ইসলাম

অহংকারীর পরকালীন শাস্তি

১. সুনিশ্চিত ধ্বংস

অহংকারী ব্যক্তি অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের সাথে ধ্বংস হবে। যেমন, ফুযালা ইবনে উবাইদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা,) ইরশাদ করেছেন- তিন ব্যক্তি[র পরিণতি] সম্পর্কে তোমরা আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করো না।

[১] যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে তাঁর বড়ত্ব নিয়ে ঝগড়া করে। কেননা, বড়ত্ব হচ্ছে আল্লাহর চাদর আর তাঁর পরিধেয় হচ্ছে ইযযত।

[২] যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের ব্যাপারেসন্দেহ পোষণ করে।

[৩] যে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়। [ইবনে হিব্বান : ৪৫৫৯, তবরানী : ৭৮৯]

২. নবীজি (সা,) থেকে দূরে থাকা

কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, ঘৃণিত ও অবস্থানগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ অহংকারীরা।যেমন, জাবের ইরশাদ করেছেন—থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ

তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কেয়ামত দিবসেও আমার খুব নিকটে থাকবে, তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত এবং কেয়ামত দিবসে আমার থেকে অনেক দূরে থাকবে— ছারছারূন, মুতাশাদ্দিকূন ও মুতাফাইহিকূন। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ছারছারূন [যারা বাচাল, অতিরিক্ত কথা বলে], মুতাশাদ্দিকূন [যারা মানুষের সামনে লম্বা লম্বা কথা বলে বেড়ায় এবং ধৃষ্ট ও নির্লজ্জ] এ দু’ ধরনের লোকদের তো আমরা চিনি-জানি, কিন্তু মুতাফাইহিকূন কারা? নবীজি বললেন, অহংকারীরা। [সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২০১৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৭৭৩২]

৩. আল্লাহর ক্রোধ

অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে, যখন আল্লাহ তার উপর প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত থাকবেন। যেমন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি নিজেকে বড় মনে করে অথবা হাঁটাচলায় অহংকার করে, সে এমন অবস্থায় আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করবে, যখন তিনি তার উপর ক্রোধান্বিত থাকবেন। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৫৯৯৫]

৪. লাঞ্ছনা ও অপদস্থতা

কেয়ামতের দিন আল্লাহ অহংকারীদের চূড়ান্ত অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করবেন। তাদের হাশর হবে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ অবস্থায়। যেমন, আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী কারীম এ ইরশাদ করেছেন – কেয়ামতের দিন অহংকারীদের ক্ষুদ্র পিঁপড়ার ন্যায় মানুষের আকৃতিতে সমবেত করা হবে। অপমান ও লাঞ্ছনা তাদেরকে সবদিক থেকে ছেয়ে ফেলবে। জাহান্নামের ‘বুলাস’ নামক একটি কারাগারের দিকে তাদের টেনে নেওয়া হবে। আগুন তাদের গ্রাস করবে। জাহান্নামীদের গলিত রক্ত ও পুঁজ তাদের পান করানো হবে। [সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৯২, মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং ৬৬৭৭]

৫. জান্নাতে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা

অহংকার জান্নাতের পথের বাধা, জান্নাতে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা।যেমন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা,) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম ইরশাদ করেছেন- যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, [হে আল্লাহর রাসূল!] মানুষ চায় তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক [এ-ও কি অহংকার]? নবীজি বললেন, আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। প্রকৃতপক্ষে অহংকার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায়কে অস্বীকার করা এবং মানুষকে অবজ্ঞা করা [সহীহমুসলিম, হাদীস নং ২৭৫, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৯৯]

৬. জাহান্নামের প্রতিশ্রুতি

পবিত্র হাদীসে অহংকারীদের জন্য জাহান্নামের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।যেমন, হারেসা ইবনে ওয়াহব আল-খুযায়ী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা,) -কে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেছেন- আমি কি তোমাদের জান্নাতী লোকদের পরিচয় জানিয়ে দেব না? [ তারা হল] দুর্বল ও অসহায় লোক; তারা যদি কোনো বিষয়ে আল্লাহর নামে কসম করে বসে, তা হলে আল্লাহ তাআলা তা পূরণ করে দেন। আমি কি তোমাদের জাহান্নামী লোকদের পরিচয় জানিয়ে দেব না? [তারা হল] প্রত্যেক রূঢ় স্বভাববিশিষ্ট, দাম্ভিক ও অহংকারী। [বুখারী, হাদীস নং ৪৯১৮, মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৬৮ তিরমিযী, হাদীস নং ২৬০৫, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪১১৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৮৭২৮]

ইমাম নববী বলেন, العتل অর্থ রূঢ়-কঠিন স্বভাববিশিষ্ট, বাতিলের পক্ষে কঠিন ঝগড়াকারী। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, কঠোর মেজাজ ও যার কথাবার্তা অত্যন্ত রুঢ় ও শক্ত। [শরহুন নববী আলা মুসলিম : ১৭/১৮৭

جواظ অর্থ অবাধ্য, একগুঁয়ে। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন— এমন মাংসল দেহধারী, যে হাঁটাচলায় দাম্ভিক ও অহংকারী। আবার কেউ কেউ এর অন্য অর্থও করেছেন। [তুহফাতুল আহওয়াযী : ৭/২৭৯]

অপর এক হাদীসে আবু হুরায়রা (রা,) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ এ ইরশাদ করেছেন— জাহান্নাম ও জান্নাত পরস্পর বাক-বিতণ্ডা করল। অতঃপর জাহান্নাম বলল, প্রতিপত্তিসম্পন্ন অহংকারী লোকেরা আমার ভেতর প্রবেশ করবে। জান্নাত বলল, দুর্বল ও নিঃস্ব লোকেরা আমার ভেতর প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ জাহান্নামকে বললেন, তুমি আমার আযাব, যাকে ইচ্ছা আমি তোমার মাধ্যমে শাস্তি দেব। অথবা আল্লাহ বলেছেন, তোমার মাধ্যমে আমি যাকে ইচ্ছা পাকড়াও করব। তারপর তিনি জান্নাতকে বললেন, তুমি আমার রহমত, যাকে ইচ্ছা আমি তোমার মাধ্যমে দয়া করব। তবে তোমাদের প্রত্যেকেরই পেট ভর্তির ব্যবস্থা থাকবে। [বুখারী, হাদীস নং ৪৮৫০, মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৫১, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৫৬১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৭৭১৮]

ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, কেউ কেউ المتكبرون ও المتجبرون উভয় শব্দের অর্থ একই বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, المتكبرون হচ্ছে তারা, যারা এমন জিনিস নিয়ে বড়াই-অহংকার করে, যা তাদের কাছে নেই। আরالمتجبرون হচ্ছে তারা,যাদের কাছে পৌঁছা সম্ভব হয় না।

ضعفاء الناس وسقطهم দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই সমস্ত লোক, যারা মানুষের দৃষ্টিতে দুর্বল অসহায় ও নিঃস্ব। অবশ্য এ কথাটি অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিকোণ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায় বলা হয়েছে। কেননা,তারা অন্যদের এমনই মনে করে। তবে আল্লাহর কাছে তারা অনেক বড় মর্যাদা ও অবস্থানসম্পন্ন লোক। তাদের অন্তরে আল্লাহর পরিচয়, বড়ত্ব ও ভয় থাকার কারণে নিজেদের অত্যন্ত ছোট মনে করে; অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে থাকে। ইবাদত-বন্দেগিতে চূড়ান্ত বিনয় অবলম্বন করে। এ কারণেই তাদেরকে দুর্বল ও অসহায় বলা হয়েছে।

হাদীসে দরিদ্র অসহায় ও দুর্বলরা জান্নাতে প্রবেশ করবে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ এই নয় যে, কোনো ধনী বা সম্পদশালী লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না বা প্রবেশ করতে পারবে না। বরং জান্নাতে যারা প্রবেশ করবে, তাদের অধিকাংশই হবে দুর্বল অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণির। তাই অধিকাংশের দিক লক্ষ করে বলা হয়েছে- জান্নাতে প্রবেশ করবে অসহায়, দরিদ্র ও নিঃস্বরা। [ফাতহুল বারী : 8/597]

৭. লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে

অহংকারীরা কেয়ামতের দিন অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেমন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদকরেছেন- কাফেরদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে। তারা যখন সেখানে পৌঁছবে, তখন তার দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদের বলবে, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আগমন করেননি, যাঁরা তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করতেন এবং সতর্ক করতেন তোমাদের এ দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে? তারা বলবে, হাঁ, অবশ্যই এসেছিলেন কিন্তু কাফেরদের উপর শাস্তির হুকুমই বাস্তবায়িত হল। বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে তোমরা চিরকাল অবস্থান করবে। কতই না নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল। [সূরা যুমার : ৭১-৭২]

অপর এক আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে, তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে। [সূরা মুমিন : ৬০]

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন- মহান আল্লাহ বলেন, অহংকার হল আমার চাদর এবং বড়ত্ব হল আমার পরিধেয়। সুতরাং, যে কেউ এর কোনো একটি নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে [টানাটানি করবে], আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪১৭৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীসনং ৭৩৮২]

সুতরাং, অহংকার ও বড়ত্ব একমাত্র এবং কেবলই আল্লাহ-র জন্য নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট। অতএব, কোনো বান্দা যখন অহংকার করে,তখন সে এমন জিনিস নিয়ে আল্লাহ-র সঙ্গে টানাটানি ও ঝগড়া করে, সে যার উপযুক্ত নয়। ফলে সে এর উপযুক্ত হয়ে যায় যে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।

বই : অহংকার করবেন না

লিখক : শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *