ইসলাম

জীবনের উপর অহংকারের প্রভাব

অহংকারীর আচার-আচরণ-উচ্চারণ ও সামগ্রিক জীবনে অহংকারের খুবই খারাপ প্রভাব পড়ে। তার কয়েকটি উদাহরণস্বরূপ নিম্নরূপ। যথা—

১. ঈমান, ইবাদত ও আনুগত্য থেকে বিরত থাকা

অহংকারী আল্লাহ র উপর ঈমান আনয়ন তাঁর ইবাদত পালন ও তার আনুগত্য-অনুসরণ থেকে বিরত থাকে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন—ন[ঈসা] মাসীহ কখনও আল্লাহর বান্দা হওয়াকে লজ্জার বিষয় মনে করে না এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারাও না। আর যে কেউ তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, অচিরেই তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন। অতঃপর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে তাদের পুরস্কার পরিপূর্ণ দান করবেন এবং তাঁর অনুগ্রহে তাদেরকে বাড়িয়ে দেবেন। পক্ষান্তরে যারা লজ্জাবোধ করেছে এবং অহংকার করেছে, তিনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন। আর তারা তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। [সূরা নিসা : ১৭২-১৭৩]

আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেছেন- নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং এগুলো থেকে অহংকার করেছে, তাদের জন্য আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না- যে পর্যন্ত না সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। আর এভাবেই আমি অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকি। তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের বিছানা এবং তাদের উপরে থাকবে [আগুনের] চাদর। আর এভাবেই আমি জালিমদের শাস্তি প্রদান করে থাকি। [সূরা আরাফ : ৪০-৪১]

২. মানুষকে অবজ্ঞা করা

মানুষকে অবজ্ঞা করা ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, লুকমান হাকীম তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, আর তুমি মানুষের প্রতি অবজ্ঞাভরে তোমার গাল বাঁকা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। [সূরা লুকমান : ১৮] تصعير الخد للناس এর অর্থ হচ্ছে, অহংকার করে মানুষের দিক থেকে চেহারা ফিরিয়ে নেওয়া।

المشي في الارض مرحا এর অর্থ হচ্ছে, জমিনের উপর অহংকার করে হাঁটা, বুক ফুলিয়ে চলা।ق

ان الله لا يحب كل مختال فخور ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ অর্থাৎ যারা মানুষের সাথে অহংকার করে, গর্ব করে, বড়াই করে,আল্লাহ এমন কাউকে পছন্দ করেন না; ভালোবাসেন না।

‘অহংকারী’ বলে উদ্দেশ্য, যারা নিজের সত্তা, শক্তিমত্তা, ধন- সম্পদ কিংবা নিজের মেধা ইত্যাদি নিয়ে গর্ব ও অহংকার করে। আল্লাহ পৃথিবীতে অহংকার ও দম্ভভরে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। যেমন, তিনি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- আর পৃথিবীতে দম্ভভরে চলাফেরা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ-পৃষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত সমান পৌঁছতে পারবে না। [বনী ইসরাঈল : ৩৭]

অহংকারীদের অভ্যাস হচ্ছে জমিনে বুক ফুলিয়ে হাঁটা, দম্ভভরে চলাফেরা করা। পক্ষান্তরে মুমিনদের গুণ হচ্ছে, তারা বিনয়ের সাথে চলাফেরা করে, স্বাভাবিকভাবে হাঁটে।

আল্লাহ মুমিনদের স্বভাব ও গুণ বর্ণনা করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- আর রহমান এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে, তখন তারা বলে- সালাম। [সূরা ফুরকান : ৬৩]

সালাফে সালেহীন হাঁটাচলা ও চলাফেরার সময় খুব সাবধানতা অবলম্বন করতেন এবং নিজেদের সংকুচিত করে রাখতেন। যেমন, খালিদ ইবনে মি‘দান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমর ইবনে আসওয়াদ আল-আনাসী
যখন মসজিদ থেকে বের হতেন, তখন তিনি ডান হাত দিয়ে বাম হাতকে চেপে ধরতেন। এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, আমার ভয় হয় আমার হাত মুনাফিকি করবে।

ইমাম যাহাবী বলেন, তিনি [অন্যায় ও অহংকার-প্রকাশক] নাড়াচাড়া এবং দোলানোর আশঙ্কায় স্বীয় হাত চেপে ধরে রাখতেন। কেননা, এ ধরনের নাড়াচাড়া ও দোলানোও অহংকারের অন্তর্ভুক্ত।[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা : ৪/৮০, তারীখে দিমাশক : 45/417]

আলী ইবনে হুসাইন যখন হাঁটতেন, তখন তাঁর হাত উরু অতিক্রম করত না এবং তিনি হাত নাড়াচাড়া করতেন না। [সিয়ারুআ’লামিন নুবালা : ৪/392]

৩. কাপড় টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পড়া

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা,) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা,) ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ [কেয়ামতের দিন] ওই ব্যক্তির প্রতি [দয়ার দৃষ্টিতে] তাকাবেন না, যে অহংকার করে স্বীয় কাপড় ঝুলিয়ে পড়ে।[সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৭৮৩, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং৫৫৭৪, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০৮৭]

ইমাম নববী বলেন, উলামায়ে কেরাম বলেছেন- الخيلاء والمخيله والبطر والكبر والزهو واتبختر এ সবগুলো শব্দের অর্থ একই অর্থাৎ অহংকার এবং তা হারাম।

জাবের ইবনে সুলাইম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করুন। তিনি বললেন, তুমি কখনও কাউকে গালি দেবে না। বর্ণনাকারী বলেন, এর পরে আমি কখনও কোনো স্বাধীন বা গোলাম ব্যক্তি কিংবা উট, ছাগল ইত্যাদি কোনো কিছুকেই গালি দিইনি। নবীজি আরও বললেন, তুমি কখনও কোনো ভালো কাজকে অবজ্ঞা করবে না। তোমার ভাইয়ের সাথে তুমি হাসিমুখে কথা বলবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো কাজ।তোমার পরিধেয় কাপড় পায়ের গোছার মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠিয়ে রাখবে। যদি তা না কর তা হলে টাখনু পর্যন্ত রেখো। কাপড় টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পড়া থেকে বেঁচে থেকো। কেননা, এটা অহংকারের অন্তর্ভুক্ত। আর নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারকে পছন্দকরেন না। কেউ যদি তোমাকে গালি দেয় এবং তোমার মধ্যকার জানা কোনো দোষ উল্লেখ করে তোমাকে মন্দ কথা বলে, তাহলে তুমি তাকে তার মধ্যকার জানা কোনো দোষের কথা উল্লেখ করে মন্দ কথা বলো না। কেননা, এর প্রতিফল তার উপরই বর্তাবে। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০৮৬]ব

র্তমানে টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পড়া ছাড়াও কাপড়-চোপড়, পোশাক-আশাকে এমন অনেক বিষয় পাওয়া যায়, যা অহংকার-প্রকাশক। যেমন, পোশাকের ডিজাইন, ধরন, গর্ব ও বড়াই করার জন্য নামিদামি বিভিন্ন ব্রান্ডের বহুমূল্যের কাপড় ক্রয়, যাতে থাকে অপচয় ও অপব্যয় ইত্যাদি।

৪. মানুষের ছোটাছুটি ও দাঁড়িয়ে সম্মান করাকে পছন্দ করা

আবু মিজলায থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- মুআবিয়া (রা,) [একবার] ইবনে যুবাইর (রা,) ও ইবনে আমের (রা,) এর কাছে এলেন। তখন ইবনে আমের (রা,) দাঁড়িয়ে গেলেন আর ইবনে যুবাইর (রা,) বসে রইলেন। তখন মুআবিয়া (রা,) ইবনে আমের (রা,)-কে বললেন, তুমি বসো। আমি রাসূলুল্লাহ (সা,)-কে বলতে শুনেছি— যে এটা পছন্দ করে যে, লোকেরা তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করুক, সে যেন নিজের ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৫২৩১, সুনানে তিরমিযী,হাদীস নং ২৭৫৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৬৯১৮]

৫. কথা বলায় বাড়াবাড়ি

জাবের (রা,) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা,) ইরশাদ করেছেন- .তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কেয়ামত দিবসেও আমার খুব নিকটে থাকবে, তোমাদের মধ্যে যার চরিত্রও আচরণ সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত এবং কেয়ামত দিবসে আমার থেকে অনেক দূরে থাকবে- ছারছারুন, মুতাশাদ্দিকুন ও মুতাফাইহিকুন। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ছারছারুন [যারা বাচাল, অতিরিক্ত কথা বলে], মুতাশাদ্দিকুন [যারা মানুষের সামনে লম্বা লম্বা কথা বলে বেড়ায় এবং খৃষ্ট ও নির্লজ্জ] এ দু’ধরনের লোকদের তো আমরা চিনি-জানি, কিন্তু মুতাফাইহিকূন কারা? নবীজি বললেন, অহংকারীরা। [সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২০১৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৭৭৩2]

৬. ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা

মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, নিন্দা-তিরস্কার করা, মানুষের ছিদ্রান্বেষণ করা এবং মানুষকে মন্দ উপাধিতে ডাকা। একজন অহংকারী অন্যান্য মানুষের তুলনায় নিজেকে বড় মনে করে। ফলে সে নিজেকে ছাড়া অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং তাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদেরকে বিকৃত নাম ও মন্দ উপাধিতে ডাকে। তাদের নিয়ে মশকরা করে।

৭. গীবত করা

অহংকারী সবসময় নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় ও মর্যাদাসম্পন্ন বলে প্রকাশ করতে চায়। ফলে সে অন্যদের দোষচর্চা, দুর্বলতা বর্ণনা ও গীবত করাকে নিজের বড়ত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।

৮. দরিদ্রদের সঙ্গে না মেশা

দুর্বল, অসহায়, দরিদ্র ও মিসকিন লোকদের সাথে ওঠাবসা, চলাফেরা ও মেলামেশা করা থেকে বিরত থাকা। অহংকারী ব্যক্তি ধন-সম্পদ, বংশ কিংবা সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে যাকে নিজের চেয়ে ছোট মনে করে, তার সাথে চলাফেরা ও ওঠাবসাকে সে খারাপ মনে করে।

এই মানসিকতাই কিছু কিছু মুশরিকের ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা হয়েদাঁড়িয়েছিল। যেমন, সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন-.আমরা ছয় জন লোক রাসূলুল্লাহ (সা,) -এর সঙ্গে ছিলাম। তখন মুশরিকরা নবীজি (সা,) -কে বলল, আপনি এসব লোককে আপনার নিকট থেকে বিতাড়িত করুন। যাতে তারা আমাদের মাঝে আগমনের সাহস না পায়। সা’দ (রা,) বলেন, তন্মধ্যে ছিলাম আমি, ইবনে মাসউদ, হুযাইল গোত্রের একজন লোক, বিলাল এবং আরও দু’জন লোক, যাদের নাম আমি নিচ্ছি না। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা,)-এর অন্তরে আল্লাহ যা চাইলেন, তা জাগল। তিনিমনে মনেই কথা বললেন। এমন সময় আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন- ‘যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে আহ্বান করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, আপনি তাদেরকে আপনার মজলিস থেকে তাড়িয়ে দেবেন না। -সূরা আনআম : ৫২’ [সহীহমুসলিম, হাদীস নং ৬৩৯৪]

এ ব্যাপারে হযরত খাব্বাব (রা,) থেকে বর্ণিত, একদিন আকরা ইবনে হাবিস আত-তামীমী ও উয়াইনাহ ইবনে হিসন আল-ফাযারী রাসূলুল্লাহ-(সা,) এর কাছে এল। এসে তারা রাসূলুল্লাহ (সা,) -কে সুহাইব, বিলাল,আম্মার ও খাব্বাব প্রমুখ দরিদ্র অসহায় মুমিনদের সাথে বসা দেখল। তারা নবীজি (সা,) -র চারপাশে তাদের উপবিষ্ট দেখে তাদেরকে হেয় জ্ঞান করল। তারা নবীজির কাছে এসে একান্তে তাঁকে বলল, আমরা চাই আপনি আপনার সাথে আমাদের বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন, যাতে আরবরা আমাদের মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে। কেননা, আপনার নিকট আরবের প্রতিনিধি দলসমূহ আসে। এই দাসদের সাথে আরবরা আমাদের উপবিষ্ট দেখলে তাতে আমরা লজ্জাবোধ করি। অতএব, আমরা যখন আপনার কাছে আসব তখন আপনি এদের আপনার কাছ থেকে উঠিয়ে দেবেন। আমরা আপনার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আপনি ইচ্ছা করলে তাদের সাথে বসুন।

নবীজি বললেন, আচ্ছা! তারা বলল, তা হলে আপনি আমাদের জন্য একটি চুক্তিপত্র লিখিয়ে দিন। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজি কাগজ আনালেন এবং আলী-কে লেখার জন্য ডাকলেন। আমরা তখন এক পাশে বসা ছিলাম।ইত্যবসরে জিবরাইল এই আয়াত নিয়ে অবতরণ করলেন—যারা তাদের প্রতিপালককে সকাল-সন্ধ্যায় ডাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, তাদের আপনি তাড়িয়ে দেবেন না। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও আপনার দায়িত্বে নয় এবং আপনার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, আপনি তাদের বিতাড়িত করবেন। নতুবা আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। [সূরা আনআম : ৫২]

অতঃপর আল্লাহ আকরা ইবনে হাবিস এবং উয়াইনা ইবনে হিসন সম্পর্কে নাযিল করেন- এভাবেই আমি তাদের এক দলকে অন্য দল দ্বারা পরীক্ষা করেছি,যেন তারা বলে, আমাদের মধ্যে কি এদের প্রতিই আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন? আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্পর্কে বিশেষ অবহিত নন? [সূরা আনআম : ৫৩]

অতঃপর আল্লাহ বলেন- *আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে তারা যখনআপনার কাছে আসে, তখন আপনি তাদের বলুন— তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের প্রতিপালক দয়া করা তার কর্তব্য বলে স্থির করে নিয়েছেন। [সূরা আনআম : ৫৪]

বর্ণনাকারী বলেন, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর আমরা তাঁর এত নিকটবর্তী হলাম যে, আমাদের হাঁটু তাঁর হাঁটুর সাথে লাগিয়ে বসলাম।আর রাসূলুল্লাহ -ও আমাদের সাথে বসতেন এবং যখন উঠে যাওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন আমাদের রেখে দাঁড়িয়ে যেতেন। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন- আর আপনি নিজেকে ধৈর্যশীল রাখুন তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে।[সূরা কাহফ : ২৮]

খাব্বাব বলেন, অতঃপর আমরা নবীজি -র সাথে বসতাম। যখন তাঁর ওঠার সময় হত, তখন আমরা তাঁর আগে উঠে যেতাম এবং তাঁকে ছেড়ে দিতাম। অতঃপর তিনি ওঠতেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩১২৭]

৯. মন্দ ও নিকৃষ্ট কাজে লেগে থাকা

মানুষের মধ্যে অহংকারীই নিজেকে সংশোধন করা থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে থাকে। অহংকারী নিজের দোষত্রুটি ও বিচ্যুতি সমূহের ইসলাহ ও প্রতিকারের চিন্তা কখনোই করে না। কেননা, সে নিজেকে একজন পরিপূর্ণ ও নির্দোষ মানুষ বলে মনে করে। ফলে তার কোনো দোষ থাকতে পারে বলে সে মনে করে না এবং কোনো উপদেশকারীর উপদেশও গ্রহণ করে না। ফলে সে আজীবন তার দোষত্রুটি ও কমতি সমূহের মধ্যেই ডুবে থাকে এবং এক সময় এ অবস্থায়ই তার জীবনের পরিক্রমা শেষ হয়ে যায়।হতে হতে এক সময় তার অবস্থা হয় তাদের মতো, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- [হে নবী!] আপনি বলুন, আমি কি তোমাদের সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে পণ্ডহয়ে যায়, অথচ তারা মনে করে তারা সৎকর্ম করছে। [সূরা কাহফ : ১০৩-১০৪]

১০. উপদেশ গ্রহণ না করা

অহংকারী কখনও কারও উপদেশ গ্রহণ করে না। সে মনে করে, সে-ইতো সবার বড়, সে আবার কার কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে? আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-আর যখন তাকে বলা হয় ‘আল্লাহকে ভয় কর তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপ করতে উৎসাহ দেয়। সুতরাং, তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট এবং তা কতই না মন্দ ঠিকানা। [বাকারা : ২০৬]

১১. ইলম অর্জন না করা

মুজাহিদ (র.) বলেন, লাজুক ও অহংকারী [এই দুই শ্রেণির মানুষ]ইলম অর্জন করতে পারে না। [ইমাম বুখারী তা’লীকান-টীকায়— কথাটি বর্ণনা করেছেন। অধ্যায় : ইলম শিক্ষা করতে লজ্জাবোধ করা। আবু নুআইম বর্ণনা করেছেন হিলয়াতে :৩/২৮৭, আর ইবনে হাজার আসকালানী ফাতহুল বারীতে ১/২২৯ বর্ণনা করেন, ইমাম মুজাহিদ এর এ কথাটি আলী ইবনুল মাদীনীর সনদে আবু নুআইম এর কাছে পৌঁছে। তিনি ইবনে উয়াইনা থেকে আর তিনি মানসূর থেকে বর্ণনা করেন। মুসান্নাফের শর্তানুযায়ী সনদটি সহীহ]

অহংকার সর্বদা অহংকারীকে নিজের চোখে অন্যদের চেয়ে বড় ওমর্যাদাসম্পন্ন করে দেখায়। ফলে সে অন্য কারও কাছ থেকে ইলম,প্রজ্ঞা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা কোনো কিছুই অর্জন করে না। অর্জন করতে রাজি হয় না। ফলে সে আজীবনই মূর্খ ও সংকীর্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন রয়ে যায়।

১২. আগে সালাম না দেওয়া

অহংকারী ব্যক্তি কারও সাথে সাক্ষাৎ হলে কখনও আগে সালাম দেয়না। বরং সে মনে করে সকলের কাছ থেকে সে সালাম পাওয়ার হকদার। কারও সালামের জওয়াব দিলে সে মনে করে সালামদাতার উপর সে অনেক বড় অনুগ্রহ করেছে। সে মানুষের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করে না। ভালো ব্যবহার ও উত্তম আচরণ করে না। প্রফুল্ল বদনে কথা বলে না। তার উপর কারও কোনো হক আছে বলে সে মনে করে না। বরং মনে করে মানুষের উপর তার অনেক হক রয়েছে। তার উপর কারও মর্যাদা আছে বলে সে মনে করে না। বরং সকলের উপরই সে তার নিজের মর্যাদা দেখতে পায়। এভাবে সে আল্লাহ থেকে কেবল দূরেই সরতে থাকে এবংমানুষের দৃষ্টিতে সে প্রতিনিয়ত ছোট, হীন ও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হতে থাকে। [আর-রূহ : ২৩৬]৫৩

১৩. একাকী চলাফেরা না করা

অহংকারী ব্যক্তি সাধারণত কখনও একাকী চলাফেরা করে না। যখনই সে কোথাও বের হয়, তার পেছনে কেউ না কেউ চলতে থাকে। কোনো মজলিসে উপস্থিত হলে সে মজলিসের সামনে বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসতে চায়। সর্বদাই মানুষের মাঝে নিজের প্রসিদ্ধি ও সুখ্যাতিকামনা করে। পক্ষান্তরে যারা বিনয়ী তারা এগুলোকে অপছন্দ করে; এসব থেকে দূরে থাকে। আমের ইবনে সা’দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-.সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা,) তাঁর উটের পালের মধ্যে ছিলেন। এমন সময় তাঁর ছেলে উমর এলেন। সা’দ (রা, যখন তাকে দেখলেন, তখন বলে ওঠলেন— আমি এ বাহনের আরোহীর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। উমর বাহন থেকে নামলেন এবং বললেন, আপনি আপনার উট ও ছাগল নিয়ে পড়ে আছেন আর মানুষকে ছেড়ে দিয়েছেন তারা রাজত্ব ও বাদশাহি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত?! সা’দ (রা, পুত্র উমরের বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন, তুমি চুপ কর। আমি রাসূলুল্লাহ (সা,) -কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ ভালোবাসেন মুত্তাকী, মানুষ থেকে আত্মগোপনকারী বান্দাকে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬২১]

১৪. আল্লাহর নিদর্শন থেকে বিমুখতা

অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন।তার অন্তর ও চোখকে তিনি সত্য অনুধাবন এবং সঠিক পথ অবলম্বন থেকে অন্ধ করে দেন। পবিত্র কুরআনের কত জায়গায় আল্লাহ জ্ঞানীদের বলেছেন তার নিদর্শনাবলি নিয়ে চিন্তা করার কথা। এ চিন্তা মানুষের সামনে আল্লাহর বড়ত্ব কুদরত এবং আমাদের উপর তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ ফুটিয়ে তোলে। তখন স্বাভাবিকভাবেই মহান প্রভুর কাছে সে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে; কৃতজ্ঞতায় সেজদাবনত হয়। তাই আল্লাহ যদি কাউকে তাঁর ওইসব নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন, তা হলে সে যে দ্বীনের মূল ও সরল পথ থেকেও ছিটকে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য।

আল্লাহর প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই, পরকালে বিশ্বাস নেই, অহংকার তো কেবল তারাই করতে পারে। অহংকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। কী ইহকাল আর কী পরকাল, একজন মানুষের অশান্তি, লাঞ্ছনা আর সমূহ বঞ্চনার জন্য এর পরে কি আর কিছু লাগে? আল্লাহ সর্বশক্তিমান, এ বিশ্বাস যাদের আছে তাদের এ কথা মানতেই হবে— প্রকৃত সম্মান পেতে হলে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতেই হবে।অহংকার যে মানুষকে কতটা অন্ধ ও বাস্তবতা বিমুখ করে তোলে,সেই দৃষ্টান্তও রয়েছে পবিত্র কুরআনে। মানুষ হিসেবে যে যত পাপ করেছে, ফেরাউন ও নমরূদের সঙ্গে কি কারও কোনো তুলনা চলে!

তারা যে অবাধ্যতার সব রকম সীমা লঙ্ঘন করেছিল তার মূলেও এই অহংকার। অহংকারের ফলে যখন নিজেকে বড় আর অন্যদের তুচ্ছ ভাবতে শুরু করল, এরই এক পর্যায়ে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করে বসল! আল্লাহর সঙ্গে যখন কেউ কোনো কিছুকে শরিক করে,হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ। পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছে, এ শিরকের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না ! এ তো অন্যকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করলে। তা হলে কেউ যদি নিজেকেই প্রভু বলে দাবি করে, তা হলে তার সে অপরাধ কতটা জঘন্য তা কি বলে বোঝাতে হবে?

মক্কার মুশরিকরা যে রাসূলুল্লাহ-কে নবী হিসেবে মানতে পারেনি,তার মূলেও তো এই অহংকারই। বরং এই অহংকারের কারণেই পূববর্তী নবীগণকেও অস্বীকার করেছিল তাদের স্ব স্ব গোত্রের বিত্তবান লোকেরা। মক্কার মুশরিকদের কথা পবিত্র কুরআনে আলোচিত হয়েছে এভাবে- তারা বলে, এই কুরআন কেন দুই এলাকার কোনো মহান ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হল না ! [সূরা যুখরুফ : ৩১]

অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে হলে কী করতে হবে, সে পথও বাতলে দিয়েছে আমাদের পবিত্র কুরআন। সে পথ শোকর ও কৃতজ্ঞতার পথ।বান্দা যখন শোকর আদায় করবে, কৃতজ্ঞতায় সেজদাবনত হবে,সবকিছুকেই আল্লাহ-র নেয়ামত বলে মনে প্রাণে স্বীকার করবে,তখন তার কাছে অহংকার আসবে কোত্থেকে? শোকর করার অর্থইতো হল- আমার যা প্রাপ্তি, সবই আল্লাহ -র দেওয়া নেয়ামত ওঅনুগ্রহ। এখানে আমার কোনোই কৃতিত্ব নেই। এ ভাবনা যার মনে সদা জাগরূক থাকে, অহংকার তার মনে বাসা বাঁধতে পারে না।

আর যদি পরকালের প্রসঙ্গে বলি, সেখানেও একই কথা। আপনি অনেক বড় আবেদ, চারদিকে আপনার সুনাম-সুখ্যাতি, অনেক ইলমের অধিকারী আপনি, সবাই আপনাকে বড় ব্যক্তি বলে জানে, কিংবা দু’হাত ভরে আপনি দান-সদকা করেন, চারদিকে আপনার প্রশংসা-স্তুতি, অথবা দ্বীন ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে আপনি সুপরিচিত, তাই বলে কি অহংকারের সুযোগ আছে? বাস্তবেই যে আপনার চেয়ে দুর্বল, ইবাদত-বন্দেগিতে, ইলমে-আমলে সর্বক্ষেত্রে, তাকে কোনোরূপ তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগ আছে? না; নেই।আমাদের মনে রাখতেই হবে, পরিমাণ আল্লাহ-র কাছে সবচেয়েবড় বিবেচ্য বিষয় নয়, তিনি দেখবেন ‘মান’। যেমন, তিনি ইরশাদ করেছেন- নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই,যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী। [সূরা হুজুরাত : ১৩]

তাই বাহ্যত যে দুর্বল, কে জানে তাকওয়ার শক্তিতে আল্লাহ -র দৃষ্টিতে সে সবল হয়ে উঠেছে কি না। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা,) ইরশাদ করেছেন—.কত এলোকেশী এমন, যাকে দরজায় দরজায় তাড়িয়ে দেওয়া হয়,অথচ সে যদি আল্লাহর নামে কোনো কসম করে বসে, তা হলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন! [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৮৪৮]

বই : অহংকার করবেন না

লিখক : শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *