ইসলাম

কৃপণতা ও অপচয় নয়, মধ্যমপন্থা ইসলামের শিক্ষা

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদের বেলায় কৃপণতা প্রদর্শন করে তারা যেন এ ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত না থাকে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যে সম্পদের বেলায় তারা কৃপণতা প্রদর্শন করেছে সে সম্পদ কিয়ামতের দিন তাদের গলায় হার রূপে পরিয়ে দেয়া হবে।’ -সূরা আল ইমরান: ১৮০

ইসলামি শরিয়তে পরিভাষায় কৃপণতা বলা হয়, যা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা কারও ওপর ওয়াজিব; তা না করাকে। এ কারণেই কার্পণ্য হারাম এবং এ জন্য কোরআনে কারিমে জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। যে সব ব্যয় ওয়াজিবের আওতাভুক্ত নয়, সে সব ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হারামের অন্তর্ভুক্ত নয়। অবশ্য সাধারণ অর্থে তাকেও কার্পণ্য বলা হয়। এ ধরনের কার্পণ্য হারাম নয় তবুও এটি উত্তমের পরিপন্থী এক অভ্যাস।

কৃপণতা একটি সামাজিক অপরাধ। বোখল বা কার্পণ্য অর্থে আরও একটি শব্দ কোরআন-হাদিসে ব্যবহৃত হয়েছে। তা হলো- ‘শুহ।’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ- কৃপণ হওয়া, কমে যাওয়া, লোভ করা ইত্যাদি। শব্দটি যখন নাফসুন শব্দের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করে ‘শুহ্হান নাফস’ বলা হয়, তখন তা দৃষ্টি ও মনের সংকীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা এবং মনের নীচতার সমার্থক হয়ে যায়। যা কৃপণতার চেয়েও ব্যাপক অর্থ বহন করে। এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি অন্যের অধিকার স্বীকার করে না। সে চায় দুনিয়ার সবকিছু সে একাই লাভ করুক। অন্য কেউ যাতে কিছু না পায়। নিজে তো দান করেই না বরং সে অন্যের দান করাটাও পছন্দ করে না। তার লালসার দৃষ্টি নিজ সম্পদের বাইরে অন্যের সম্পদের ওপর গিয়ে পড়ে। সে চায় চারদিকে যত ভালো বস্তু আছে তা সে দু’হাতে লুটে নেবে অন্যরা কিছু পাবে না।

এ কারণেই হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কৃপণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ এটিই তোমাদের পূর্বের লোকদের ধ্বংস করেছে। এটিই তাদেরকে রক্তপাত ঘটাতে এবং অপরের মর্যাদাহানি নিজের জন্য বৈধ করতে প্ররোচিত করেছে। এটিই তাদের জুলুম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাই তারা জুলুম করেছে। পাপের নির্দেশ দিয়েছে তাই পাপ করেছে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে বলেছে তা তারা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা শুহ বা মনের সংকীর্ণতা, কার্পণ্য থেকে মুক্ত থেকেছে, তারাই সফলকাম হয়েছে।’ –সূরা তাগাবুন: ১৬

কৃপণতা একটি সামাজিক ব্যাধিও বটে। এটি সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে। একটি সুস্থ সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো- ভ্রাতৃত্ববোধ। এটা ছাড়া কখনও একটি সুস্থ-সুশীল সমাজ গঠিত হতে পারে না।

কৃপণতার শাস্তি সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করা হয়েছে। কোরআনে কারিমের একাধিক আয়াতে এটিকে অকল্যাণকর বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং কোরআনে কৃপণ ব্যক্তিকে কষ্টদায়ক শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা স্বর্ণ-রোপ্য জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না। তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।’ -সূরা তওবা: ৩৪

এ আয়াতে এটি একটি অকল্যাণকর ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কৃপণ ব্যক্তি জান্নাত হতে দূরে, আল্লাহ হতে দূরে, কিন্তু জাহান্নামের নিকটবর্তী।’ –সুনানে তিরমিজি

যারা অর্থলোভী মূলত তারাই কৃপণ হয়। সম্পদ জমাতে জমাতে এক পর্যায়ে তার মধ্যে মানবিক প্রেম-প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতি কোনো কিছুই আর থাকে না। এমনকি তার নিজের লোককেও চরম বিপদের সময়ে দান করতে সে কুন্ঠাবোধ করে।

অপচয় কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়

ব্যয়কুণ্ঠতা হলো- কৃপণতা বিপরীতধর্মী বিষয়। কৃপণতার পাশাপাশি ইসলাম অপচয় কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়কেও অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সম্পদ ব্যয়ে সীমা অতিক্রম করো না। আল্লাহতায়ালা অপব্যয়কারীদের পছন্দ করেন না। -সূরা আনআম: ৪১

কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, অপব্যয় করো না। অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান হচ্ছে- তার প্রভুর প্রতি অকৃতজ্ঞ। -সূরা বণী ইসরাঈল: ২৬-২৭

মধ্যমপন্থা বা ভারসাম্যতা

বর্ণিত দুই প্রান্তিক চরিত্রের মাঝামাঝি ইসলাম মধ্যমপন্থা অবলম্বনের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতির নেতা হিসাবে আল্লাহতায়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার হাত গলার সঙ্গে বেঁধে রেখো না, (অর্থাৎ ব্যয়ের বেলায় কৃপণ হয়ো না) আর একেবারে খোলা ছেড়েও দিও না (অর্থাৎ নিজের সব কিছু উজাড় করে দিয়ে খালি হাতে বসে থেকো না)- অন্যথায় তুমি তিরস্কৃত ও অক্ষম হয়ে যাবে। -সূরা বণী ইসরাঈল: ২৯

এর অর্থ হলো- লোকদের মধ্যে এতটুকু ভারসাম্য থাকতে হবে, যাতে তারা কৃপণ হয়ে অর্থের আবর্তন রুখে না দেয় এবং অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস না করে ফেলে। এ দু’টির মাঝামাঝি তাদের মধ্যে ভারসাম্যের এমন সঠিক অনুভূতি থাকতে হবে, যার ফলে তারা যথার্থ ব্যয় থেকে বিরত হবে না। আবার অযথা ব্যয়জনিত ক্ষতিরও শিকার হবে না।

অহংকার ও প্রদর্শনেচ্ছামূলক এবং লোক দেখানো খরচ, বিলাসিতা, ফাসেকি ও অশ্লীল কাজে ব্যয় এবং এমন যাবতীয় ব্যয় যা মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনেও কল্যাণমূলক কাজে লাগার পরিবর্তে ধন-সম্পদ ভুল পথে নিয়োজিত করে, তা আসলে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা এভাবে ধন-দৌলত খরচ করে তারা শয়তানের ভাই।

ইসলাম ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির জন্য যথোপযুক্ত কর্মসূচি দিয়েছে। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত হলো- এই কর্মসূচির অন্যতম উপাদান। এগুলোর নিয়মিত অনুশীলনের ফলে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এছাড়া মুসলমানদের আল্লাহর পথে দান করার সাধারণ নির্দেশ দিয়ে তাদের অর্থসম্পদে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকার কায়েম করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, মুসলমানকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল ও মানব দরদী হতে হবে।

স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা পরিহার করে নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে প্রতিটি সৎকাজে এবং ইসলাম ও সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ব্যয় করতে হবে। ইসলাম শিক্ষা ও অনুশীলন এবং ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার সামষ্টিক পরিবেশ কায়েমের মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে এ নৈতিক বল সৃষ্টি করতে চায়। এভাবে কোনো প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়া হৃদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় মানুষ সমাজ কল্যাণে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। ইসলামি সমাজে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পরস্পরকে আর্থিক সাহায্য তথা ঋণ দেয়া অপরিহার্য কর্তব্যরূপে চিহ্নিত হবে। ইসলাম একটি ভারসাম্য জীবন ব্যবস্থা হিসেবে জীবনের সামগ্রিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য বা মধ্যমপন্থার শিক্ষা দিয়েছে। যার অবস্থান কৃপণতা ও অপচয়ের মাঝামাঝি।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *