ইসলাম

মানুষ কী নিয়ে অহংকার করে?

বহু বিষয় ও নানা নেয়ামত নিয়েই মানুষ অহংকার করে থাকে। তা থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নরূপ

১. ধন-সম্পদধন-

ধন সম্পদ অহংকারের অন্যতম কারণ। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে দু’টি বাগানের মালিক সম্পর্কে ইরশাদ করেন- আর তার ছিল প্রচুর ধন-সম্পদ। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে সে তার সঙ্গীকে বলল, আমার ধন-সম্পদ তোমার চাইতে বেশি এবং জনবলেও আমি অধিক শক্তিশালী। [সূরা কাহফ : ৩৪]

এক লোকের দু’টি আঙুরের বাগান ছিল। বাগান দু’টি খেজুর গাছ দিয়ে বেষ্টিত ছিল। উভয় বাগানের মাঝে অন্যান্য শস্যাদি উৎপন্ন হত এবং বাগানের গাছপালায় নিয়মিত ফল আসত। জমিতে নিয়মিত ফসলাদি উৎপন্ন হত। উভয় বাগান নিয়মিত ফল দিত এবং একটুও কম করতনা। উভয় বাগানের মাঝে ছিল একাধিক প্রবাহিত নহর। এর পাশাপাশি তার ছিল অঢেল ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি এবং বহু চাকর-বাকর ও কর্মচারী

এসবের কারণেই একদিন সে তার এক সঙ্গীকে বিতর্ক প্রসঙ্গে বড়ই অহংকার ও গর্বের সাথে বলল, আমার তো ধন-সম্পদ ও জনশক্তি তোমার চেয়ে অনেক বেশি; আমার চাকর-বাকর, কর্মচারী ও সন্তান-সন্ততির সংখ্যা অধিক। দেখা যাচ্ছে, লোকটি আল্লাহ-র পক্ষ থেকে এতসব নেয়ামত পেয়ে শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের পরিবর্তে বড়াই-অহংকারে লিপ্ত হয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধন-সম্পদ অহংকারের অন্যতমকারণ। [তাফসীরে ইবনে কাসীর : ৩/১০৪-১০৬ সংক্ষেপিত]

অপর এক আয়াতে তিনি ইরশাদ করেছেন -কারূন ছিল মুসার সম্প্রদায়ভুক্ত। অতঃপর সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল। আমি তাকে এত ধন-ভাণ্ডার দান করেছিলাম, যার চাবি বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল।[স্মরণ কর] যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলল, দম্ভ করো না, আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালোবাসেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। [সূরা কাসাস : ৭৬-৭৭ ]

কারূনের সম্প্রদায়ের ঈমানদারগণ তাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিল, আল্লাহ তোমাকে যে ধন-সম্পদ দান করেছেন, তা দ্বারা আখেরাতের শান্তির ব্যবস্থা কর এবং দুনিয়াতে তোমার যে অংশ আছে তা ভুলে যেয়ো না। কিন্তু কারূন তাদের কথা শুনেনি। ঈমানদারদের উপদেশ কানে তোলেনি। বরং সে তার ধন-সম্পদের মোহে অহংকার করে তা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের পরিবর্তে অহংকারে লিপ্ত হয়েছে। ঈমানদারদের উপদেশের জওয়াবে সে বলেছে—إِنَّمَا أُوْتِيْتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي আমি এই ধন-সম্পদ আমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছি। [সূরা কাসাস : ৭৮]

বাহ্যত বোঝা যায় যে, আয়াতে বর্ণিত ‘ইলম’ দ্বারা অর্থনৈতিক কলাকৌশল বোঝানো হয়েছে। উদাহরণত, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি। এর দু’টি অর্থ হতে পারে। যথা—

এক.

আমি যা কিছু পেয়েছি নিজের যোগ্যতার বলে পেয়েছি। এটা কোনো অনুগ্রহ নয়। অধিকার ছাড়াই নিছক দয়া করে কেউ আমাকে এটা দান করেনি। তাই আমার এখন এজন্য এভাবে কারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই যে, যেসব অযোগ্য লোককে কিছুই দেওয়া হয়নি তাদেরকে দয়া ও অনুগ্রহ হিসেবে আমি এর মধ্য থেকে কিছু দেব অথবা আমার কাছ থেকে যাতে এ সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া না হয়। সেজন্য কিছু দান-খয়রাত করব।

মূর্খ কারুন এ কথা বুঝল না যে, বিচক্ষণতা, কর্মতৎপরতা, শিল্প অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য এগুলোও তো আল্লাহ -রই দান ছিল; তার নিজস্ব গুণ-গরিমা ছিল না।

দুই.

এর দ্বিতীয় অর্থ এ-ও হতে পারে যে, আমার মতে আল্লাহ এই যে সম্পদরাজি আমাকে দিয়েছেন তিনি এগুলো আমার গুণাবলি সম্পর্কে জেনেই দিয়েছেন। যদি তাঁর দৃষ্টিতে আমি একজন পছন্দনীয় মানুষ না হতাম, তা হলে তিনি এসব আমাকে কেন দিলেন? আমার প্রতি তাঁর নেয়ামত বর্ষিত হওয়াটাই প্রমাণ করে আমি তাঁর প্রিয়পাত্র এবং আমার নীতি-পদ্ধতি তিনি পছন্দ করেন।

এর জওয়াবে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে অনেক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন, যারা শক্তিতে ছিল তার চাইতে প্রবল এবং ধন-সম্পদে অধিক প্রাচুর্যশীল? পাপীদেরকে তাদের পাপকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে না। [সূরা কাসাস : ৭৮]

কারূনের উক্তির আসল জওয়াব তো এটাই যে, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, তোমার ধন-সম্পদ তোমার বিশেষ কর্মতৎপরতা ও কারিগরি জ্ঞান দ্বারাই অর্জিত হয়েছে, তবুও তো তুমি আল্লাহ -র অনুগ্রহ থেকে মুক্ত হতে পার না। কেননা, এই কারিগরি জ্ঞান ও উপার্জনশক্তিও তো আল্লাহ -রই দান। এই জওয়াব যেহেতু অত্যন্ত সুস্পষ্ট, তাই আল্লাহ এটা উপেক্ষা করে এই জওয়াব দিয়েছেন যে, ধরে নাও, তোমার অর্থ-সম্পদ তোমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারাই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু স্বয়ং এই ধন-সম্পদের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। অর্থের প্রাচুর্য কোনো মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, বরং অর্থ সর্বাবস্থায় তার কাজে লাগে না। প্রমাণ হিসেবে কুরআন অতীত যুগের বড় বড় ধনকুবেরদের দৃষ্টান্ত পেশ করেছে। তারা যখন অবাধ্যতার পথে চলতে থাকে-তখন আল্লাহর আযাব তাদেরকে হঠাৎ পাকড়াও করে। তখন অগাধ ধন-সম্পদ তাদের কোনো কাজে আসেনি।

সুতরাং, এ ব্যক্তি যে নিজেকে বড় পণ্ডিত, জ্ঞানী, গুণী ও চতুর বলে দাবি করে বেড়াচ্ছে এবং নিজের যোগ্যতার অহংকারে মাটিতে পা ফেলছে না, সে কি জানে না যে, তার চেয়েও বেশি অর্থ, মর্যাদা,প্রতিপত্তি, শক্তি ও শান-শওকতের অধিকারী লোক ইতিপূর্বে দুনিয়ায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং আল্লাহ শেষ পর্যন্ত তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন? যোগ্যতা ও নৈপুণ্যই যদি পার্থিব উন্নতির রক্ষাকারী বিষয়হয়ে থাকে, তা হলে যখন তারা ধ্বংস হয়েছিল তখন তাদের এ যোগ্যতাগুলো কোথায় গিয়েছিল? আর যদি কারও পার্থিব উন্নতি লাভ অনিবার্যভাবে এ কথাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ও তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তার কর্ম ও গুণাবলি পছন্দ করেন, তা হলে তাদের সর্বনাশ হল কেন?

এক আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে। অতঃপর যখন আমি তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, ‘এটা তো আমাকে আমার জ্ঞানের কারণে দেওয়া হয়েছে।’ অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না। [সূরা যুমার : ৪৯]

২. ইলম

কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মাঝে অহংকার খুব দ্রুতই বিস্তার লাভকরে। অতি দ্রুতই তারা নিজেদের মধ্যে ইলমের পূর্ণতা ও পর্যাপ্ততা অনুভব করতে শুরু করে। ফলে নিজেকে জ্ঞানী ও বড় ভাবতে থাকে। অন্যদের মূর্খ ও তুচ্ছ জ্ঞান করতে থাকে।

ইলম নিয়ে অহংকার করার কারণ দু’টি :

এক.

মানুষ এমন জ্ঞান চর্চায় লিপ্ত হয়, যাকে সে ইলম বলে ব্যক্ত করে বা ইলম বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ইলমই নয়। কেননা, প্রকৃত ইলম তো হচ্ছে সেটাই, যার মাধ্যমে বান্দা তার রবের পরিচয় লাভ করতে পারে এবং নিজের নফসকেও চিনতে পারে। এ ধরনের ইলম প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ভয় ও বিনয়-নম্রতাই সৃষ্টি করে। প্রকৃত ইলম কখনোও অহংকার সৃষ্টি করে না।

যেমন, আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন— إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمُوا আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল তারাই তাঁকে ভয় করে, যারা ইলমের অধিকারী। [সূরা ফাতির : ২৮]

আয়াতে বলা হয়েছে, কেবল আলেম ও জ্ঞানীরাই আল্লাহ-কে ভয় করে। আল্লাহ -র শক্তিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্রোধ, পরাক্রম, সার্বভৌম কর্তৃত্ব-ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবলি সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতবেশি জানবে, সে তত বেশি তাঁর নাফরমানি করতে ভয় পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ-র সত্তা ও গুণাবলির ব্যাপারে যতবেশি অজ্ঞ হবে, সে তাঁর ব্যাপারে ততবেশি নির্ভীক হবে।

এ আয়াতে জ্ঞান বলে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অংক ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ের জ্ঞান উদ্দেশ্য নয়। বরং এখানে জ্ঞান বলতে আল্লাহর গুণাবলির জ্ঞান বোঝানো হয়েছে। এই আয়াতে [উলামা] বলে এমন লোকদের বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহ -র সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং পৃথিবীর সৃষ্ট বস্তুসামগ্রী, তার পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও আল্লাহ -র দয়া-করুণা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন। কেবল আরবী ভাষা, ব্যাকরণ-অলংকারাদি সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিকেই কুরআনের ভাষায় ‘আলেম’ বলা হয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহ -কে ভয় করে না, সে যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হলেও এ জ্ঞানের দৃষ্টিতে সে নিছক একজন মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ-র গুণাবলি জানে এবং নিজের অন্তরে তাঁরভীতি পোষণ করে, সে ‘অশিক্ষিত’ হলেও জ্ঞানী।

হাসান বসরী বলেন, আলেম তাকে বলে, যে রহমানুর রহীমকে না দেখে ভয় করে এবং আল্লাহ যা পছন্দ করেন তা-ই সে পছন্দ করে ,আল্লাহ যা পছন্দ করেন সে তা বর্জন করে। অতঃপরকরে, তিনি আলোচ্য আয়াত তিলাওয়াত করেন।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, অধিক হাদীস জানার নাম ইলম নয়। ইলম বলে অত্যধিক আল্লাহ ভীতিকে। আহমাদ ইবনে সালেহ ইবনে ওয়াহব রহ. এর সূত্রে মালেক থেকে বর্ণনা করেন, বহু হাদীস বর্ণনাকারীকে আলেম বলা হয় না।ইলম হল নূর, যা আল্লাহ মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করেন। [তাফসীরে ইবনে কাসীর : ৩/৬৭৩]

দুই.

ইলম অর্জন ও চর্চায় এমন ব্যক্তির লিপ্ত হওয়া, যার অন্তর নাপাকিতে ভরপুর; যার চরিত্রও অতি নিকৃষ্ট। ফলে যখনই সে কোনো কিছু জানতে বা হাসিল করতে পারে, তখন সে তা নিয়ে অহংকার করতে শুরু করে। তার জানার পরিধি যতই বাড়তে থাকে, তার অহংকারের মাত্রাও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমন, কবি মাআররা আল-আরী নিজের প্রশংসায় বলেছিল- وَإِنِّي وَإِنْ كُنْتُ الْأَخِيْرَ زَمَانُهُ لَآتٍ بِمَا لَمْ يَأْتِ بِهِ الْأَوَائِلُ আমি যদিও যুগের বিচারে শেষ যামানায় এসেছি, কিন্তু আমি এমন জিনিস নিয়ে এসেছি, যা পূর্ববর্তীরা নিয়ে আসতে পারেনি।[অফায়াতুল আ’ইয়ান লি-ইবনি খল্লিকান : ১/৪৫০]

এ-ও অহংকার

যেমনটা বর্তমান যামানার কোনো কোনো ছাত্র-শিক্ষার্থী করে থাকে।ছোট ছোট তালিবুল ইলমরা নিজেদের বড় বড় উলামায়ে কেরামের সমকক্ষ মনে করে বসে এবং এমন এমন কথা বলে, যা তাদের পক্ষে কখনোই সমীচীন নয়। এমনকি তারা এতটুকু বলতেও দ্বিধাবোধ করে না – هُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ. তারাও মানুষ আমরাও মানুষ!!

আবু আইয়ূব আল-আত্তার বলেন, আমি বিশর ইবনুল হারিস কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমাকে হাম্মাদ ইবনে যায়েদ হাদীস বর্ণনা করেছেন… এ কথা বলেই তিনি বলে ওঠলেন- আস্তাগফিরুল্লাহ! নিশ্চয় সনদ বর্ণনা করার দ্বারাও অন্তরে অহংকার সৃষ্টি হয়। [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা : ৭/৪৬১]

৩. আমল ও ইবাদত

কিছু কিছু মানুষ নিজের ইবাদতের কারণে অহংকার করে। সে মনে করে মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব হচ্ছে— তারা তাকে অগ্রাধিকার দেবে, তার তাকওয়া-তহারত ও বুযুর্গি নিয়ে আলোচনা করবে। সে মনে করে, মানুষ সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত আর সে নাজাতপ্রাপ্ত।

আবু হুরায়রা (রা,) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা,) ইরশাদ করেছেন- إِذَا قَالَ الرَّجُلُ هَلَكَ النَّاسُ ، فَهُوَ أَهْلَكُهُمْ . قَالَ أَبُو إِسْحَاقَ لَا أَدْرِى أَهْلَكَهُم بِالنَّصْبِ أَوْ أَهْلَكُهُمْ بِالرَّفْعِ .

যদি কোনো লোক বলে ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে’, তা হলে সে তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত। আবু ইসহাক রহ. বলেন, আমি জানি না যে, [নবীজি ] أهلكهم শব্দটি যবরের সাথে ‘সে তাদের ধ্বংস করেছে’ বলেছেন, না পেশ এর সাথে ‘সে তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত’ বলেছেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৮৫০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৯৮৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৭৬৮৫]

ইমাম নববী বলেন, নবীজি (সা,) এর বাণী— إِذَا قَالَ الرَّجُلُ هَلَكَ النَّاسُ ، فَهُوَ أَهْلَكُهُمْ. এর أهلكهم শব্দটির ‘কাফ’ বর্ণের ই‘রাবে দু’টি পদ্ধতি প্রসিদ্ধ আছে।কাফ বর্ণ যবরের সাথেও পড়া হয়, আবার পেশের সাথেও পড়া হয়।তবে পেশ দিয়ে পড়াই অধিক প্রসিদ্ধ। তখন এর অর্থ দাঁড়ায়-মানুষের মাঝে সে-ই সবচেয়ে বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর যদি কাফ বর্ণে যবর দিয়ে পড়া হয়, তা হলে তার অর্থ হয়— সে অন্যান্য লোককে ধ্বংস করেছে বা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। [এ বলে সে ঘোষণা দিয়েছে।] প্রকৃতপক্ষে তারা ধ্বংস হয়নি।

তবে উলামায়ে কেরাম এ কথার উপর একমত যে, এখানে যে নিন্দা করা হয়েছে, তা ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে মানুষকে এ কথা বলে তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ও নিকৃষ্ট মনে করে এবং নিজেকে তাদের চেয়ে উত্তম মনে করে। মানুষের অবস্থাকে মন্দ মনে করে।কেননা, সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ -র হিকমত ও গোপন রহস্য তোসে জানে না; আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না ।

তবে কেউ যদি বর্তমান যামানায় নিজের মাঝে ও অন্যান্যদের মাঝে দ্বীনি বিষয়ে যে দুরাবস্থা বিদ্যমান তা নিয়ে আফসোস ও দুঃখ করে একথা বলে, তা হলে তাতে কোনো দোষ নেই। সেটা অহংকারেরপর্যায়ে পৌঁছবে না। যেমন, উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-دَخَلَ عَلَيَّ أَبُو الدَّرْدَاءِ وَهُوَ مُغْضَبٌ فَقُلْتُ مَا أَغْضَبَكَ؟ فَقَالَ وَاللَّهِ مَاأَعْرفُ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَيْئًا إِلَّا أَنَّهُمْ يُصَلُّوْنَ جَمِيعًا. একবার আবুদ্দারদা (রা,) ভীষণ রাগান্বিত অবস্থায় আমার কাছে এলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীসে আপনাকে রাগান্বিত করেছে? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ [সা, ] এর উম্মতের মধ্যে জামাতের সাথে সালাত আদায় ব্যতীত তাঁর তরীকার আর কিছুই দেখছি না। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৫০,মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৭৫০০]

ইমাম মালেক এমনই ব্যাখ্যা করেছেন এবং অন্যরা তাঁর অনুসরণ করেছেন। [শরহুন নববী আলা মুসলিম : ১৬/১75] ইবনুল জাওযী বলেন, বেশধারী কোনো কোনো সূফী, যে গাফলতের শিকার, সে মনে করে সে আল্লাহর অতি প্রিয় ও মাহবুব ওলী। কখনও কখনও অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও নিকৃষ্টও জ্ঞান করে। মনে করে তার মর্যাদা ও অবস্থান কেবল তার জন্যই সংরক্ষিত। কয়েক রাকাত সালাত, যার জন্য সে কষ্ট করেছে কিংবা সামান্য কিছু ইবাদত যা সে সম্পাদন করেছে, তাকে খুব দ্রুতই ধোঁকায় ফেলে দেয়। কখনও কখনও মনে করে, সে পৃথিবীর কুতুব এবং তার মর্যাদা ও স্তরে তার পরে সে ছাড়া আর কেউ উন্নীত হতে পারবে না। [ছইদুল খাতির : ১৩৫]

আল্লামা খাত্তাবী তাঁর ‘আল-আযলা’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন, একবার আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক খোরাসানে পৌঁছলেন। তিনি সেখানকার তাকওয়া-পরহেযগারি ও দ্বীনদারিতে প্রসিদ্ধ এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা করলেন। যখন তিনি তার ঘরে প্রবেশ করলেন, তখন লোকটি তাঁর দিকে একবার তাকালোও না। বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপও তার কাছ থেকে বের করল না। ফলে আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক হয়ে চলে এলেন। এমন সময় তার এক সঙ্গী তাকে বলল, আপনি কি জানেন ইনি কে? সে বলল, না। সঙ্গী বলল, ইনি হাদীস শাস্ত্রের আমীরুল মুমিনীন আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক।

কথা শুনে লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। ওজর পেশ করে নিজের আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করল। অতঃপর বলল, হে আবু আবদুর রহমান! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং উপদেশ দিন!

আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক বললেন, হাঁ, যখন তুমি তোমার ঘর থেকে বের হবে, তখন যার উপর তোমার দৃষ্টি পড়বে, তুমি মনে করবে সে তোমার থেকে উত্তম!এ কথা বলার কারণ— তিনি দেখেছেন লোকটি আত্মমুগ্ধ ও অহংকারী।সে নিজেকে বড় মনে করে। [আল-আযলা : ২২০]

এই হচ্ছে ধোঁকায় নিমজ্জিত এক অহংকারীর অবস্থা। অথচ আমাদের সালাফে সালেহীনের একজন বলেছিলেন— আমি আরাফায় অবস্থানকারীদের দিকে তাকিয়ে ধারণা করলাম, তাদের সকলকেই ক্ষমা করে দেওয়া হত- যদি আমার মতো গুনাহগার তাদের মাঝে না থাকত। [বাইহাকী ফী শুআবিল ঈমান : ৮২৫২ বকর ইবনে আবদুল্লাহআল-মুযানী রহ. এর সূত্রে]

একজন খাঁটি মুমিন সবসময় নিজেকে এবং নিজের আমলকে ছোটমনে করে। উমর ইবনে আবদুল আযীয কে একবার বলা হল,আপনার ইন্তেকালের পর আমরা আপনাকে নবীজি -র ঘরে দাফন করব।তখন তিনি বললেন, একমাত্র শিরক ছাড়া বাকি সকল গুনাহ নিয়ে আল্লাহ -র সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার কাছে নিজেকে এর যোগ্য মনে করা থেকে উত্তম। [গিয়াউল আলবাব ফী শরহি মানযূমাতিলআদাব : ২/২২৯]

৪.বংশ

কিছু লোক আছে এমন, যারা উচ্চ বংশীয় হওয়ার কারণে তাদের তুলনায় নীচু বংশের লোকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হেয় করে। অহংকার করে। অহংকারবশত মানুষের সঙ্গে চলাফেরা, ওঠাবসা ও মেলামেশা করতে চায় না। নাক ছিটকায়। কখনও কখনও তার এ অহংকার জবানেও প্রকাশ পেয়ে যায়। বলে- তুমি কে? তোমার বাবা কে? আমার মতো মানুষের সঙ্গে তুমি কথা বলছ?!

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- كَانَ عُمَرُ يَقُوْلُ أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا يَعْنِي بِلالا .আবু বকর [রা,] আমাদের নেতা এবং তিনি মুক্ত করেছেন আমাদের আরেক নেতাকে। অর্থাৎ বেলাল [রা,] কে। [সহীহবুখারী, হাদীস নং ৩৭৫৪]

[এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য, হযরত উমর-র মতো ব্যক্তি, উঁচু ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় হওয়া সত্ত্বেও বেলাল -কে নিজেদের সরদার বা নেতা বলে আখ্যায়িত করেছেন, অথচ বেলাল গোলাম, যাঁর বংশও উল্লেখ করার মতো না। ]

মা‘রূর ইবনে সুওয়াইদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—رَأَيْتُ عَلَى أَبِي ذَرٍّ بُرْدًا وَعَلَى غُلَامِهِ بُرْدًا فَقُلْتُ لَوْ أَخَذْتَ هَذَا فَلَبِسْتَهُكَانَتْ حُلَّةً وَأَعْطَيْتَهُ ثَوْبًا آخَرَ فَقَالَ كَانَ بَيْنِي وَبَيْنَ رَجُلٍ كَلَامُ وَكَانَتْأُمُّهُ أَعْجَمِيَّةٌ فَتِلْتُ مِنْهَا فَذَكَرَني إلَى النَّبيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَلِي أَسَابَبْتَ فُلَانًا؟ قُلْتُ نَعَمْ، قَالَ أَفَنِلْتَ مِنْ أُمِّهِ؟ قُلْتُ نَعَمْ، قَالَ إِنَّكَامْرُو فِيْكَ جَاهِلِيَّةٌ ، قُلْتُ عَلَى حِيْنِ سَاعَتِيْ هَذِهِ مِنْ كِبَرِ السِّنِّ؟ قَالَنَعَمْ ، هُمْ إِخْوَانُكُمْ جَعَلَهُمْ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ فَمَنْ جَعَلَ اللَّهُ أَخَاهُتَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ وَلَا يُكَلِّفُهُ مِنْالْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ فَإِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ.

আমি আবু যর রা,-এর উপর একখানা চাদর দেখলাম এবং তাঁর গোলামের উপরও তেমনই একখানা চাদর দেখলাম। অতঃপর আমি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললাম, যদি আপনি [গোলামের গায়ের] ওই চাদরটি নিতেন এবং পরিধান করতেন, তা হলে আপনার একটি জোড়া হয়ে যেত এবং গোলামকে আপনি অন্য আরেকটি কাপড় দিয়ে দিতেন। তখন আবু যর বললেন,একদিন আমার ও অন্য এক লোকের মধ্যে কথা হচ্ছিল। তার মা ছিল অনারবী মহিলা। আমি তার মাকে গালি দিলাম। তখন লোকটি নবী কারীম (সা,) -এর কাছে আমার কথা বলল [অভিযোগকরল।] তখন নবীজি (সা,) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি অমুককে গালি দিয়েছ? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, তুমিকি তার মাকেও গালি দিয়েছ? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন,নিশ্চয় তুমি এমন এক লোক যার মধ্যে জাহেলী যুগের স্বভাব রয়ে গেছে। আমি বললাম, এখনও? আমার এ বৃদ্ধ বয়সেও?! তিনি বললেন, হাঁ। [আর শুনে রাখ!] তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং, আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীন করে দেন সে যেন নিজে যা খায়, তাকেও তা-ই খাওয়ায়। সে নিজে যা পরে, তাকেও যেন তা-ই পরায়।আর তার উপর যেন এমন কোনো কাজ না চাপায়, যা তার সাধ্যাতীত। আর যদি তার উপর এমন কোনো কঠিন কাজের ভার দিতেই হয়, তা হলে সে নিজেও যেন তাকে সাহায্য করে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০50]

ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, নবীজি-(সা,)-এর বাণী—“তারা তোমাদের ভাই’ এর অর্থ হচ্ছে তোমাদের গোলাম কিংবা খাদেম-চাকরগণ। যাতে যারা গোলাম নয়, তারাও এবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়… এ হাদীসে কাউকে গালি দেওয়া ও লা‘নত করার ব্যাপারে কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। কারণ, এতে একজন মুসলিমকে তুচ্ছ জ্ঞান ও হেয় করা হয়। অথচ ইসলামী শরীয়ত তার প্রায় সকল হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রেই সমস্ত মুসলমানের মাঝে সমতার বিধান দিয়েছে। তাদের মাঝে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাগতপার্থক্য নির্ণিত হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। সুতরাং, কারও ভেতর যদি তাকওয়া না থাকে, তা হলে তার উচ্চ বংশ বা বংশীয় মর্যাদা তার কোনো কাজে বা উপকারে আসবে না। অপরদিকে কারও মাঝে তাকওয়া থাকলে সে নিচু বংশীয় হলেও তা তার কাজে আসবে। যেমন, আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ) তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। [সূরা হুজুরাত : ১৩][ফাতহুল বারী : ১০/468]‌

নবীজি (সা,)-এর বাণী- ‘তুমি এমন এক লোক,যার মধ্যে জাহেলী যুগের স্বভাব রয়ে গেছে।’ অর্থাৎ তোমার মধ্যে জাহেলী যুগের স্বভাবসমূহের মধ্য থেকে একটি স্বভাব রয়ে গেছে। হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়, আবু যর থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কারণ— তখনও তিনি গালি দেওয়া হারাম হওয়ার বিষয়টি জানতেন না। ফলে জাহেলী যুগের এই একটি স্বভাব তখনও তাঁর মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। এ জন্যই তো তিনি কিছুটা আশ্চার্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করেছেন- ‘আমার এ বৃদ্ধবয়সেও?’ যেন তাঁর এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি তাঁর কাছে অজানা থাকায় তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। ফলে নবীজি বিষয়টি তাঁর সামনে স্পষ্ট করে দিলেন যে, এটি একটি মন্দ ও নিন্দিত স্বভাব।[ফাতহুল বারী : ১/৮7]

বই : অহংকার করবেন না

লিখক : শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *