শরীয়তের দৃষ্টিতে জুয়া
ইসলাম এক বৈপ্লবিক ধর্ম। আকীদা, ইবাদত ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইসলাম যেমনিভাবে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেছে, তেমনিভাবে অর্থনীতিরসক্ষেত্রেও ইসলাম জাহিলী রুসমের বেদীমূলে কুঠারাঘাত করে নিজ অনুসারীদের জন্য স্বতন্ত্র একটি নিয়ম-বিধান প্রবর্তন করেছে। এতে নেই কোনরূপ ইফরাত ও তাফরীত। এক কথায় ইসলাম অর্থনীতির ক্ষেত্রে এমন একটি রূপরেখা পেশ করেছে যা সর্বপ্রকার বাড়াবাড়ি এবং প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত। এতে নেই অধিকার ব্যতিরেকে সম্পদের মালিকানা হাসিলকরার কোন পন্থা। বিনা পরিশ্রমে টাকার পাহাড় গড়ে তোলারও ইসলাম কাউকে সুযোগ দেয় না। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদ এবং জুয়া সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন- يَسْتَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمُ كَبِيرٌ ومنافع للناس واثمهما اكبر من نفعهما ط
লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, উভয়ের মধ্যে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও আছে; কিন্তু এগুলোর পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। [২ : বাকারা : ২১৯] উপরোক্ত আয়াতে হালাল-হারামের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়নি। তবে এ সবের প্রতি তিনি নারাজ তা এখানে বিবৃত হয়েছে। এ কারণে সাহাবীগণের অনেকেই এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মদ জুয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে হাত গুটিয়ে নেন। অবশ্য স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নাযিল না হওয়ায় কেউ কেউ তখনো তা পুরোপুরি বর্জন করেননি। তখন আল্লাহ তাআলা নিম্নের আয়াতটি নাযিল করেছেন- يَايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقَعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلوةَ فَهَلْ أَنْتُم مُنتَهُونَ )
হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর। তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না? [৫ : মায়িদা : ৯০-৯১]
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে মদ ও জুয়া হারাম হওয়ার কথা বলে দেওয়া হয়েছে। আর এ বিষয়টি খুব মজবুতভাবে বলা হয়েছে। ইমাম রাফিঈ (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন-
১, বিষয়টিকে তাকিদ করার জন্য আয়াতের শুরুতে إنما শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী পরিভাষায় এ শব্দটি তাকিদের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২. মদ এবং জুয়াকে ঘৃণ্য বস্তু আখ্যায়িত করা হয়েছে।
৩. এগুলোকে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে।
৪. মদ ও জুয়াকে মূর্তিপূজার সাথে মিলিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
৫. অধিকন্তু আয়াতে এগুলো থেকে দূরে থাকার হুকুম করা হয়েছে।
৬. শুধু তাই নয় বরং মদ ও জুয়াকে দুনিয়া-আখিরাতের অকল্যাণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৭. দুনিয়ার অকল্যাণ হল, এর দ্বারা শয়তান মানুষের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে থাকে।
৮. আর এর দ্বারা শয়তান লোকদেরকে নামায আদায় করা এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে রাখে। কাজেই মদের ন্যায় জুয়াও হারাম এবং হারাম হওয়ার বিষয়টি কুরআন মজীদের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত যদি কেউ এ বিষয়টিকে অস্বীকার করে তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে। [জাওয়াহিরুল ফিক্হ : ২য় খণ্ড : ৩৩৮-৩৩৯]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ (রহ.) বলেন, খেলামাত্রই মায়সির এমনকি ছেলে-মেয়েদের মার্বেল খেলাও। আবুল আহওয়াস (রহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বলেছেন- তোমরা এ সব লুডু খেলা থেকে বিরত থাক এবং অন্যকে কঠিন হস্তে তা থেকে বিরত রাখ। কেননা, তা হচ্ছে জুয়া।
হযরত উমর ইবন উবায়দুল্লাহ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি কাসিম ইবন মুহাম্মদ (রহ.) কে বলেন, লুডু খেলা জুয়া। আপনি কি দাবা খেলাকেও জুয়া মনে করেন? হযরত কাসিম (রহ.) বলেন, যা কিছু আল্লাহর যিকর ও নামায আদায় করা থেকে বিরত রাখে তাই জুয়া। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, মায়সির অর্থ জুয়া। জাহিলী যুগে লোকে পরিবার ও সম্পদ পণ রেখে জুয়া খেলত। যে বিজয়ী হত সে অন্য পক্ষের পরিবার ও সম্পদ নিয়ে যেত। [তাফসীরে তারাবী শরীফ : ৪র্থ খণ্ড : পৃ. ১১৫, ১৬৬ ইফাবা]
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- مَنْ قَالَ لِصَاحِبِهِ تَعَالِ أَفَامِرُكَ فَلْيَتَصَدَّقَ কেউ যদি তার সাথীকে বলে- এসো জুয়া খেলি, তাহলে এ কথার অপরাধের কারণে সাদকা করা তার উপর অপরিহার্য। [আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম : পৃ. ২৯৫]
অতএব, জুয়াকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসাবে গ্রহণ করা যেমন কোন মুসলমানের জন্য জায়েয নেই, তেমনি এ খেলা মনের সান্ত্বনা, পরিতৃপ্তি ও অবসর বিনোদনের উপায়রূপে গ্রহণ করাও বৈধ হতে পারে না।