ইসলাম

যারা গান-বাজনা হালাল মনে করে তাদের কিছু ভ্রান্তি

১) তারা দাবি করে গান-বাজনার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলো দুর্বল!

এর জবাব : এগুলো বিশুদ্ধ ও মজবুত সনদে বর্ণিত হাদীস। এমনকি কিছু হাদীস তো কুরআনের পরে সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ বুখারিতেও আছে! তবে এ-সংক্রান্ত কিছু দুর্বল হাদীসও আছে৷ কিন্তু অধিকতর বিশুদ্ধ হাদীসের মাধ্যমে গান-বাজনা হারাম হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত, অতীতের আলিমগণ সকলেই একমত হয়েছেন, বাদ্যযন্ত্র-সংক্রান্ত হাদীসগুলো সহীহ। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ইমাম আবূ হামিদ গাযালি (রহিমাহুল্লাহ)। কিন্তু তিনি হাদীসের আলিম অর্থাৎ মুহাদ্দিস ছিলেন না। এ ছাড়া ইবনু হাযম (রহিমাহুল্লাহ) হালাল বলেছেন। কিন্তু তিনিও যদি হাদীসগুলোর ব্যাপারে অবগত হতেন, তবে গান-বাজনা হারাম হিসেবে গণ্য করতেন। আসলে (গান-বাজনা নিষিদ্ধ হবার ব্যাপারে বর্ণিত) নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলো তাঁর কাছে পৌঁছেনি। (তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছেন) ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ২/৪৪২-৪৪৩।

২) অনেকে বলেন, গান-বাজনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হারাম নয়। যদি গান-বাজনার সাথে অন্যান্য হারাম বিষয় যুক্ত থাকে, তবেই হারাম! দেখুন, অতিরিক্ত আরেকটি হারামের সাথে সংযুক্ত হলেই কেবল হারাম হবে, এটি একটি ভুল নীতি। এ নীতি অনুসারে তো মদের ক্ষেত্রেও বলা যায়— যদি মদের সাথে যিনা-ব্যভিচার বা বাদ্যযন্ত্রের সংযোগ না থাকে, তা হলে এটি হালাল। কেননা, এই সব কটিই তো হাদীসে একসাথে এসেছে! (তাই আলাদাভাবে এগুলো হারাম নয়, বরং একত্রে হারাম! এটা কি ঠিক হবে?)

তাদের উসূল অনুসারে আমরা বলতে চাই, বাদ্যযন্ত্রের সাথে মদ, যিনা কিংবা নিষিদ্ধ কোনো কিছু সংযুক্ত থাকা ছাড়া যদি এটা হারাম না হয়, তা হলে যিনা- ব্যভিচার বা মদ কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হারাম? হারাম হলে কেন? কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, إنَّهُ كَانَ لَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ : وَلَا يَحُصُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ ©

“নিশ্চয় সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না। এবং মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহিত করত না।(”সূরা হাক্কাহ, ৬৯ : ৩৩-৩৪)

যদি হারাম কোনো কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হারাম প্রমাণিত হবার জন্য আরেকটি হারামের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয়, তা হলে তাদের উসূল অনুসারে আমরাও তর্ক করে বলতে পারি, মিসকীন বা দরিদ্রকে অর্থ প্রদান না করলে আল্লাহর ওপর ঈমান না-আনা দোষের কিছু না। এবং এটি হারামও হবে না! (নাউযুবিল্লাহ!) বলাই বাহুল্য, এ ধরনের যুক্তি নিতান্তই হাস্যকর!

৩) অনেকে বলেন, গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র সূরা লুকমানের আয়াতে উল্লেখিত ‘অবান্তর কথাবার্তা’র অন্তর্ভুক্ত নয়, কিংবা সেই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে গান-বাজনার কথা বোঝা যায় না!

এর জবাব : সাহাবায়ে কেরাম (রদিয়াল্লাহু আনহুম) ওই আয়াত থেকে গান-বাজনার কথা বুঝেছেন। এমনকি ইবনু মাসঊদ (রদিয়াল্লাহু আনহু) এ ব্যাপারে তিনবার আল্লাহর নামে কসম করেছেন। পরবর্তী আলিমগণও এই বিষয়ে একমত হয়ে তাঁকে অনুসরণ করেছেন। দেখুন, আমি-আপনি কী বুঝলাম, সেই ব্যাখ্যার ওপর কুরআন নির্ভরশীল নয়। কুরআনের একটি আয়াত আরেকটি আয়াতের ব্যাখ্যা, এরপর রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস ও সাহাবায়ে কেরাম (রদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর ব্যাখ্যা। একটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল (নিয়ম) হলো, ‘যখন সাহাবায়ে কেরাম (রদিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, “কুরআনের এই আয়াত থেকে এটা বোঝানো হয়েছে” অথবা “এই বিষয়ে এটাই নির্দেশনা” : তখন এটি তো অর্থাৎ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখ-নিঃসৃত-বাণীর ন্যায় মর্যাদা রাখে।’

এর কারণ খুবই সহজ; সাহাবায়ে কেরাম (রদিয়াল্লাহ আনহুম) রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে না জেনে কোনো বৈধ বিষয়কে নিষিদ্ধ করবেন না। সাহাবাদের ব্যাপারে প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, “…এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন…. ।”[সূরা তাওবা, ৯ : ১০০]

সুতরাং, যদি তাঁদেরকে অনুসরণ না করি, তা হলে আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না। আমরা প্রশংসনীয় হতে পারব না। আর নিষ্ঠার সাথে তখনি তাঁদেরকে অনুসরণ করা সম্ভব, যখন আমরা তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসারে ইসলাম অনুসরণ করব। অর্থাৎ সাহাবাদের ব্যাখ্যানুসারেই কুরআন বুঝতে হবে, আমাদের মনগড়া-ব্যাখ্যা অনুযায়ী নয়।

৪) অনেকে ঈদের দিনে রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঘরে দুই বালিকার দফ বাজানোর বিশুদ্ধ হাদীসকে দলীল হিসেবে ব্যবহার করে বলতে চান—গান-বাজনা হালাল!

এর জবাব : দেখুন, সেখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক দুজন বালিকার কথা বলা হয়েছে। এমনকি আয়িশা (রদিয়াল্লাহু আনহা)-ও তখন একেবারে ছোটো ছিলেন। ইবনুল কাইয়িম (রহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন, ‘তিনি গান-বাজনা ঘৃণা করতেন ও এগুলোকে অপছন্দের দৃষ্টিতে দেখতেন। এ ছাড়া (গান-বাজনার ব্যাপারে) আয়িশা (রদিয়াল্লাহু আনহা)-এর অন্য কোনো উক্তি আমাদের জানা নেই। এমনকি তিনি তাঁর ভাতিজা কাসিম ইবনু মুহাম্মাদকে গান-বাজনা ঘৃণা করার শিক্ষা দিতেন। তিনি আয়িশা (রদিয়াল্লাহু আনহা)-র ছাত্র ছিলেন। কাসিমও গান-বাজনার বিরুদ্ধে মতামত উল্লেখ করেছেন। [৪]

উক্ত হাদীসের পরিস্থিতিও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেদিন ছিল ঈদের দিন এবং বাদ্যযন্ত্রটিও ছিল দফ (একমুখ খোলা ছোটো ঢোলবিশেষ)। সুতরাং যদি কেউ শুধু ঈদ কিংবা বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে দফ ব্যবহার করে, তবে সেটা সহ্য করা যায়। কেননা এটি ব্যতিক্রম পরিস্থিতি। এর বাইরে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রকে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির অন্তর্ভুক্ত করতে হলে অবশ্যই দলীল-প্রমাণ হাজির করতে হবে।

৫) যারা গান-বাজনার প্রতি আসক্ত তারা বলে, সাহাবি ও তাবিয়িরাও নাকি গান-বাজনা শুনতেন!

এর উত্তরে আমরা ইমাম মুসলিম (রহিমাহুল্লাহ)-এর ‘সহীহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখিত একটি উক্তির পুনরাবৃত্তি করতে চাই। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, الْإِسنادُ مِنَ الدِيْنِ وَلَوْلَا الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ “সনদের ধারাবাহিকতা বর্ণনা করা ইসলামের একটি অংশ। যদি এটা না থাকত, তা হলে যার মনে যা আসত, যা কিছু ইচ্ছা হতো— সবই বলতে পারত।”

উপসংহার

সুতরাং, যারা নানা রকম বিভ্রান্তিকর দাবি উপস্থাপন করে তাদেরকে এই আলোচনার মাধ্যমে দলীল-প্রমাণ হাজির করার আহ্বান জানানো হলো। যদি তাদের দাবির পক্ষে দলীল না আনতে পারে, তা হলে অবশ্যই সেটা হারাম। (অবশ্য তারা দলীল আনতেও পারবে না।)

পরিশেষে চলুন, বিষয়টিকে যৌক্তিক দৃষ্টিতে দেখা যাক। যাঁরা রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে দিন-রাত সাথি হিসেবে থাকতেন, তাঁরা ইসলামের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁদের আশেপাশের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে কুরআন নাযিল হয়েছে, তাঁরাই সর্বপ্রথম কুরআনের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করেছেন। আরবি ভাষার জ্ঞানে তাঁরাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ। তাঁদের ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে, ৭০০ বছর কিংবা ১৪০০ বছর পরের কোনো ব্যক্তির কথা আমরা গ্রহণ করতে পারি না, যাদের অনেকে হয়তো আরবি ভাষাও ঠিকমতো জানে না!

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *