ইসলাম

ভালো কবিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মনোভাব

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ان من الشعر حكمة _ “অবশ্যই কোনো কোনো কবিতায় জ্ঞানের কথাও আছে।

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الشعر بمنزلة الكلام حسنه كحسن الكلام وقبيحه كقبيح الكلام – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ‘কবিতা কথার মতো। ভালো কবিতা ভালো কথার মতো আর মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতো।

আয়িশা (রা) বলেছেন- الشعر منه حسن ومنه قبيح خذ بالحسن و دع القبيح – ‘কবিতার মধ্যে কতক ভালো এবং কতক মন্দ। তুমি ভালোটি গ্রহণ কর এবং মন্দটি পরিহার কর।

জাবির ইবনু সামুরা (রা) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে একশটিরও অধিক অনুষ্ঠানে বসেছি। অনুষ্ঠানে তাঁর সাহাবীগণ কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাঁরা জাহেলী যুগের কোনো কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং ঠাট্টা করতেন আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন চুপ করে থাকতেন আবার কখনও হাসিতে যোগ দিতেন এবং মুচকি হাসতেন ।

ইসলামী যুগে যেসব কবি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন- ১. কা’ব ইবনু যুহাইর (রা)। ২. হাসান ইবনু সাবিত (রা)। ৩. আব্দুল্লাহ্ ইবনু রাওয়াহা (রা)। ৪. হুতাইয়া (রা)। (প্রকৃত নাম আবুল মালিকা জারোয়াল ইবনু আওস আসী)। ৫. মহিলা কবি খানসা (রা)। ৬. লাবীদ ইবনু রবী’আ (রা)। (জাহেলী যুগের কবি, ইসলাম গ্রহণের পর কাব্যচর্চা ছেড়ে দেন) । ৭. আলী ইবনু আবী তালিব (রা)। ৮. উছমান ইবনু মাযউন (রা), প্রমুখ।

ভালো কবিতা চর্চার উৎসাহ

ভালো কবিতা চর্চার জন্য সাহাবা কিরাম উৎসাহ দিতেন। উমার (রা) বলেছেন- افضل صناعات الرجل الابيات من الشعر فيقدمها في حاجته “মানুষের উত্তম শিল্প ও সৃষ্টি হলো কবিতা, যা সে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে।

উমার (রা) আবু মূসা আল আশআরী (রা) কে লিখেছিলেন- مر من قبلك بتعلم الشعر فانه يدل على معالى الاخلاق و صواب الرأى ومعرفة الانساب .

‘তোমার বন্ধু বান্ধব ও সাথীদের কবিতা শেখার নির্দেশ দাও। কারণ এটা উন্নত চরিত্র, সঠিক সিদ্ধান্ত এবং বংশ লতিকা সংক্রান্ত জ্ঞানের পরিচায়ক। ১৩৯

শিশুদেরকে কবিতা শেখানোর ব্যাপারে উৎসাহ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন- علموا اولادكم العوم والرماية ومروهم فليثبوا على الخيل ووردهم ما يجمل من الشعر ـ

তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সাঁতার এবং তীর চালনা শেখাও। আর তাদেরকে নির্দেশ দাও তারা যেন ঘোড়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তাদেরকে সুন্দর ও ভালো কবিতা শেখাও।

‘উমার (রা)-এর শাসনামলে তিনি তাঁর গভর্ণরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসলামী যুগের রচিত কবিতাসমূহ সংগ্রহ করে পাঠাতে।

আলী (রা) বলেছেন— الشعر ميزان القوم او ميزان القول – “কবিতা হচ্ছে একটি জাতির (সাহিত্য, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা পরিমাপের) মানদণ্ড কিংবা বলেছেন তার কথার মানদণ্ড ।

“সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব (রহ) বলেছেন- ‘আবু বাকর (রা), উমার (রা) ও আলী (রা) তিনজনই কবি ছিলেন। তবে এ তিনজনের মধ্যে আলী (রা) ছিলেন শ্রেষ্ঠ কবি।

মু’আবিয়া ইবনু আবী সুফইয়ান (রা) বলেছেন- يجب على الرجل تأديب ولده والشعر أعلى مراتب الأدب وقال اجعلوا الشعر أكبر همكم وأكثر دأ بكم فلقد رأيتنى ليلة الهرير بصفين وقد أتيت بفرس أغر محجل بعيد البطن من الأرض وأنا أريد الهرب لشدة البلوى فما حملني على الأقامة إلا أبيات عمرو بن الإطنابة –

‘মানুষের উচিত তাদের সন্তানদেরকে সাহিত্যানুরাগী করে গড়ে তোলা। সাহিত্যের সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের বিষয় হলো কবিতা। তোমরা কবিতাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান দাও এবং তা তোমাদের অভ্যাসে পরিণত কর। কারণ সিফফীনের যুদ্ধের সময় ‘লাইলাতুল হারীরে’ প্রচণ্ড বিপদের কারণে পালাতে উদ্যত হওয়ায় আমার নিকট যখন সুদর্শন ও শক্তিশালী ঘোড়া আনা হলো, তখন আমর ইবনুল ইনাবার কবিতাগুলো আমাকে যুদ্ধের ময়দানে অটল থাকতে প্রেরণা যোগাল।

আল কুরআনের প্রখ্যাত ভাষ্যকার আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন- إذا قرأتم شيئا من كتاب الله فلم تعرفوه فاطلبوه في أشعار العرب فإن الشعر ديوان العرب ـ

‘যখন তোমরা আল্লাহর কিতাবের কোনো অংশ পাঠ কর, তখন যদি তার অর্থ বুঝতে না পার তাহলে আরবদের কবিতার মধ্যে অনুসন্ধান কর। কারণ কবিতা হচ্ছে আরবদের জীবনালেখ্য ।

আর তাঁকে কুরআনুল কারীমের কোনো অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কবিতা আবৃত্তি করে তার উত্তর দিতেন।

সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই কবি ছিলেন। যারা নিজেরা কবিতা রচনা করতেন না তাঁরাও অন্য কবিদের কবিতা আবৃত্তি করতেন ।

আল কুরআন কবিদের নিন্দা করেছে কেন ?

আলকুরআনে কবিদের নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে— والشُّعَرَاء يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ – اَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ – وَأَنَّهُمْ يَقُولُوْنَ مَا لَا يَفْعَلُوْنَ –

“আর যারা বিভ্রান্ত তারাই কবিদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখো না, ওরা উদভ্রান্ত হয়ে প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? এবং তারা যা করে না তা-ই বলে ।

সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছে- وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشَّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ – আমি তাকে (রাসূলকে) কবিতা শিখাইনি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয় নয়। এজন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কবিতা আবৃত্তি করেননি।

রাগিব আল ইসফাহানী বলেন, কুরআনুল কারীমে কবি ও কবিতাকে মন্দ বলার কারণ হচ্ছে— ولكون الشعر مقر الكذب – قيل أحسن الشعر أكذبه _

যেহেতু কবিতা মিথ্যার ঘাটি (বেসাতি)। তাই বলা হয়- ‘মিথ্যা কবিতাই সুন্দর কবিতা ।

এসব কথা সেইসব কবি ও কবিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যা জাহেলী যুগে রচিত হয়েছিলো। যেখানে নীতি নৈতিকতার বালাই ছিলো না, অশ্লীলতা ও শির্কে পরিপূর্ণ ছিলো। তার প্রমাণ সূরা আশ শুআরার ২২৭ নম্বর আয়াতটি। সেখানে পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে যেসব কবি ঈমান এনেছে, সৎকাজ করে, আল্লাহকে স্মরণ করে ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তারা বিভ্রান্ত নয় কিংবা উল্লেখিত দোষে দুষ্ট নয়। ইরশাদ হচ্ছে— إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللهَ كَثِيرًا وَانْتَصَرُوا مِنْ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا

“কিন্তু তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করে, বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে এবং অত্যাচারিত হবার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে।

ইবনু রাশীক বলেন— প্রথম আয়াতে নিন্দা জানানো হয়েছে মুশরিক কবিদের, যারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করতো এবং ইসলামের বিরোধিতা করতো। আর আয়াতের শেষে إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا বলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কবি হাস্সান ইবনু ছাবিত, কা’ব ইবনু মালিক, আবদুল্লাহ্ ইবনু রাওয়াহা (রা) প্রমুখের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ‘এরা কুরাইশদের কাছে তীর নিক্ষেপের চেয়েও অধিকতর ভয়ঙ্কর।

‘বর্ণিত আছে, এ আয়াত নাযিলের পর আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা, কা’ব ইবনু মালিক ও হাসান ইবনু হাবিত (রা) কাঁদতে কাঁদতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খিদমতে হাজির হয়ে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কবিদের সম্বন্ধে আয়াত নাযিল হয়েছে, আমরা তো কবি।’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘সম্পূর্ণ আয়াত পড়, ঈমানদার, নেককারদেরকে বলা হয়নি।’তখন তারা নিশ্চিত হলেন।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *