যিলহজ্ব মাস কেন্দ্রিক কিছু ভিত্তিহীন আমল
যিলহজ্ব মাস হজ্ব-কুরবানী আদায়ের মাস। এ মাস আল্লাহ তাআলার কাছে সম্মানিত চার মাসের শ্রেষ্ঠ মাস। বিশেষ করে এ মাসের প্রথম দশক অতি ফযীলতপূর্ণ। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা এ দশ রাতের কসমও করেছেন। এ দশকের আমল আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
مَا مِنْ أَيّامٍ الْعَمَلُ الصّالِحُ فِيهَا أَحَبّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ يَعْنِي أَيّامَ الْعَشْرِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়েই ঘরে ফিরে আসেনি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৬৮
এ দশকের আমল যেহেতু আল্লাহর কাছে প্রিয় তাই এ সময় নফল নামায, নফল রোযা, তিলাওয়াত, যিকিরসহ যে কোনো নেক আমলই করা যায়। জানা কথা, এ মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হজ্ব ও কুরবানী। হজ্ব-কুরবানীর বাইরে এ দশকের আমল হিসাবে যা পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ :
সম্ভব হলে যিলহজ্বের পুরো নয় দিনই রোযা রাখা (যা কিছু যঈফ বর্ণনায় এসেছে)। পুরো নয় দিন সম্ভব না হলে অন্তত নয় যিলহজ্বের রোযা রাখা চাই। যিলহজ্বের চাঁদ উদিত হওয়া থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকা। বেশি বেশি যিকির-তাসবীহ আদায় করা ইত্যাদি।
আর ফযীলতের ক্ষেত্রে ইয়াওমে আরাফা তথা নয় যিলহজ্বের রোযার ব্যাপারে হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
আফসোস! আজকাল অনেক মানুষের কেন জানি সহীহ ও প্রমাণিত হাদীসসমূহের প্রতি আগ্রহ কম। তাদের যেন জাল-বানোয়াট ছাড়া মন ভরে না। তারা যিলহজ্ব মাসের বেলায়ও ভিত্তিহীন কতক আমল ও ফযীলত আবিষ্কার করেছে। নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরা হল :
১. যিলহজ্ব মাসের বিভিন্ন নামায
ক. যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের দশ দিন পর্যন্ত প্রত্যেক রাত্রে বিতির নামাযের পর প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কাউসার তিন বার…।
খ. যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের জুমার দিন দুই দুই রাকাতের নিয়ত করে মোট ছয় রাকাত নফল নামায আদায় করবে, যার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর পনের বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে…।
গ. শবে তারবিয়ার নামায
তারবিয়ার রাতে যে ব্যক্তি ১৬ রাকাত নফল নামায আদায় করবে…।
ঘ. আরাফার রাতের নামায
যে ব্যক্তি প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে তিন তিন বার সূরা ইখলাস দ্বারা আরাফার রাতে একশত রাকাত…।
ঙ. কুরবানীর পূর্ব রাতের নামায
যে ব্যক্তি কুরবানীর পূর্বের রাতে চার রাকাত নফল নামায আদায় করবে…।
চ. কুরবানীর দিনের নামায
যে ব্যক্তি কুরবানী করার পর নিজ গৃহে কিংবা মসজিদে দুই রাকাত নফল নামায আদায় করবে, তার আমলনামায় হাজীদের এবং কুরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে সওয়াব লেখা হবে।
এভাবে যিলহজ্ব মাসের বিভিন্ন সময়ের সাথে যুক্ত করে করে বিভিন্ন নামায উল্লেখ করা হয়েছে এবং এগুলোর বিশাল বিশাল ফযীলত লেখা হয়েছে।
আল্লামা আব্দুল হাই লখনবী রাহ. জাল হাদীস বিষয়ক লেখা তাঁর কিতাব ‘আলআসারুল মারফূআহ ফিল আহাদীসিল মাউযূআহ’-এ এজাতীয় নামায বিষয়ে স্বতন্ত্র শিরোনাম করেছেন। সেখানে উল্লেখিত বিশেষ নামাযসহ আরো বিভিন্ন ভিত্তিহীন বানোয়াট নামাযের বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলোর অসারতা তুলে ধরেছেন। (দ্র. আলআসারুল মারফূআহ ফিল আহাদীসিল মাউযূআহ, অধ্যায় : যিকরু সালাওয়াতিন ও আদইয়াতিন মাখসূসাহ, পৃ. ১০৩-১১৯)
২. পাঁচ যিলহজ্ব পর্যন্ত ফজরের নামাযের পর বিশেষ দুআ
কোনো কোনোটিতে যিলহজ্বের প্রথম পাঁচ দিন ফজরের নামাযের পর পড়ার বিশেষ দুআ ও তার ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে।
“জিলহজ্জের প্রথম দিনে ফজরের পর এ দোআ পাঠ করবে…। ফজীলত : এ দোআর আমলে কবীরা গুনাহসমূহ মাফ হয়ে সওয়াব বৃদ্ধি হয়…। জিলহজ্জের দ্বিতীয় দিনে…।”
এভাবে পাঁচ জিলহজ্ব পর্যন্ত প্রতিদিন ফজরের পর পড়ার বিশেষ দুআ ও তার বিশাল বিশাল ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
৩. নয় যিলহজ্বের প্রতিদিনের রোযার ভিন্ন ভিন্ন ফযীলত
“যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের প্রথম দিন রোযা রাখে সে যেন আল্লাহর রাস্তায় দুই হাজার বৎসর জিহাদ করল। … যে ব্যক্তি যিলহজ্বের তৃতীয় দিন রোযা রাখে সে ইসমাঈল আ.-এর বংশের তিন হাজার গোলাম আযাদের সওয়াব পাবে। আর যে চতুর্থ দিন রোযা রাখে সে যেন চারশত বৎসর আল্লাহর ইবাদত করল।…” এভাবে যিলহজ্বের বিভিন্ন দিনের রোযার ভিন্ন ভিন্ন ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে।
এসকল বইয়ের কোনো কোনোটিতে এজাতীয় একটি ঘটনাও উল্লেখ করতে দেখা যায়। যেখানে যিলহজ্বের নয় দিন রোযা রাখার ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি নিম্নরূপ :
“এক যুবকের অভ্যাস ছিল, যিলহজ্ব মাসের চাঁদ উঠতেই সে রোযা রাখতে শুরু করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথা জানতে পেরে তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এ দিনগুলোতে রোযা রাখ কেন? …নবীজী তার কথা শুনে বললেন, তোমার প্রতিটি রোযার বিনিময়ে তুমি একশ গোলাম আযাদ করার, একশ উট আল্লাহর রাস্তায় দান করার… সওয়াব পাবে। …আর নয় যিলহজ্বের রোযার বিনিময়ে এক হাজার গোলাম আযাদ করার…।”
যিলহজ্বের রোযার ফযীলত বিষয়ক এ ঘটনাটিও বানোয়াট। ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন, ঘটনাটি প্রমাণিত নয়। জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. তার কথার সমর্থন করেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, এই বর্ণনা জাল না হলে পৃথিবীতে আর কোনো জাল বর্ণনা-ই নেই। (অর্থাৎ এই বর্ণনা জাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।) ইবনে আররাক কিনানী রাহ. তাঁর কথা উদ্ধৃত করে মৌন সমর্থন করেছেন। (দ্র. কিতাবুল মাওযূআত ২/৫৬৪; মীযানুল ইতিদাল ৩/৬৬৯; লিসানুল মীযান ৭/৪০৫; আললাআলিল মাসনূআ ২/১০৭; তানযীহুশ শরীআহ ২/১৪৮; আলফাওয়াইদুল মাজমূআ ১/১২)
যাইহোক, যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন রোযা রাখার কথা কিছু (যঈফ) বর্ণনায় পাওয়া যায়। একটি বর্ণনায় এসেছে- كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের নয়টি দিবস রোযা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৩৪; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৮৩৯৩) কিন্তু এ নয় দিনের রোযার বিশেষ কোনো ঘোষিত ফযীলত নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায় না; শুধু ইয়াওমে আরাফা তথা নয় যিলহজ্বের রোযার ফযীলতের কথা হাদীসে এসেছে, যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি।
মোটকথা, যিলহজ্ব মাস ফযীলতপূর্ণ। বিশেষ করে এর প্রথম দশক। এ দশকের আমল ও তার ফযীলত সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এসকল পুস্তিকার উপরোল্লিখিত এসব আমল ও ফযীলত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এগুলো বিশ্বাস করা যাবে না। আল্লাহ আমাদের ভিত্তিহীন বিষয়গুলো থেকে রক্ষা করুন এবং নির্ভরযোগ্য বিষয়গুলো জেনে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন।
তথ্যসূত্রঃ মাসিক আল কাউসার