ইসলাম

মদ হারাম হওয়ার ইতিবৃত্ত

আমরা জানি, ইসলামে মদ বা নেশাজাতীয় কিছু গ্রহণ করা হারাম। এতে সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। তবে অনেকের হয়তো এ বিষয়ে জানা নেই যে ইসলামে মদকে একবারে হারাম করা হয়নি। আল্লাহ তাআলা ধাপে ধাপে মদ হারাম করেছিলেন।

মদ সম্পর্কে কুরআন মজীদে চারখানা আয়াত নাযিল হয়েছে। মদ সম্পর্কে প্রথমে যে আয়াত নাযিল হয় তাতে মদের বৈধতার প্রতি ইংগিত রয়েছে এবং এ আয়াতটি মক্কা মুকাররমায় অবতীর্ণ হয় । ইরশাদ হয়েছে— وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالْأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا إِنَّ فِي ذَالِكَ لَآيَةٌ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

এবং খেজুর বৃক্ষের ফল ও আঙুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য সংগ্রহ করে থাক। এতে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন । [১৬ : নাহল : ৬৭]

তখন মদ হালাল ছিল এবং মুসলমানদের প্রায় সকলেই সে সময় মদ পান করত। পরবর্তী সময়ে হযরত উমর, মু’আয ইবন জাবাল (রা.) এবং আরো কতিপয় সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মদের ব্যাপারে আমাদেরকে ফাতওয়া দিন। এতে আকল নষ্ট হয় এবং মাল ধ্বংস হয়। তখন নাযিল হল : يَسْتَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ م قُلْ فِيهِمَا إِثْمُ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا اكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِما ط

লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, উভয়ের মধ্যে মহাপাপ এবং মানুষের জন্যে উপকারও আছে; কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। [২ : বাকারা : ২১৯]

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর কেউ কেউ মদ পান করা ছেড়ে দেন আবার কেউ পূর্ববৎ মদ পানে রত থাকেন। এ সময়ের মধ্যে একবার হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.) কতিপয় সাহাবীকে দাওয়াত করেন। তাঁরা খানা খাওয়ার পর মদ পান করেন এবং মাতাল হয়ে যান। এ সময় তাঁদের কোন একজন নামায পড়তে গিয়ে قل يا ايها الكافرون لا اعبد ما تعبدون পাঠ করেন। অর্থাৎ لا অক্ষরটি বাদ দিয়ে পাঠ করেন।

তখন আল্লাহ তাআলা নিম্নের আয়াতটি নাযিল করলেন- يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلوةَ وَأَنتُمْ سُكْرى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُوْلُوْنَ হে মুমিনগণ! মদ্যপানোন্মত্ত অবস্থায় তোমরা নামাযের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার। [৪ : নিসা : 83]

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মদ্যপায়ী লোকদের সংখ্যা প্রচুর হ্রাস পায়। তারপর ইতবান ইবন মালিক (রা.) একদল আনসারী সাহাবীকে তাঁর বাড়িতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। তাঁরা খানা খাওয়ার পর মদ পান করে মাতাল হয়ে পড়েন। এ সময় হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা.) একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। এতে তিনি আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের খুব গুণগান বর্ণনা করেন। এ কবিতা শুনে এক আনসারী যুবক রাগান্বিত হয়ে উটের গণ্ডদেশের একটি হাড় হযরত সা’দ (রা.)-এর মাথায় ছুঁড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে সা’দ (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসারী যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করলেন- اللَّهُم بَيْنَ لَّنَا فِي الْخَمْرِ بَيَانًا شَافِيًا হে আল্লাহ! মদ সম্পর্কে আমাদেরকে একটি পরিষ্কার বিধান বলে দিন।

হযরত উমর (রা.) ও আল্লাহর দরবারে অনুরূপ দুআ করেছেন বলে হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। তখনই আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন- يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقَع بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ فِى الْخَمْرِ وَالميسِرِ وَيَصُدِّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلوة فَهَلْ أَنْتُمْ منتهون

হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না? [৫ : মায়িদা : ৯০-৯১] [আল ফিকহ্ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ ৫ম খণ্ড, পৃ. ১০ : মা’আরিফুল কুরআন : (সংক্ষিপ্ত) পৃ. ১১৩]

এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ঘোষককে তা প্রচারের জন্য নির্দেশ দিলেন। তিনি মদীনার গলি গলি ঘুরে এ কথার ঘোষণা করলেন এবং এ হুকুম সর্বত্র পৌঁছিয়ে দিলেন। আনাস (রা.) বলেন, আমি আবু তালহা (রা.)-এর ঘরে লোকদেরকে মদ পরিবেশন করছিলাম। তখনই মদের নিষেধাজ্ঞা অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ঘোষককে তা প্রচারের নির্দেশ দিলেন এবং উক্ত ব্যক্তি এ মর্মে ঘোষণা দিলেন। তখন আবু তাহলা (রা.) আমাকে বললেন, বেরিয়ে দেখ তো কিসের ঘোষণা? আনাস (রা.) বলেন, আমি বেরুলাম এবং এসে বললাম, একজন ঘোষক ঘোষণা দিচ্ছেন যে, জেনে রাখ মদ হারাম করে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বললেন- যাও, এগুলো সব ঢেলে দাও। আনাস (রা.) বলেন, সেদিন মদীনা মুনাওয়ারার রাস্তায় রাস্তায় মদের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল। [বুখারী ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬৪]

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ‘মদ পান করা হারাম’ এ কথাটি একবারে নাযিল হয়নি। বরং পর্যায়ক্রমে তা নাযিল হয়েছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করে আলিমগণ বলেন যে, সাহাবীগণ মদ পানে খুব অভ্যস্ত ছিলেন। কাজেই একবারে মদ্যপানের নিষেধাজ্ঞার হুকুম অবতীর্ণ হলে এ হুকুম পালন ও বাস্তবায়িত করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। তাঁদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহ তাআলা এ হুকুম একবারে নাযিল না করে পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছেন । [প্রাগুক্ত : পৃ. ১০]

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *