কুফরের পরিচয়
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ ঈমান-বিশ্বাসের বিষয়ে কুফর করবে, তার (ভালো) আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য হবে।’সূরা মায়েদা, (৫) : ৫
অর্থাৎ ইসলামের যেসব বিষয়ের ওপর ঈমান আনা অপরিহার্য, তা যদি অবিশ্বাস, অস্বী কার ও প্রত্যাখ্যান করে বা এগুলোর প্রতি ঈমান না আনে, তাহলে কাফেরদের মতো তার ভালো আমল নিষ্ফল। আখিরাতে যার কোনো প্রতিদান নেই।
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আর দলগুলোর মধ্যে যারাই কুরআনকে অস্বীকার করবে, জাহান্নামই তার নির্ধারিত স্থান।’সূরা হুদ, (১১) : ১৭
যত দল ও জাতি আছে, সকলকেই কুরআনের প্রতি ঈমান আনতে হবে। যে তা করবে না, তার ঠিকানা হবে নিশ্চিত জাহান্নাম। অর্থাৎ আখিরাতের নাজাত পূৰ্ণাঙ্গ কুরআনের প্রতি ঈমান আনার ওপরই নির্ভরশীল।
তাই কুফরের সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘যে সকল বিষয়ের ওপর ঈমান আনা অপরিহার্য, এর ওপর ঈমান না আনা।’
একটা বিধানের ক্ষেত্রেও কুফর পাওয়া গেলে ঈমান থাকবে না
অনেকে মনে করেন, মুমিন হওয়ার জন্য যেভাবে ইসলামের সব বিধান বিশ্বাস ও স্বীকার করতে হয়, তেমনই ঈমান নষ্ট হওয়ার জন্য ইসলামের সকল বিধানকে অবিশ্বাস বা অস্বীকার করতে হয়। অথচ অকাট্যভাবে প্রমাণিত যেকোনো একটা বিধানকে অবিশ্বাস বা অস্বীকার করলেই ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাফের হয়ে যাবে।
এর উদাহরণ হচ্ছে, হাওয়া দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে ওড়ানোর জন্য সবখানে ভালো ও ফুটোমুক্ত হতে হয়, কিন্তু হাওয়া বের হওয়ার জন্য একটা ফুটোই যথেষ্ট। এভাবে বালতির মধ্যে পানি থাকার জন্য এবং পানিতে নৌকা ভাসার জন্য সম্পূর্ণ ভালো ও ছিদ্রমুক্ত হতে হয়, কিন্তু তলাতে একটা ফুটো ও ছিদ্র হলেই বালতির পানি বের হয়ে আসবে এবং নৌকা পানিতে ডুববে।
অনুরূপ মুমিন হওয়ার জন্য ইসলামের সবই বিশ্বাস ও স্বীকার করতে হয়, কিন্তু ঈমান নষ্ট হওয়ার জন্য অকাট্য একটা বিধানকেই অবিশ্বাস বা অস্বীকার করাই যথেষ্ট। এ কারণেই শয়তান একটি সিজদার আদেশ অস্বীকার করার ফলে কাফের হয়েছিল।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যখন আমি আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করল। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। এবং সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। সুতরাং ঈমানের গণ্ডিতে থাকতে হলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত ইসলামের সকল বিধানকেই বিশ্বাস ও স্বীকার করতে হবে।
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। তারা যা করে আল্লাহ সে সম্বন্ধে অনবহিত নন। সূরা বাকারা, (২) : ৮৫
প্রখ্যাত মুফাসসির ও মুহাদ্দিস ইমাম তাবারী রাহ. (মৃ. ৩১০ হি.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তিকে কিতাব ও রাসূলগণের ওপর ঈমান এনেছে বলা হবে, যে তাঁর সত্যায়নকৃত কিতাবের সকল বিষয়ের ওপর ঈমান আনবে এবং যেই রাসূলের সত্যায়ন করছে, তাঁর আনীত সকল বিষয়ের ওপর ঈমান আনবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি ওগুলোর মধ্য থেকে কিছু বিশ্বাস করল আর কিছু অবিশ্বাস করল, সে নবীর আনীত কিছু বিষয় অস্বীকার করার কারণে মূলত নবুওয়াতকেই অস্বীকার করল। আর যে কোনো নবীর নবুওয়াতকে অস্বীকার করল, সে নবীকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। (কাজেই সে মুমিন থাকতে পারে না। ) জামিউল বয়ান বা তাফসীরে তাবারী, ১/৩৫৩
আরও ইরশাদ হয়েছে,“(হে নবী!) আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে আপনাকে সিদ্ধান্ত দানকারী মানবে। এরপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং অবনত মস্তকে তা মেনে নেয়।’সূরা নিসা (৪) : ৬৫
ইমাম আবু বকর জাসসাস হানাফী রাহ. (মৃ. ৩৭০ হি.), ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী শাফেয়ী রাহ. (মৃ. ৬০৬ হি.) ও ইবনে আদিল হাম্বলী (মৃ. ৭৭৫ হি.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, ‘আয়াতটির ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহ বা রাসূলের কোনো (অকাট্য) বিধান প্রত্যাখ্যান করবে, সে ইসলাম থেকে খারেজ হয়ে যাবে। এই আয়াত (আবু বকর রাযি.-এর খেলাফতকালে) যাকাত আদায় অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে মুরতাদ হওয়ার সিদ্ধান্ত আরোপ করে তাদের হত্যা ও শিশুদের বন্দি করার পক্ষে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান গ্রহণের বিষয়টি সঠিক ছিল বলে সাব্যস্ত করে।
একটু আগে যেই আয়াত উল্লেখ হয়েছে,‘যে ব্যক্তি ঈমানের বিষয় প্রত্যাখ্যান করবে, তার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য হবে।
এখানেও ঈমানের বিষয় প্রত্যাখ্যান করলেই কাফের বলা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ)-এর বহুল আলোচিত বিবর্তনবাদ মেনে এ বিশ্বজগৎকে অবিনশ্বর বিশ্বাস করা অথবা মানুষ বানর থেকে উদ্ভব হয়েছে কিংবা মানুষ ও বানর-শিম্পাঞ্জি একটি সাধারণ প্রাইমেট-জাতীয় প্রাণী থেকে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে মনে করা কুফর। কেননা, এগুলো মানার অর্থ হচ্ছে একাধিক আয়াতকে অস্বীকার করা, যেখানে এ বিশ্বজগৎকে নশ্বর ও মানুষ সৃষ্টির তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। কাজেই যে বিবর্তনবাদের আড়ালে উপরিউক্ত কুফরী বিশ্বাস লালন করবে, সে কীভাবে মুমিন-মুসলিম থাকতে পারে?
ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. (মৃ. ১৮৯ হি.) বলেন, ‘কেউ যদি ইসলামী বিধি-বিধানের কোনো বিষয় অস্বীকার করে, তাহলে নিশ্চিত তার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (তথা তার ঈমান) বাতিল বলে গণ্য হবে।’
ইমাম সারাখসী রাহ. (মৃ. ৪৮৩ হি.) এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘অস্বীকারের কারণে সে মুরতাদ হয়ে যাবে।
ইমাম আবু হানীফা রাহ. (মৃ. ১৫০ হি.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সকল বিষয় বিশ্বাস করল, তবে (শুধু একটা বিষয়ের ব্যাপারে) এ কথা বলল যে, মুসা ও ঈসা আ. উভয়জন রাসূল কি না আমার জানা নেই, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। (কেননা, উভয়জনকে রাসূল বিশ্বাস করা ফরজ।)
ইমাম মাতুরীদী রাহ. (মৃ. ৩৩৩ হি.) বলেন,‘যে ব্যক্তি সকল কিতাব ও রাসূলের ওপর ঈমান আনল, কিন্তু কোনো একটি আয়াত বা কোনো একজন রাসূলের ওপর ঈমান আনল না, তাহলে সে মুমিন নয়। ১৮৮
কাযী ইয়ায মালেকী রাহ. (মৃ. ৫৪৪ হি.) লেখেন,…‘আমরা প্রত্যেক ওই ব্যক্তিকে সুনিশ্চিত কাফের মনে করি, যে শরীয়তের কোনো একটি মূলনীতি, অথবা রাসূল থেকে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত ও সর্বসম্মত কোনো কাজ অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে। যেমন : কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আবশ্যকতা এবং তার রাকাত ও সিজদা-সংখ্যা অস্বীকার করে।
পাকিস্তানের সাবেক মুফতী আযম শফী রাহ. (মৃ. ১৩৯৬ হি.) বলেন, ‘কুফর শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করার নাম নয়; বরং এটাও কুফরের অন্তর্ভুক্ত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অকাট্য ও সুনিশ্চিত প্রমাণিত বিধানের কোনো একটাকে অস্বীকার করা, যদিও সে বাকি সকল বিধানকে স্বীকার করে এবং সবগুলোর ওপর খুবই ইহতিমামের সাথে আমল করে।
ইমাম তাহাবী রাহ. (মৃ. ৩২১ হি.) তাঁর ‘আকীদা’ গ্রন্থে বলেন, ‘আমাদের কিবলাপন্থীদের ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুমিন-মুসলিম হিসেবে আখ্যায়িত করব, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত সকল বিধি-বিধান স্বীকার করবে এবং তিনি যা কিছু বলেছেন ও সংবাদ দিয়েছেন, তার সবই বিশ্বাস করবে।”
এর অর্থ হচ্ছে, কেউ মুমিন-মুসলিম হিসেবে আখ্যায়িত হবে ততক্ষণ, যতক্ষণ ইসলামের সকল অকাট্য বিধি-বিধান বিশ্বাস ও স্বীকার করবে। কাজেই অকাট্য বিধি-বিধানের একটাও অবিশ্বাস ও অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে।
এ জন্যই কুফরের সংজ্ঞায় ব্যাখ্যা সহকারে এভাবে বলা হয়েছে, ‘অকাট্যভাবে প্রমাণিত এমন যেকোনো বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যায়ন ও বিশ্বাস না করা।’
সুতরাং কেউ যদি অস্বীকার না করে, কিন্তু ইসলামের অকাট্যভাবে প্রমাণিত কোনো বিষয়ে বিশ্বাস থেকে বিরত থাকে, তাহলে সেও কাফের বলে বিবেচিত হবে। কারণ, ঈমান হচ্ছে বিশ্বাসের নাম; কিন্তু তার থেকে বিশ্বাস পাওয়া যায়নি বিধায় তাকে মুমিন গণ্য করার সুযোগ নেই।
অনুরূপ যে ব্যক্তি সংশয়-সন্দেহ পোষণ করবে, সেও কাফের বলে গণ্য হবে। কারণ, তার থেকেও বিশ্বাস পাওয়া যায়নি। সংশয়-সন্দেহ বিশ্বাসের পরিপন্থী; বরং মুনাফিকের আলামত। কাজেই এমন লোকেরা সর্বসম্মতভাবে কাফের।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ঈমান – আকিদা ১
লেখকঃ মাওলানা সাঈদ আহমদ উস্তাদঃ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম