কৃপণতা থেকে বেচে থাকার উপায়
মানুষের মধ্যে যতগুলি মারাত্মক দোষের সমাবেশ ঘটে, এর মধ্যে কৃপণতা উলেখযোগ্য। কৃপণ ঐ গর্ধবের ন্যায় যার পীঠে থাকে মনিমানিক্কের বোঝা এবং পেটে থাকে শুধু শুকনা খড় আর প্রকৃত বড় মানুষ সেই ব্যক্তি, যে ধন সম্পদকে মোটেও বড় মনে করে না। এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ কৃপণতা হতে বেঁচে থাকার। এখানে সম্ভাব্য কিছু উপায় আলোচনা করা হলো।
১. সম্পদের মহব্বত দ্বীল হতে বের করা।
কৃপণতার প্রধান কারণ হচ্ছে সম্পদের প্রতি মহব্বত। অর্থাৎ, সম্পদের প্রতি খাহেশ এবং স্বয়ং সম্পদকেই ভাল মনে করা। এজন্য কৃপণতা হতে বাঁচতে হলে সম্পদের মহব্বত দ্বীল হতে বের করে দানশীলতার অভ্যাস গড়ে তোলা। হযরত মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, দুইটি ক্ষুধার্ত বাঘকে বকরীর পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে তারা বকরীর পালে এই পরিমাণ ক্ষতি করে না যে পরিমাণ মানুষের মালের লোভ ও সম্মানের লিপ্সা তার দ্বীনের ক্ষতি করে। (তিরমিযী)
২. দানশীলতার অনুশীলন করা।
অন্যের প্রতি দয়াপরশ হয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নিজ মন থেকে তাদেরকে কিছু দেওয়াই হলো দান। পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ’ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : ২৬১)
আবু হুরায়রা রাযিয়ালাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন দানকারীর জন্য দু’আ করে বলে, হে আল্লাহ দানকারীর মালে বিনিময় দান করো।(বিনিময় সম্পদ বৃদ্ধি করো)’ আর দ্বিতীয়জন কৃপণের জন্য বদ দু’আ করে বলেন, হে আল্লাহ কৃপণের মালে ধ্বংস দাও।’ (বুখারী, মুসলিম)
অন্যত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব দূর করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের সব বিষয় সহজ করে দেবেন।’ (মুসলিম)
৩. জীবনের অর্জিত সম্পদ একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করা।
আল্লাহকে খুশি করার জন্য নিজের জন্য, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ ও মানবতার কল্যাণ এবং সর্বপরি আল্লাহর দ্বীন এর প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কাজে যে অর্থ ব্যয় হয় সবই ইনফাক ফী সাবিলিলাহ’র অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে খরচ হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য। মানুষকে দেখানোর জন্য, মানুষের ভালবাসা নেয়ার জন্য, মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য, মানুষের মাঝে গর্ব অহঙ্কার প্রকাশ করার জন্য এবং দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য দান না করা। খ্যতিলাভ, প্রদর্শনেচ্ছা কিংবা জাগতিক কোন স্বার্থে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোন কাজে অর্থ খরচ হলেও তা ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহর হিসেবে আল্লাহ’র কাছে গৃহীত হবেনা। কারণ দান যদি একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয় তা দ্বারা আখেরাতে তার কোন প্রতিদান পাওয়া যাবে না বরং আল্লাহ’র আজাবে পতিত হতে হবে।
ইমাম গাযযালী রহমাতুলাহি আলাইহি বলেন, শরী’আত ও মনুষ্যত্বের নির্দেশ অনুসারে যা ওয়াজিব তা দান করলেই কৃপণতা হতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। তবে এটির অতিরিক্ত দান না করলে কেউই দানশীলতার মর্যাদা লাভ করতে পারে না। তৎপর যে যত বেশি দান করবে সে তত বেশি দানশীলতার মর্যাদা লাভ করবে এবং সেই পরিমাণে তার সওয়াবও বৃদ্ধি পাবে। দান সহজসাধ্য না হয়ে এটিতে মনঃকষ্ট হলে এইরূপ দাতাকে দানশীল বলা চলে না। আর কেউ ধন্যবাদ এবং প্রশংসা পাওয়ার আশায় দান করলে সেও দানশীলতার মর্যাদা পাবে না। (কিমিয়ায়ে সা’দাত)
৪. শরী’আতের বিধানানুযায়ী হজ্জ, যাকাত, জিহাদ ও কুরবানীতে খরচ করা।
৫. সৎকাজে এবং ইসলাম ও সামাজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ব্যয় করা।
৬. সকলের হক আদায়ে সচেষ্ট ও সচেতন থাকা। যেমনঃ মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সহ সকলের হক আদায়ে সচেষ্ট ও সচেতন থাকা ।
৭. অভাব মোচনের উদ্দেশ্যে অভাবের সময় ক্ষুধার্ত লোকদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য সামর্থ্য পরিমাণ অর্থ খরচ করা।
৮. এছাড়াও সুন্নাতের অনুসারী বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী কোন ব্যক্তিকে নিজের অনুসরণীয় ব্যক্তি বানিয়ে নেয়া।
কৃপণতাও, দানশীলতা, অপচয়, অপব্যয় এবং মিতব্যয়ীতা এই বিষয় গুলো আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আমার কোন কাজে কতটুকু অপচয় হচ্ছে? কোন কাজে কতটুকু অপব্যয় হচ্ছে? বা আসলেই অপচয়-অপব্যয় হচ্ছে কি না? কোনটি কৃপণতা আর কৃপণতার বিপরীতে দান করতে গিয়ে আমি অপচয় করছি কি না? কতটুকুইবা মিতব্যয়ী হতে হবে আসলে এটি মিতব্যয়ীতা নাকি কৃপণতা? এই সমস্যাগুলি একজন সাধারণ মানুষের জন্য বুঝা বা বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক কাজটি করা অত্যন্ত কঠিন। এজন্য এই সমস্ত সমস্য থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে একজন আল্লাহওয়ালার সাথে সম্পর্ক কায়েম করে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অবস্থার কথা তাকে জানাতে হবে এবং ব্যবস্থাপত্র নিতে হবে।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে কৃপণতা হতে হেফাজত করে দানশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন। (আমিন)