তিন ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অবকাশ রয়েছে
মিথ্যা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ এবং ইসলাম একে হারাম ও কবিরা গুনাহ ঘোষণা করেছে। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা মিথ্যাচার বর্জন করো। কেননা মিথ্যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে এবং পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যাচারকে স্বভাবে পরিণত করলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তার নাম মিথ্যুক হিসেবেই লেখা হয়।’ (আবু দাউদ: ৪৯৮৯)
বান্দার জন্য আল্লাহ তাআলার রহমত অপরিসীম। কিন্তু মিথ্যাবদীর জন্য তাঁর ক্রোধের সীমা নেই। তিনি মিথ্যাবাদীদের শুধু ঘৃণা করেন না, উপরন্তু তিনি তাদের হেদায়াত পর্যন্ত দেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে হেদায়াত দেন না, যে সীমা লঙ্ঘনকারী, মিথ্যাবাদী’ (সুরা গাফির: ২৮)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা মিথ্যা পরিহার করো। কেননা মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে। আর পাপ মানুষকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়।’ (তিরমিজি: ১৯৭১)
সাধারণত আড্ডা জমিয়ে তুলতে মানুষ হাসিঠাট্টা, কৌতুকের বশে মিথ্যা বলে থাকে। এগুলোকে নির্দোষ মিথ্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হাদিস শরিফে এমন মিথ্যার ব্যাপারেও কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। রাসুল (স.) বলেন, ‘মানুষকে হাসানোর জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯০)
তবে শর্তসাপেক্ষে তিন ক্ষেত্রে সত্যের বিপরীত কথা বলার অবকাশ আছে। তা হলো, মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, বৃহত্তর অকল্যাণ থেকে রক্ষা করা এবং স্ত্রীকে খুশি ও মনোরঞ্জন করা। হজরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তিন ক্ষেত্র ছাড়া মিথ্যা বলা বৈধ নয়- ১) মানুষের মধ্যে আপস-মীমাংসার জন্য মিথ্যা বলা। ২) যুদ্ধক্ষেত্রে মিথ্যা বলা এবং ৩) স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা।’ (আবু দাউদ: ৪৯২১)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেছেন, ‘(হাদিসে উল্লিখিত তিনটি ক্ষেত্রে) শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও ক্ষতি থেকে বাঁচতে মানুষ বাড়িয়ে বলতে এবং সত্য অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। তাই যেখানে মীমাংসার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে কখনও অসত্য বলার অবকাশ রয়েছে।
যেমন দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসার জন্য একপক্ষের ভালো দিকগুলো অন্যপক্ষের কাছে বাড়িয়ে বলা এবং তার সুন্দর দিকগুলো তুলে ধরা। যদিও সে বিবদমান পক্ষ থেকে কথাগুলো শোনেনি। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে প্রচার করা, এমন কথা বলা যাতে সঙ্গীরা সাহস পায় এবং শত্রুরা ধোঁকায় পড়ে যায়। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশে মিথ্যা বা বাড়িয়ে বলা। যাতে পারস্পরিক ভালোবাসা স্থায়ী হয় এবং পারিবার দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেমন- এমন কথা বলা যে, তুমি অমূল্য, তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, আমার চোখে তুমিই সবচেয়ে সুন্দরী ইত্যাদি। অধিকার হরণ বা দায়িত্ব থেকে পলায়নের জন্য মিথ্যা বলা বৈধ নয়। (শরহুস সুন্নাহ: ১৩/১১৯; তুহফাতুল আহওয়াজি: ৬/৬৯)
একইরকম হাদিস ইমাম তিরমিজির বর্ণনায়ও এসেছে। হাদিসটি হলো- ‘তিনটি ব্যাপার ছাড়া মিথ্যা বলা বৈধ নয়। তা হলো- স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে স্বামীর মিথ্যা। যুদ্ধের ময়দানে মিথ্যা বলা। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি তৈরি করতে মিথ্যা বলা।’ (সুনানে তিরমিজি: ১৯৩৯)
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘এ হাদিস দ্বারা (বিশেষ প্রয়োজনে) মিথ্যা বলার অবকাশ রয়েছে ঠিক, তবে তা কৌশলে সীমাবদ্ধ রাখা উত্তম।’ আর ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জারির তাবারি (রহ.) বলেন, যুদ্ধের ময়দানে মিথ্যা বৈধ হওয়ার অর্থ হলো- ‘কৌশল’ অবলম্বন করা বৈধ। কেননা প্রকৃত মিথ্যা বৈধ হয় না।’ (আবুল ফজল জাইনুদ্দিন আবদুর রহিম ইরাকি, তরহুত-তাসরিব ফি শরহিত-তাকরিব: ৭/২১৫)
লক্ষণীয় হলো, হাদিসে তিন ক্ষেত্রে মিথ্যার অবকাশ দেওয়া হলেও তাকে ‘মিথ্যা’ই বলা হয়েছে। সত্যের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। আর মুহাদ্দিসগণ তার ব্যাখ্যায় বলেছেন কৌশল অবলম্বন করার কথা। সুতরাং আমাদের উচিত নানা অজুহাতে মিথ্যার চর্চা না করে সর্বতোভাবে তা পরিহার করা। অল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।