অহংকারীর ইহকালীন শাস্তি
১. মানসিক যন্ত্রণা ও মানুষের ঘৃণা
প্রায় সব ক্ষেত্রেই অহংকারী যা চায় তা বাস্তবায়ন হয় না। ফলে সে ব্যর্থতা ও আশাভঙ্গের কারণে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে। অপরদিকে মানুষও তাকে ছোট, হীন, ইতর ও নিকৃষ্ট ভাবতে থাকে।এটা আল্লাহ -র পক্ষ থেকে অহংকারীর শাস্তি এবং পার্থিব জীবনে এটাই তাঁর চিরন্তন রীতি। সুতরাং, যে ব্যক্তি আল্লাহ -র জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মর্যাদা ও অবস্থান বাড়িয়ে দেন। পক্ষান্তরে যে অহংকার করে, আল্লাহ তাকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করেন।
২. বঞ্চিত হওয়া
বঞ্চিত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ-র আয়াতসমূহ ও নিদর্শনাবলি থেকে উপদেশ গ্রহণ এবং শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করার তাওফীক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া। যেমন, আল্লাহপবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন— আমি আমার নিদর্শনসমূহ থেকে তাদের ফিরিয়ে রাখি, যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে গর্ব করে। তারা সমস্ত নিদর্শন দেখলেও ঈমান আনবে না এবং হেদায়েতের পথ দেখলেও তাকে পথ হিসেবে গ্রহণ করবে না। অথচ গোমরাহির পথ দেখলে তারা তা পথ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। এ জন্য যে, তারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করেছে এবং তারা ছিল তা থেকে গাফেল।[সূরা আ’রাফ : ১৪৬]
সাদী (রহ,) বলেন- আমি আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখি।’ অর্থাৎ আমি তাদের আমার আয়াত ও নিদর্শন সমূহথেকে উপদেশ গ্রহণ এবং কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করা থেকে বিরত রাখি।
‘যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে গর্ব করে। অর্থাৎ যারা আল্লাহ-র বান্দাদের উপর অহংকার করে এবং হকের বিরুদ্ধাচরণ করে। আরও বিরোধিতা করে তাদের, যারা তাদের কাছে হক বা হকের বার্তা নিয়ে আগমন করে। যার বৈশিষ্ট্য হবে এমন আল্লাহ তাকে বহু কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করবেন। মানুষের মাঝে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করবেন। আল্লাহ -র আয়াতসমূহের মধ্যে যা কিছু তার জন্য কল্যাণকর হবে, তার শিক্ষা থেকে তাকে বঞ্চিত করবেন। বরং অনেক সময় সবকিছুর বাস্তবতা তার কাছে উল্টে যাবে। মন্দকে সে ভালো মনে করতে থাকবে। [তাফসীরুস সা’দী : ৩০২]
৩. দুনিয়াতে শাস্তির ওয়াদা
সালামা ইবনুল আকওয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ (সা,) ইরশাদ করেছেন-.কোনো ব্যক্তি নিজেকে বড় বলে ভাবতে ভাবতে [অহংকার করতে করতে] এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত তার নাম ‘জাব্বারীন’ তথা অহংকারী ও জালিমদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে তারও সেই পরিণতি হয় যা তাদের তথা অহংকারী ও জালিমদের হয়। [তিরমিযী, হাদীস নং ২০০০]
কোনো ব্যক্তি নিজেকে বড় বলে ভাবতে থাকে।’ অর্থাৎ সে নিজেকে অনেক বড় মনে করে। মনে করে তার মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে। মানুষের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানী। বাকি সকলের স্থান ও অবস্থান তার অনেক নীচে। এভাবে ভাবতে ভাবতে এবং অহংকার করতে করতে একটা সময় এমন আসে, যখন ‘তাকে জাব্বারীন এর তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়।’ অর্থাৎ তার নাম ফেরআউন, হামান,কারুন বা তাদের মতো অন্যান্য অহংকারী ও জালিমদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। অথবা সে তাদের সাথে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। [ তুহফাতুল আহওয়াযী : ৬/১১৭]
এই হাদীসে অহংকারীর অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, একজন অহংকারী কীভাবে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে অহংকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে এবং নিজেকে বড় ভাবতে ভাবতে সবচেয়ে বড় মর্যাদাশীল ও যোগ্য ভাবতে শুরু করে। এমনকি এক পর্যায়ে তার নাম বড় বড় জালিম ও অহংকারীদের নামের সাথে একসঙ্গে তালিকাভুক্ত করা হয়। অথচ প্রথম প্রথম কিন্তু তার অবস্থা এমন ছিল না। সুতরাং, প্রত্যেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানের জন্য অহংকারের শেষ পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। চাই তা যতই ছোটখাটো কাজেই হোক না কেন। শুরুতেই কোনো রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে না।যে কোনো রোগই ছোট থেকে বড় হয়।ছোট ছোট রোগ অনেক সময় এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে,যার কোনো চিকিৎসাই থাকে না। মনে রাখবেন : অধিকাংশ সময়ই বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে ছোট স্ফুলিঙ্গ থেকে।
৪. নেয়ামত বিলুপ্তির কারণ
অহংকার নেয়ামত বিলুপ্তির কারণ। অহংকারের কারণে নেয়ামত চলে যায়। যেমন, সালামা ইবনুল আকওয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-একদিন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা,) এর পাশে বাম হাতে খাবার খাচ্ছিল। তখন নবীজি তাকে বললেন, তুমি তোমার ডান হাতে খাবার গ্রহণ কর। লোকটি বলল, আমি তাতে সক্ষম নই।নবীজি বললেন, তুমি যেন সক্ষম না-ই হও। একমাত্র অহংকারই তাকে [ডান হাতে খেতে] বারণ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর সে আর কখনও তার [ডান] হাত মুখের কাছে উঠাতে পারেনি। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩৮৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৬৪৯৩]
এই হাদীস প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি কোনো ওজর ছাড়া শরীয়তের হুকুমের বিরোধিতা করে, তার জন্য বদ দোয়া করা জায়েয আছে।[শরহুন নববী আলা মুসলিম : ১৩/১৯২]
বর্ণিত লোকটিকে তার অহংকারই রাসূলুল্লাহ (সা,) এর আনুগত্য ও তাঁর নির্দেশ মান্য করা থেকে বিরত রেখেছে। তার অহংকারের নগদ শাস্তি হল, রাসূলুল্লাহ (সা,) তার জন্য বদ দোয়া করেছেন এবং আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর দোয়া সাথে সাথে কবুল করেছেন। ফলে তাৎক্ষণিক সে দুর্বলতা ও অপারগতায় আক্রান্ত হয়েছে।সুতরাং, যেসব অহংকারীকে তাদের অহংকার হকের আনুগত্য ও সত্যের অনুসরণ থেকে বিরত রেখেছে, তারা কি ভয় করে না যে,আল্লাহ তাদের সেসব নেয়ামত ছিনিয়ে নেবেন, যেগুলোর কারণে তারা তাঁর নাফরমানি ও অহংকার করছে?!
৫. কবরের আযাব ও ভূমিধসের কারণ
অহংকার কবরের আযাব ও ভূমিধসের কারণ। যেমন, আবু হুরায়রা ( থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম ইরশাদ করেছেন— এক লোক আকর্ষণীয় জোড়া কাপড় পরিধান করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে পথ চলছিল। হঠাৎ আল্লাহ তাকে মাটির নীচে ধসিয়ে দিলেন। কেয়ামত পর্যন্ত সে এভাবেই মাটির নীচে ধসতে থাকবে।[সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৭৮৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং৫৫৮৬, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৯১, মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং ৯০৬৫]
ফাইযাবাদী বলেন, ভূমি ধসে যাওয়ার অর্থ হল, সে মাটির নীচে চলে গেল।… আর ‘আল্লাহ তাকে জমিনে ধসিয়ে দিলেন’ মানে তাকে মাটির নীচে অদৃশ্য করে দিলেন। [আল-কামূসুল মুহীত :1/1039]
ইবনে হাজার আসকালানী বলেন- সে জোড়া কাপড় পরিধান করে হাঁটছিল।’ আর্থাৎ লোকটি একটি লুঙ্গি ও একটি চাদর পরিধান করে হাঁটছিল।
আর সহীহ মুসলিমে এ হাদীসটি আবু হুরায়রা (রা,) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-.জনৈক লোক তার দু’টি চাদর পরিধান করে দাম্ভিকতার সাথে পথ চলছিল। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৫৮৯]
مرجل جمته এর অর্থ হচ্ছে, চুলগুলোকে একত্র করে মাথা থেকে কাঁধপর্যন্ত কিংবা আরও বেশি ঝুলিয়ে দেওয়া। ترجيل الشعر এর অর্থ হচ্ছে, চুল আঁচড়ানো, চুলে তেল দেওয়া। নবীজির বাণী— হঠা়ৎ আল্লাহ তাকে মাটির নীচে ধসিয়ে দিলেন। কেয়ামত পর্যন্ত সে এভাবেই মাটির নীচে ধসতে থাকবে।’ এখানে التجلجل অর্থ হচ্ছে, التحرك তথা নড়াচড়া করা। আবার কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে,আওয়াজের সাথে নড়াচড়া করা
ইবনে ফারেস (রহ,) বলেন, التجلجل শব্দের অর্থ হচ্ছে, কঠিন ভূকম্পনসহ জমিনে ধসে যাওয়া এবং এদিক-সেদিক ধাবিত হওয়া বা নড়বড় করা। সুতরাং, يتجلجل এর অর্থ হচ্ছে, সে মাটির নীচে ধসতে থাকবে কঠিন কম্পন ও নড়াচড়াসহ।
এ হাদীস থেকে এ-ও বোঝা যায়, ওই ব্যক্তির দেহ মাটি খাবে না।ফলে তাকে অবিরাম মাটির নীচে ধসানো সম্ভব হবে। তার ব্যাপারে বলা হবে, সে এমন এক কাফের, যার দেহ মৃত্যুর পরও পঁচবে না বা নষ্ট হবে না। [ফাতহুল বারী : ১০/২৬১]
বই : অহংকার করবেন না
লিখক : শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ