলটি আজো মসজিদে নববীতে লাগানো আছে ৷
আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে উত্তম বদলা দান করুন। যাঁরা মসজিদে নববী নির্মাণ করেছেন, তাঁরা এখনো সেই নলটি ঐ স্থানেই লাগিয়ে দিয়েছেন। যদিও বর্তমানে এই নলের বাহ্যত কোন ব্যবহার নেই। কিন্তু স্মারক হিসেবে লাগানো আছে। এটা হল বাস্তবিক পক্ষে ঐ হাদীসের উপর আমল যে مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ অর্থাৎ “যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসল ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ রাখল” ।(সনানে আবু দাউদ, অধ্যায় ঈমান বাড়ে ও কমে, হাদীস নং ৪৬৮১)
প্রথমে যে গোস্বা ছিল সেটাও আল্লাহর জন্য ছিল আর এখন যে মহব্বত বা ভালোবাসা সেটাও আল্লাহর জন্য। যে ব্যক্তি এ কাজটি করল, সে তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিল। এটা ঈমান পরিপূর্ণ হওয়ার লক্ষণ।
কৃত্রিম গোস্বা করে বকা দিবেন
যাই হোক, এই البغض في الله এর কারণে অনেক সময় গোস্বার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। বিশেষ করে ঐসব মানুষের উপর গোস্বা প্রকাশ করতে হয় যারা কারো তরবিয়্যতের অধীনে হয়। যেমন শিক্ষককে তাঁর ছাত্রের উপর গোস্বা করতে হয়। পিতাকে সন্তানের উপর, শাইখকে মুরীদের উপর গোস্বা করতে হয়। কিন্তু এই গোস্বা ঐ সীমারেখা পর্যন্ত হওয়া উচিত, যতটুকু ইসলাহের জন্য জরূরী, এর থেকে আগে বাড়বে না। যেমনটি এইমাত্র আরয করা হয়েছে যে, এর পদ্ধতি হল এই যে, যদি কেউ অতিমাত্রায় উত্তেজিত থাকে তাহলে গোস্বা করবে না। উদাহরণস্বরূপ শিক্ষকের ছাত্রের উপর গোস্বা এসে গেল, তাহলে এই গোস্বার হালতে বকাঝকা এবং মারপিট করবে না বরং সেই রাগ বা গোস্বা খতম হওয়ার পর এবং উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার পর কৃত্রিম গোস্বা করে বকাঝকা করবে। যাতে করে এই বকাঝকা সীমার বাইরে চলে না যায়। এই কাজ একটু কঠিন। কেননা মানুষ গোস্বার সময় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এর মশক বা চর্চা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই গোস্বার ক্ষতি ও অনিষ্টত হতে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
বই : হিংসা ও গোস্বা: দুটি ধ্বংসাত্বক ব্যাধি