আমানতের খেয়ানত : মুনাফিকের অন্যতম একটি আলামত
মুমিন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আমানতকারীর আমানত রক্ষা করা এবং যথাসময়ে তাকে তা হকদারকে ফিরিয়ে দেয়া। আমানতদারীর গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন, আমানত তার হকদারকে প্রত্যাবর্তন করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দিচ্ছেন তা কত উৎকৃষ্ট আল্লাহ সর্বশ্রোতা আল্লাহ সর্বস্রষ্টা।’ (সূরা নিসা: ৪৮)
উলিস্নখিত আয়াতে আমানতের বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে একদিকে যেমন হকদারের হক প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বিচারকের বিচারকার্য পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করতে বলা হয়েছে। এ থেকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়, আমানতদারী শুধু হকদারকে হক বুঝিয়ে দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করাটাও আমানতদারী।
আর এই দায়িত্ব অর্পণ যেমনিভাবে বান্দার পক্ষ থেকে অন্য বান্দার ওপর হতে পারে আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতিও হতে পারে। যেমন আল্লাহ মানুষকে সুস্থ বিবেক, হাত, পা, চক্ষুসহ যত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করেছেন সেগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহারেরও নির্দেশ দিয়েছেন। যদি কোনো ব্যক্তি আলস্নাহ-প্রদত্ত এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহ নির্দেশের বাইরে, পছন্দের বাইরে কোনোভাবে ব্যবহার করে তবে সে কিয়ামতের দিন খেয়ানতকারীদের দলভুক্ত হয়ে উঠবে।
আল কুরআনে আলস্নাহ ইরশাদ করেছেন, ‘চোখসমূহের খেয়ানত এবং অন্তরসমূহ যা গোপনে রাখে তা তিনি ( আল্লাহ জানেন )। (সূরা মুমিন : ১৯)। ওই আয়াতে চোখের অপব্যবহারকে খেয়ানত বলা হয়েছে। চোখের দ্বারা খেয়ানত বলতে চোখ দ্বারা এমন সব কিছু দেখা যা দেখলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সেটাই চোখের খেয়ানত, অনুরূপভাবে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিষয়টাও একইভাবে প্রমাণিত হয়। আল্লাহর পছন্দের বাইরে কোনো নাফরমানির কাজে ব্যয় করাও সময়ের খেয়ানত। আবার কেউ যদি কারও সঙ্গে কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য কারও সঙ্গে কোনো চাকরিতে চুক্তিবদ্ধ হয় আর ওই চাকরিজীবী যদি ওই চুক্তিবদ্ধ সময়ের মধ্যে কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি না নিয়ে অন্য কোথাও সময় ব্যয় করে তাও হবে বড় ধরনের শুধু খেয়ানতই নয়; বরং ধোঁকাবাজির শামিল। সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি একই সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলা করা, ধোঁকা দেয়া, সময়ের খেয়ানত করার গুনায় লিপ্ত হবে।
রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, যার চরিত্রে আমানতদারী নেই, তার ঈমান নেই। আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না তার দ্বীন নেই। (মুসনাদে আহমাদ)।
রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘মানুষের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্য থেকে যে গুণটি সবচেয়ে আগে অদৃশ্য হয়ে যাবে, তা হলো আমানতদারী তথা বিশ্বস্ততা। আর শেষ অবধি যা রয়ে যাবে, তা হচ্ছে নামাজ। এমন অনেক নামাজি আছে, যারা কোনো কল্যাণই অর্জন করতে পারে না। আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা খেয়ানত করো না কেননা খেয়ানত কতই না শাস্তি ও তিরস্কারযোগ্য।-আবু দাউদ ও তিরমিজি।
আমানতের খেয়ানত : মুনাফিকের অন্যতম একটি আলামত
আমানতের খেয়ানত করা মুনাফেকের অন্যতম চরিত্র। কোনো ব্যক্তি যদি কারো আমানতের খেয়ানত করে তবে সে ঈমানহীন হয়ে পড়ে। এ কারণেই আমানতের খেয়ানত করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
বর্তমান সময়ে আমানতের খেয়ানত মহামারী আকারে বেড়ে চলেছে। এ খেয়ানত মানুষকে মুনাফেকে পরিণত করছে। মুনাফেকদের ব্যাপারে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘হে নবি! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করুন এবং তাদের সম্পর্কে কঠোর নীতি অবলম্বন করুন। আর তাদের পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান। (সুরা তাওবা : আয়াত ৭৩)
আল্লাহ তাআলা আমানতের খেয়ানতকারী মুনাফিকদের পরকালীন অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে অবস্থান করবে। (সুরা নিসা : আয়াত ১৪৫)
আমানতের হেফাজত করতে আল্লাহ তাআলা কুরআন এবং হাদিসে মুমিন বান্দার জন্য নসিহত পেশ করা হয়েছে। এ চরিত্রের লোকদের ব্যাপারে কুরআন এবং হাদিসে এসেছে মারাত্মক সতর্কতা। যারা আমানতের খেয়ানতকারীর চরিত্রে অভ্যস্ত তাদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানতগুলো তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৫৮)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তার আমানত তাকে ফেরত দাও। আর যে ব্যক্তি তোমার আমানত আত্মসাৎ করেছে, তুমি তার আমানত আত্মসাৎ করো না।’ (আবু দাউদ)
যারা আমানতের খেয়ানত করে না তারা দুনিয়াতে যেমন সম্মানিত, পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ আমানতদার। ফলে তিনি দুনিয়ার সব শ্রেণির মানুষের কাছে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী বলে পরিচিত ছিলেন। আমানতদারের মর্যাদা ঘোষণায় হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একজন সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী আখেরাতে নবি-সিদ্দিক এবং শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (তিরমিজি)
কুরআন সুন্নাহর আলোকে বোঝা যায় যে, কোনোভাবেই আমানতের খেয়ানত করা যাবে না। যার যার আমানত তাকে যথাযথ ফিরিয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমানতের খেয়ানত করা মুনাফেকি। হাদিসে মুনাফেকির পরিচয় এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে সুস্পষ্ট মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ স্বভাবগুলোর কোনো একটি থাকে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফেকির একটি স্বভাব থেকে যায়। আর তাহলো-
- তার কাছে কেউ কোনো আমানত রাখলে তার খেয়ানত করে।
- সে কথা বললে মিথ্যা বলে।
- ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং
- ঝগড়া করলে গাল-মন্দ করে। (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)
অন্য হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুনাফেকের আলামত ৩টি-
- যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে।
- ওয়াদা করলে বরখেলাপ করে এবং
- আমানত রাখলে এতে খেয়ানত করে।’ (মিশকাত)
আমানতের খেয়ানতকারী মারাত্মক অপরাধী। হাদিসে আমানতের খেয়ানতকারকে ঈমানহীন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমানও নেই। আর যে ওয়াদা পালন করে না তার মধ্যে দ্বীন নেই।’ (মুসনাদে আহামদ)
বিজ্ঞাপন
হাদিসে ঘোষিত দুটি গুণের খেলাপকারীই মুনাফিক, যা কোনোভাবে কোনো মুমিন বান্দার জন্য কাম্য নয়।
মুমিন বান্দার উচিত আমানতের হেফাজত করা। আমানতদারিতার উত্তম গুণে নিজেকে গুণান্বিত করা। বান্দাসহ আল্লাহর দেয়া সব আমানতের হেফাজত করা। আমানতের হেফাজত করে দুনিয়া ও পরকালের সফলতা লাভ করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আমানতের হেফাজত করে দুনিয়া ও পরকালের সফলতা লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।