ইসলাম মৃত ব্যক্তিদের গালি দিতে নিষেধ করেছে
মানবতার ধর্ম ইসলামে অন্যকে গালি দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। যেকোনো কারণেই হোক, কাউকে গালি দেওয়ার অনুমতি নেই। হাসি-কৌতুক ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ। এমনকি মৃতদের গালি দিতেও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না। কারণ, তারা তাদের স্বীয় কর্মফল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।(’সহিহ বোখারি : ৬৫১৬)
কেউ মারা গেলে তাকে কোনোভাবেই গালিগালাজ করা যাবে না। ইসলাম এটাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা বা না করা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছাধীন। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের ফলাফল যথাযথভাবে ভোগ করতে হবে বলে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমের বহু জায়গায় ঘোষণা দিয়েছেন। তবে অন্যের মৃত্যুতে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া উচিত। এটি অন্যের জন্য কোনো দোয়া নয়। বরং এটা ইসলামের সুন্দর একটি পদ্ধতি ও নিয়ম, যা দ্বারা মহান প্রভু আল্লাহর পরিচয় ও বড়ত্ব প্রকাশ পায়।
কোনো ব্যক্তিকে গালি দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু চিহ্নিত কোনো অত্যাচারী, সীমালঙ্ঘনকারী যার সিদ্ধান্তে অথবা কর্মকাণ্ডে প্রচুর মানুষ হতাহত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন অথবা দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে জনগণের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট করেছেন এমন ব্যক্তি মারা গেলে তার ক্ষেত্রে কী করা হবে? তাকে গালি দেওয়ার দরকার নেই। তবে তার কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। এর প্রয়োজন দুটি কারণে।
প্রথমত, তার মতো আরও যারা চিহ্নিত অত্যাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারী আছেন তাদের শিক্ষা, অনুধাবন ও সংশোধনের জন্য।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জানা ও সতর্কতার জন্য। তাদের কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা না করে যদি শুধু জান্নাতের জন্য দোয়া করা হয়, তাহলে তাদের সমগোত্রীয়দের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তাতে জাতি ও সমগোত্রীয়রা কোনো শিক্ষা তো নেবেই না বরং এগুলো কোনো ব্যাপারই নয় মনে করে আশকারা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে অনেক বড় বড় জালেমের (যেমন ফেরাউন, হামান, আবু লাহাব, কারুণ, ছামেরি ও আজর প্রমুখ) নাম উল্লেখ করেছেন, ঘটনা বর্ণনা করেছেন ও ইতিহাস টেনেছেন নিশ্চয়ই মানুষের জানার জন্য, হৃদয়ঙ্গম ও শিক্ষা নেওয়ার জন্য। সহিহ হাদিস থেকে প্রমাণিত, নবী কারিম (সা.) ও সাহাবিরা কিছু কিছু জালেমের মৃত্যুতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। মিথ্যা নবীত্বের দাবিদার মুসাইলামার মৃত্যুতে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সিজদা দিয়ে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করেন। (সুনান, সাঈদ ইবনে মানসূর)
মুখাদ্দাজ আল খারেজির মৃত্যুতে খুশি হয়ে হজরত আলী (রা.) শোকরানা সিজদা দেন।(মুসনাদে আহমাদ)
সহিহ বোখারির শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তার ‘লিসান আল-মিজান’-এ একটা ঘটনা উল্লেখ করেন। ওয়াহাব আল কুরাইশি নামের এক পথভ্রষ্ট মারা গেলে আবদুর রহমান ইবনে মাহদি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ মুসলিমদের ওই পথভ্রষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।’ একজন ইমাম আহমাদকে (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরকম আনন্দিত হওয়া কি পাপ?’ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) জবাব দিলেন, ‘এমন কেউ কি আছে, এমন সংবাদ শুনে আনন্দিত হবে না?’ (আস সুন্নাহ, আল খাল্লাল)
নবী কারিম (সা.) বলেছেন, যখন (কোনো) জালেম (অত্যাচারী) মারা যায় তার কবল থেকে সব মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই (পরিত্রাণ পেয়ে) ‘স্বস্তি’ বোধ করে। হজরত আবু কাতাদাহ ইবনে রিবয়ী আনসারি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে একটি মানুষের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো। তখন তিনি বললেন, ‘স্বস্তি লাভকারী এবং তার থেকে স্বস্তি লাভকৃত।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! ‘স্বস্তি লাভকারী এবং তার থেকে স্বস্তি লাভকৃত’-এর মানে কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘মুমিন বান্দা মৃত্যুবরণ করলে দুনিয়ার কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেয়ে এবং আল্লাহর রহমত পেয়ে ‘স্বস্তি’ লাভ করে। আর বদকার বান্দা (পাপী ও জালেম) যখন মারা যায় তার কবল থেকে সব মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই (পরিত্রাণ পেয়ে) ‘স্বস্তি’ বোধ করে।’( সহিহ বোখারি : ৬১৪৭)
হাদিসের কথাগুলো গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। কারও জীবন যদি এমন হয় যে, তার মৃত্যুতে মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই পরিত্রাণ পেয়ে ‘স্বস্তি’ বোধ করে, তাহলে তার জীবনটা সত্যিই বরবাদ। সুতরাং প্রত্যেক মানুষের এমন জীবন গঠনের চেষ্টা করা উচিত, যাতে মারা গেলে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের কারণে ‘স্বস্তি’ বোধ করে আর দুনিয়াবাসী এমনকি বৃক্ষ ও জীবজন্তু তার জন্য কাঁদে।
ইসলামি স্কলারদের মতে, মানুষের প্রশংসা ও দুর্নামের ভিত্তিতে জান্নাত ও জাহান্নাম অবধারিত হতে পারে। হজরত আনাস (রা.) বলেন, কিছু লোক একটি মৃতদেহ নিয়ে পার হয়ে গেল। লোকেরা তার প্রশংসা করতে লাগল। নবী করিম (সা.) বললেন, ‘অবধারিত হয়ে গেল।’ অতঃপর দ্বিতীয় আরেকটি মৃতদেহ নিয়ে পার হলে লোকেরা তার দুর্নাম করতে লাগল। নবী করিম (সা.) বললেন, ‘অবধারিত হয়ে গেল।’ হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বললেন, ‘কী অবধারিত হয়ে গেল?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা যার প্রশংসা করলে তার জন্য জান্নাত, আর যার দুর্নাম করলে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেল। তোমরা হলে পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।’ (সহিহ বোখারি : ১৩৬৭, ২৬৪২)