ইসলাম

মিথ্যাবাদীর ভয়াবহ শাস্তি

সত্যবাদিতার বিপরীত হচ্ছে মিথ্যাচার। মিথ্যা মানুষকে নিন্দিত করে এবং পাপের পথে পরিচালিত করে।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। একটি মিথ্যাকে সত্য বলে প্রমাণ করার জন্য নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করা হয়। তারপরও মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়। মিথ্যাকে সত্য ও সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। মিথ্যাচার করাই যাদের অভ্যাস তারা সংসারে, সমাজে এবং দেশে নানা সমস্যা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

মিথ্যাবাদীর কবলে পড়ে প্রায়ই সমাজের নিরীহ মানুষ প্রতারিত হয়ে থাকেন। মিত্যাবাদীর ওপর আল্লাহ্পাকের অভিশাপ বর্ষিত হয়। মিথ্যাবাদী ক্রমশ মানসিক শক্তি ও সৎসাহস হারিয়ে ফেলে। তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।স্বীয় স্বার্থে যে কোনো কাজ করতে সে দ্বিধা করে না। যে মিথ্যাকে ত্যাগ করতে পারে সে কোনো প্রকার অন্যায় কাজ করতে পারে না। সকল পাপের মূল হচ্ছে মিথ্যা বলা।

একদা এক পাপিষ্ট মহানবী (সাঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে বললো, হে রাসূলুল্লাহ! আমি সবরকম অপরাধের সাথে যুক্ত। আমি কীভাবে এ চরম পাপাসক্তি থেকে রেহাই পেতে পারি? লোকটির কথা শ্রবণ করে মহানবী (সাঃ) বুঝলেন, সত্যি সত্যি লোকটি সৎপথে আসার উপায় খুঁজছে। তিনি চিন্তা করলেন, লোকটির মধ্যে যতো রকম অন্যায় কাজ রয়েছে তা যদি আমি বর্জন করতে বলি তাহলে হয়তো তার পক্ষে সবগুলো একসাথে বর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই মহানবী (সাঃ) বললেন, তুমি আজ থেকে মিথ্যা কথা বলা ত্যাগ কর। দেখবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

মহানবী (সাঃ) এর উপদেশকে সহজসাধ্য ভেবে সন্তুষ্ট হয়ে লোকটি মিথ্যা না বলার সংকল্প করল। এরপর সে নিজের বাড়ি যাওয়ার পর যখন নামাজের সময় উপস্থিত হলো তখন সে চিন্তা করল এখন যদি আমি নামাজ আদায় না করি তাহলে আগামীকাল মহানবী (সাঃ) এর কাছে যাই, তখন তিনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, গতকাল তুমি কি নামাজ পড়েছিলে- তখন আমি কি উত্তর দেবো? লোকটি জবাবদিহিতার ভয়ে সময়মতো নামাজ আদায় করল।

রাতের বেলায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে মদ্যপান করা লোকটির আরেকটি বদ অভ্যাস ছিল। রাতে মদ্যপানের সময় উপস্থিত হলে মহানবী (সাঃ)-এর কাছে কৃত ওয়াদার কথা তার স্মরণ হয়ে গেল। এসব চিন্তা করে সে মদের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিলো। মিথ্যা বলার ভয়ে সে সব রকম পাপ থেকে বিরত রইল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানতেন, মিথ্যা বলা এমনই জঘন্য অপরাধ, তা ত্যাগ করতে পারলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়। এজন্য মিথ্যাকে সকল পাপের উৎস বলা হয়ে থাকে।

নিম্নে মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো—

মিথ্যা হিদায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত করে :

মিথ্যা মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে গরমিল সৃষ্টি করে। এই স্বভাবের কারণে সে ছিরাতে মুস্তাকিম থেকে ছিটকে পড়ে এবং আল্লাহর হিদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সুপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা : মুমিন/গাফের, আয়াত : ২৮)

প্রশান্তি বিলুপ্ত ও সন্দেহ সৃষ্টি করে :

মিথ্যা মানুষের মনে সন্দেহ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। মিথ্যাবাদীর অন্তরে সর্বদা অস্থিরতা বিরাজ করে এবং এটি তার মানসিক প্রশান্তি বিদূরিত করে। রাসুল (সা.) বলেন, যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয় তা পরিত্যাগ করে যাতে সন্দেহ নেই, তা গ্রহণ করো।

কেননা সত্য হচ্ছে প্রশান্তি আর মিথ্যা হচ্ছে সন্দেহ। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৮)

রিজিক ও বরকতে ঘাটতি সৃষ্টি করে :

মিথ্যা এমন এক জঘন্য অপরাধ, যা মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে। মিথ্যা বলার মাধ্যমে মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হতে চেষ্টা করে, কিন্তু এতে সে সাময়িক কিছু অর্জন করতে পারলেও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, মিথ্যা কসম পণ্যের কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত কমিয়ে দেয়।

(বুখারি, হাদিস : ২০৮৭)

মিথ্যা শপথকারী আল্লাহর ক্রোধের পাত্র :

মানুষ যেসব পাপের দ্বারা দুই জাহানে ক্ষতির অতল তলে নিমজ্জিত হয়, তন্মধ্যে মিথ্যা শপথ অন্যতম। এটি কবিরা গুনাহ। এর মাধ্যমে মানুষ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে এবং অন্যের ক্ষতি করতে তৎপর হয়। এসব ব্যক্তিকে আল্লাহ পরকালে মুক্ত করবেন না। ফলে তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির শিকার হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে ঠাণ্ডা মাথায় মিথ্যা শপথ করে, সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে আল্লাহ তার ওপর ক্রোধান্বিত থাকবেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৫৪৯)

মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনাকারীর শাস্তি :

মানুষ বিভিন্নভাবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তন্মধ্যে মিথ্যা স্বপ্ন অন্যতম। উচ্চ মর্যাদা পেতে, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে, নিজেকে ডাক্তার, কবিরাজ বা ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিংবা শত্রুকে ভীতচকিত করার মানসে অনেকে মিথ্যা স্বপ্ন বলে বেড়ায়। অনেকেই তাদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়, অর্থ-সম্পদ ও ইজ্জত-সম্মান হারায়। এসব মিথ্যা স্বপ্ন যারা বলে বেড়ায়, পরকালে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সবচেয়ে বড় মনগড়া বা মিথ্যার মধ্যে রয়েছে ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে নিজ বাবা ছাড়া অন্যের সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে, যে স্বপ্ন সে দেখেনি, তা দেখার দাবি করে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) যা বলেননি তাঁর নামে তা বলে। (বুখারি, হাদিস : ৩৫০৯)

মিথ্যা পাপ ও জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে :

মিথ্যা মানুষকে পাপ ও অন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। আর পাপ তাকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আর তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা মিথ্যা পাপাচারের পথে নিয়ে যায়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহ তাআলার দরবারে তাকে কাজ্জাব (চরম মিথ্যুক) বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। (মুসলিম, হাদিস : ২৬০৭)

মিথ্যা বলা মোনাফেকি :

মিথ্যা বলা মোনাফেকির পরিচায়ক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মোনাফেকির আলামত তিনটি। (১) যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে; (২) ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং (৩) আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩)

মিথ্যাবাদীর মর্মান্তিক শাস্তি :

সামুরাহ বিন জুনদুব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাত শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। একদিন তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে আজ কেউ স্বপ্ন দেখেছ কি? কেননা আমাদের কেউ এরূপ স্বপ্ন দেখে থাকলে তা বর্ণনা করত এবং তিনি আল্লাহ যা চাইতেন সে অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে দিতেন। যথারীতি একদিন (ফজর সালাত শেষে) তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ আজ কোনো স্বপ্ন দেখেছ কি? আমরা বললাম, না। তিনি বলেন, কিন্তু আমি দেখেছি যে দুজন ব্যক্তি আমার কাছে এলো। অতঃপর তারা আমাকে পবিত্র ভূমির (শাম বা বায়তুল মুকাদ্দাসের) দিকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে এবং অপর ব্যক্তি একমুখ বাঁকানো ধারালো লোহার সাঁড়াশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে ওই বসা ব্যক্তির গালের এক পাশ দিয়ে ওটা ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পেছন পর্যন্ত চিরে দিচ্ছে। অতঃপর গালের অপর পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পেছন পর্যন্ত চিরে দিচ্ছে। এরই মধ্যে গালের প্রথমাংশটি ভালো হয়ে যায়। তখন আবার সে তা-ই করে (এভাবে একবার এগাল, একবার ওগাল চিরতে থাকে)।…অতঃপর তারা আমাকে ব্যাখ্যা বলে দিল যে যাকে সাঁড়াশি দিয়ে গাল চেরা হচ্ছিল সে হলো মিথ্যাবাদী। সে মিথ্যা রটনা করত। এমনকি তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিত। ফলে তার সঙ্গে কিয়ামত পর্যন্ত (কবরে) ওই ধরনের আচরণ করা হবে। (বুখারি, হাদিস : ১৩৮৬)

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *