গান বাজনা সম্পর্কে আলকুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
গান বাজনা সম্পর্কিত আক্ষরিক অর্থের শব্দ ও বাক্য হাদীসে ব্যবহৃত হলেও আল কুরআনে এমন কিছু শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে যা ব্যাপক অর্থবোধক। সেখানে গান বাজনার কথা তো বুঝানো হয়েছেই সেই সাথে অনুরূপ অর্থহীন যাবতীয় কার্যকলাপকেও বুঝানো হয়েছে।
ক. সূরা লুকমানে বলা হয়েছে-
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلُّ عَن سَبِيْلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ –
‘আর কতক লোক এমনও রয়েছে যারা অজ্ঞতাবশত মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য মনোমুগ্ধকর কথা খরিদ করে আনে। এবং এই পথের আহবানকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে উড়িয়ে দিতে চায়। এধরনের লোকদের জন্য কঠিন ও অপমানকর শাস্তি রয়েছে।সূরা লুকমান, আয়াত-৬
এ আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট :
মক্কার কাফিরদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন এ দাওয়াত তারা রুখতে পারছিলো না, সম্প্রসারিত হয়েই চলছিলো তখন নদর ইবনু হারিস কুরাইশ নেতাদের বললো, তোমরা যেভাবে এ ব্যক্তির মুকাবিলা করছো তাতে কোনো কাজ হবে না। এ ব্যক্তি তোমাদের মধ্যেই জীবন যাপন করে শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে। নৈতিক চরিত্রের দিক থেকে আজও তোমাদের মধ্যে সে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সত্যবাদী, সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক । এখন তোমরা তাকে গণক, যাদুকর, কবি, পাগল বলছো। এ কথা কে বিশ্বাস করবে? যাদুকর কী ধরনের তন্ত্রমন্ত্রের কারবার চালায় তা কি লোকেরা জানে না? গণকরা কী সব কথাবার্তা বলে তা কি লোকদের জানতে বাকী আছে? লোকেরা কি কবিতা ও কাব্যচর্চার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ? পাগলরা কেমন করে তাও তো লোকেরা জানে।
এ দোষগুলোর মধ্য থেকে কোনটি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওপর প্রযোজ্য হয় সেটি বিশ্বাস করানোর জন্য লোকদের কি আহবান জানাতে পারবে? থামো, এ রোগের চিকিৎসা আমিই করবো। এরপর সে মক্কা থেকে ইরাক চলে গেল। সেখান থেকে অনারব বাদশাহদের কিসসা কাহিনী এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের গল্পকথা সংগ্রহ করে এনে গল্প বলার আসর জমিয়ে তুলতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য ছিলো এভাবে লোকেরা আল কুরআনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং এসব গল্প কাহিনীর মধ্যে ডুবে যাবে।
ইবনু আব্বাস (রা)-এর বর্ণনায় আরও আছে, নদর এ উদ্দেশ্যে গায়িকা বাঁদীদেরকেও ক্রয় করে নিয়ে এসেছিলো। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথায় প্রভাবিত হতে চলেছে, কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তার কাছে এ খবর এলেই সে তার জন্য একজন বাঁদী নিযুক্ত করতো এবং তাকে বলে দিতো, ওকে খুব ভালোভাবে পানাহার করাও এবং গান শুনাও। সবসময় তোমার সাথে জড়িয়ে রেখে ওদিক থেকে ওর মন ফিরিয়ে আনো। ৩২ এ সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ আয়াত নাযিল হয়।
এ আয়াতে এসব কাজকে ‘লাহওয়াল হাদীছ’ বলা হয়েছে। যেসব সাহাবী ও তাবিঈ এই বাক্যাংশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই ‘লাওয়াল হাদীছ’ বলতে গান বাজনা এবং অনর্থক ক্রীড়া কৌতুক এর কথাই বলেছেন ।
আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা) এর অর্থ করেছেন- গান (انه غناء)। ইকরিমা, মাইমুন ইবনু মিহরান এবং মাকহুল (রহ)-এর অভিমতও তাই।
আবদুল্লাহ্ ইবনু মাসউদ (রা) বলেছেন- هو والله الغنى (আল্লাহর কসম, এর অর্থ হচ্ছে গান)।
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন- لهو الحديث এর অর্থ গান বা গান জাতীয় ক্রীড়া কৌতুক (هو الغناء واشباهه)
হাসান আল বাসরী (রহ) বলেছেন- لهو الحديث(লাওয়াল হাদীছ) অর্থ- (المعازف والغناء(গান এবং বাদ্যযন্ত্র)।
মুজাহিদ (রহ) বলেছেন- ان لهو الحديث في الآية الاستماع إلى الغناء وإلى مثله من الباطل – এ আয়াতে (লাহওয়াল হাদীছ) বলতে গান এবং এ ধরনের অনর্থক বিষয় শুনাকে বুঝানো হয়েছে ।
কাসিম ইবনু মুহাম্মাদ (রহ) বলেছেন— الغناء باطل والباطل في النار – গান বাতিল জিনিস আর বাতিল জিনিস জাহান্নামের উপযোগী।
ইবনু আতিয়্যা (রা) বলেছেন- ‘পরিত্যাজ্য ও নিষিদ্ধ জিনিস ভালো মনে করা এবং তা ক্রয় করা সীমা লঙ্ঘনের শামিল। যেমন- আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, ‘এরাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে।’ অন্য কথায় বলা যায় তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে।
খ. সূরা বানী ইসরাঈলে বলা হয়েছে—
وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بَصَوْتِكَ – (আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শয়তানকে লক্ষ্য করে বলেছেন) ‘তুই তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস তোর আওয়াজ দ্বারা সত্যচ্যুত কর। ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন- صوته يشمل كل داع دعا إلى معصية لان ذلك انما وقع طاعة له ـ “তার আওয়াজ এমন প্রত্যেক আহবানকারীকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়, যে গুনাহর দিকে আহবান করে । কারণ এটি তারই (শয়তানের) আনুগত্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়।’
গুনাহর কাজে প্রতিটি আহ্বানকারীর আহ্বানকে শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে । কারণ যখন সে আহ্বান করে তখনই তার ডাকে সাড়া দেয়া হয়।
মুজাহিদ (রহ) ‘শয়তানের আওয়ায’ এর ব্যাখ্যা করেছেন— ‘গান, বাদ্যযন্ত্র ও অনর্থক ক্রীড়া কৌতুক’
দাহ্হাক (রহ) বলেছেন- ‘বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ’
গ. সূরা আন নাজম-এ বলা হয়েছে—
أَفَمِنْ هذَا الْحَدِيْثِ تَعْجَبُونَ – وَتَضْحَكُوْنَ وَلاَ تَبْكُونَ – وَأَنْتُمْ سَامِدُوْنَ – ‘তাহলে কি তোমরা এসব কথা শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করছো? হাসছো কিন্তু কাঁদছো না। আর গান বাজনা করে তা এড়িয়ে যাচ্ছো।
এ আয়াতে سامد(সামিদুন) শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে তাফসীরকারগণ দু রকম বক্তব্য পেশ করেছেন।
ইবনু আব্বাস (রা) ও ইকরিমা (রহ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- السمود البرطمة وهى رفع الرأس تكبرا كانوا يمرون على النبي صلى الله عليه وسلم غضبانا مبرطمين ـ
‘অহংকার ভরে ঘাড় উঁচু বা বাঁকা করা। মক্কার কাফিররা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্রোধে ঘাড় উঁচু করে চলে যেতো।’— এই অর্থ বিবেচনা করে কাতাদা سامدون শব্দের অর্থ করেছেন غافلون (গা-ফিলুন- অমনোযোগী) এবং সাঈদ ইবনু যুবাইর (রহ)-এর অর্থ করেছেন معرضون (মু’রিদূন— মুখ ফিরিয়ে চলাচলকারী)।
ইবনু আব্বাস (রা)-এর আরেকটি অভিমতে দেখা যায়— তিনি سامدون শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন— هو الغناء باليمانيه (ইয়ামানি ভাষায় এর অর্থ গান)৷
ইকরিমা (রহ) বলেছেন- هو غناء حمير(হিমইয়ারদের ভাষায় এ শব্দের অর্থ গান)। তারা غن لنا (আমাদেরকে গান শোনাও) না বলে, বলে سمد لنا (আমাদেরকে গান শোনাও) !
আবু উবাইদা নাহবী বলেছেন— —السمود الغناء بلغه حمير (হিমইয়ারদের পরিভাষা অনুযায়ী السمودহচ্ছে গান বাজনা) যেমন— তারা বলে থাকে يا جاريه اسمدي لنا (হে খুকি! আমাদেরকে গান শুনাও তো)।
আল কুরআনের এসব আয়াতের ভাষ্য থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল ইসলাম গান বাজনাকে নিরুৎসাহিত করেছে।