মু’জিযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য
দার্শনিক আলিমদের মতে যাদু ও মু’জিযার মধ্যে বহুবিধ পার্থক্য বিদ্যমান । যথা :
১. কোন ওয়াসিতা বা মাধ্যম প্রয়োগ করে যাদু প্রদর্শন করা হয়। অর্থাৎ, যাদু কোন উপকরণ এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়। পক্ষান্তরে মু’যিজার পেছনে কোন উপকরণ থাকে না। কোন উপকরণের মাধ্যমে মু’জিযা প্রদর্শন করা যায় না। বরং আল্লাহ্ যখন ইচ্ছা করেন তখনই তিনি নবী বা রাসূলগণের মাধ্যমে মু’জিযার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এটাই হচ্ছে যাদু ও মু’যিজার মধ্যকার মূল তাৎপর্যগত পার্থক্য।
২. যাদুবিদ্যা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। পক্ষান্তরে মু’জিযা শিক্ষার মাধ্যমে হাসিল করা যায় না। বরং আল্লাহ্ নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে নিজ ইচ্ছায়ই এর প্রকাশ ঘটান।
৩. যাদুর মোকাবিলা করা সম্ভব। তাই এক যাদুকর অন্য যাদুকরের যাদুকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে মু’জিযার মুকাবিলা করা কোন মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই হযরত মূসা (আঃ) এর মু’জিযার সামনে ফিরাউনের আনীত দেড় লক্ষ যাদুকর ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়।
৪. যাদুকরদের যাদুর মধ্যে পরস্পর বৈপরিত্য থাকতে পারে, কিন্তু নবীদের মু’জিযার মধ্যে কোন বৈপরিত্য ছিল না এবং হতে পারে না।
৫. যাদুর কোন বাস্তবতা বা প্রকৃত স্বরূপ নেই। বরং যাদু হচ্ছে একটি অবাস্তব বিষয়। পক্ষান্তরে মু’জিযা হচ্ছে বাস্তব সত্য এক কুদরতী বিষয়। এর বাস্তবতার কথা অমুসলিম ব্যক্তিগণও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
৬. যাদু স্থান ও কালের সাথে সম্পর্কিত নয়। যেমন আল্ কুরআন সর্বকালের ও সর্ব স্থানের মানুষের জন্যই এক মু’জিযানা কিতাব।
৭. যাদু প্রদর্শন করা হয় পার্থিব স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। আর মু’জিযার প্রকাশ ঘটানো হয়েছিল ধর্মীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য।
৮. সাধারণতঃ মূর্খ ও নির্বোধ ধরনের লোকদের মধ্যেই যাদু প্রদর্শিত হয়ে থাকে এবং তারাই তা গ্রহণ করে থাকে। পক্ষান্তরে মু’জিযা প্রদর্শিত হয়েছিল সর্বস্তরের মানুষের সামনে। তারপর বুদ্ধিমান লোকেরাই এর থেকে হেদায়েত গ্রহণ করেছে। এখানে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে মু’জিযা ও কারামতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পরবর্তিতে তা উল্লেখ করা হবে।
৯. সাধারণভাবে সব নবী-রাসূলদের ব্যাপারে যেসব আকীদা রাখতে হয়, তার মধ্যে ৯ (নয়) নং হল নবী রাসূলগণের মধ্যে পারষ্পরিক মর্যাদার পার্থক্য রয়েছে। এটা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত ইয়াকীনী বিষয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : অর্থাৎ, আমি কতক নবীকে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরাঃ ১৭-বানী ইসরাঈল : ৫৫)
তবে খাস করে কোন্ নবী কোন্ নবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তা ইয়াকীনী বিষয় নয় বরং এর মধ্যে ব্যতিক্রমও রয়েছে।
১০. নবী রসূলগণ মা’সূম বা নিষ্পাপ তাঁদের দ্বারা কোন পাপ সংঘটিত হয় না। নবুওয়াতের আগে ও পরে সগীরা ও কবীরা সব ধরনের গোনাহ থেকে তাঁরা পবিত্র ও নিষ্পাপ। শরহে ফেকহে আকবার ও মেরকাত গ্রন্থে একথাটি অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে ঃ
নবীগণের ইসমত বা নিষ্পাপ হওয়ার আকীদা ঈমানের অংশ। এ সম্পর্কে ২য় খণ্ডে “ইসমতে আম্বিয়া প্রসঙ্গ” শীর্ষক আলোচনায় (পৃঃ ৪০৪) ইস্মত সম্পর্কে বিভিন্ন মত, দলীল-প্রমাণ ও ইস্মত অস্বীকার কারীদের বক্তব্যের খণ্ডনসহ একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ পেশ করা হয়েছে।
মু’জিযা ও কারামতের মধ্যে পার্থক্য
মু’জিযা ও কারামতের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য বিদ্যমান । যথা :
(১) মু’জিযার উদ্দেশ্য হল, নবুওয়াত অস্বীকারকারী লোকদের নিকট নবীর সত্যতা প্রমাণ করা। আর কারামতের উদ্দেশ্য হল, ওলী ও বুযুর্গ ব্যক্তির সম্মান বৃদ্ধি করা।
(২) মু’জিযা নবী রাসূলের সাথে খাস। অর্থাৎ, নবী-রাসূল ব্যতীত অন্য কারো থেকে ঘটিত অলৌকিক বিষয়কে মু’জিযা বলা হয় না। পক্ষান্তরে ওলী-দরবেশ সকলের থেকেই কারামত প্রকাশ পেতে পারে।
(৩) .ওলী তার অলৌকিক বিষয় গোপন রাখবেন। কিন্তু পয়গম্বরের দায়িত্ব হল, অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ করে দেয়া ৷
(৪) ওলী নিজ কারামত সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল নাও হতে পারেন। কিন্তু নবী-রাসূল তার মু’জিযা না জেনে পারেন না ।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬