ইসলাম

ইসলামে প্রমাণিত সকল বিষয় ঈমানের জন্য শর্ত না হলেও বিশ্বাস করা ওয়াজিব

ওপরে ঈমানের সংজ্ঞায় উল্লেখ হয়েছে যে, ইসলামে যে সকল বিষয় অকাট্যভাবে ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তা সত্যায়ন করা ও বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য শর্ত, যা ছাড়া মুমিন হওয়া যাবে না ৷

এখন জানার বিষয় হলো, যে সকল বিষয় অকাট্যভাবে ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়, তবে বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত সেগুলোর হুকুম কী?

ইসলামে বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত বিষয়গুলো যদিও সত্যায়ন করা ও বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য শর্ত নয়, এরপরও একজন মুমিনের জন্য সেগুলো বিশ্বাস করা ওয়াজিব ও জরুরি।

প্রখ্যাত মুহাক্কিক ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ. (মৃ. ৮৬১ হি.) লেখেন, ‘যা কিছু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন, তার সবই ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তাঁর আনীত সকল বিষয় আকীদাগত ও আমল-সংশ্লিষ্ট সবই বিশ্বাস করা ওয়াজিব। আর আমল-সংশ্লিষ্ট থেকে উদ্দেশ্য হলো, তা সত্য হওয়া বিশ্বাস করা।

উভয় বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ অনেক বেশি। তাই সংক্ষিপ্তভাবে এতটুকু যথেষ্ট যে, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”-এর স্বীকৃতি প্রদান করা এবং (মৌখিক স্বীকৃতির সাথে) অন্তরের বিশ্বাস মিল থাকা ও আত্মসমর্পণ করা (তথা ইসলামের আনুগত্য অবধারিত মেনে নেওয়া)।

এরপর কিছুদূর এগিয়ে বলেন, যে সকল বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়, বরং সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, যেমন : কবরে (মুনকার-নাকীর) দুই ফেরেশতার প্রশ্ন এবং সাদকায়ে ফিতরা ওয়াজিব হওয়া—এমন বিষয় রাসূল থেকে প্রত্যক্ষকারী (সরাসরি জেনেছেন এমন) ব্যক্তি অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে।

আর অপ্রত্যক্ষকারী (সরাসরি না জানা) ব্যক্তি অস্বীকার করলে তাকে ফাসেক ও গোমরাহ বলা হবে। কেননা, সে সরাসরি রাসূলের মুখ থেকে শোনেনি। তাই তার নিকট এটা রাসূল থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়।

সুতরাং তার এ-জাতীয় বিষয় অস্বীকার করাটা রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার নামান্তর নয়; বরং বর্ণনাকারীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা কিংবা ভুলের শিকার হয়েছে মনে করা। কাজেই এটা ফাসেকী ও গোমরাহী।

তবে হ্যাঁ, এ-জাতীয় বিষয় যদি রাসূলের বক্তব্য হওয়ার কারণে তাঁর প্রতি অবজ্ঞা করে অস্বীকৃতি করা হয়, তখন কাফের হয়ে যাবে।

মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, ‘যে সকল বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়, সেগুলো বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য শর্ত নয়, তবে সেগুলো বিশ্বাস করা ও আমল করা ওয়াজিব।

আর অকাট্যভাবে অপ্রমাণিত বিষয়গুলো বিশ্বাস করা যদিও ঈমানের জন্য শর্ত নয়, কিন্তু তা বিশ্বাস করা ও আমল করা যেহেতু ওয়াজিব, তাই কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যে ঈমান আনার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘যা কিছু আল্লাহর প্রেরিত, নবীর আনীত বা তাঁর ওপর নাযিলকৃত কিংবা ইসলামে বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত, তার সবই সত্যায়ন ও বিশ্বাস করা।’ এবং ইমামগণও সুস্পষ্টভাবে ঈমানের সংজ্ঞায় এমন বলেছেন, যেমন ওপরে হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. ও ইবনুল হুমাম রাহ.-এর বক্তব্যে তা উল্লেখ হয়েছে। আরও কিছু বক্তব্য নকল করছি। এরপর কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য থেকে ঈমান আনার বিষয় তুলে ধরা হবে।

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর (মৃ. ১৫০ হি.) বক্তব্যে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে, তার সবই অন্তর ও মুখের দ্বারা বিশ্বাস করে, সে আল্লাহর নিকট এবং মানুষের নিকট মুমিন।

ইমাম তাহাবী রাহ. (মৃ. ৩২১ হি.) তাঁর বিখ্যাত ‘আকীদা’ গ্রন্থে বলেন,“ঈমান হলো মৌখিক স্বীকারোক্তি দেওয়া এবং আন্তরিক বিশ্বাস করা। আর (এর বিবরণ হচ্ছে,) আল্লাহ তাআলা কুরআনে যা কিছু নাযিল করেছেন এবং শরীয়ত ও এর ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা কিছু বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তার সবই সত্য।’

তিনি আরও বলেন,’আহলে কিবলাদের (আমাদের কিবলায় যারা নামাজ পড়ে) আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন-মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করব, যতক্ষণ পর্যন্ত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত সকল বিধি-বিধান স্বীকার করবে এবং তাঁর প্রতিটি কথা ও সংবাদকে বিশ্বাস করবে।’

ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী রাহ. (মৃ. ৫০৮ হি.) লেখেন, ‘ঈমান হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা বিশ্বাস করা। এমন বক্তব্য আকায়িদে নাসাফী’-সহ অনেক কিতাবে আছে।

ইমাম আবুল হাসান আশআরী রাহ. (মৃ. ৩২৪ হি.) বলেন, ‘এ বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণিত সকল বিষয়ে বিশ্বাস পোষণ করা। এভাবে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যেও সকল বিষয় বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘রাসূল তার ওপর তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। তারা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছেন। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না (যে, কারও প্রতি ঈমান আনব আর কারও প্রতি আনব না)। এবং তারা বলে, আমরা (আল্লাহ ও রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশিমনে) কবুল বা পালন করছি।”(সূরা বাকারা, আয়াত :২৮৫)

আরও ইরশাদ হয়েছে,*আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, তা বিশ্বাস করে—আর তা-ই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে আগত সত্য—আল্লাহ তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তাদের অবস্থা সংশোধন করে দেবেন।(সূরা মুহাম্মদ, আয়াত :০২)

সহীহ হাদীসে এসেছে, ‘আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য না দেওয়া পর্যন্ত এবং আমার প্রতি ও আমি যা (আকীদা ও আমল) নিয়ে এসেছি, এগুলোর প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত।’‍(সহিহ মুসলিম,হাদীস নং: ২১)

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ঈমান – আকিদা ১

লেখকঃ মাওলানা সাঈদ আহমদ উস্তাদঃ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *