তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান

“তাকদীর”এর শাব্দিক অর্থ হল- পরিকল্পনা, নকশা, পরিমাণ, নির্ধারণ করা, ব্যবস্থাপনা করা ইত্যাদি। পরিভাষায় তাকদীরের সংজ্ঞা হল : সমুদয় সৃষ্টির ভাল-মন্দ, উপকার-ক্ষতি ইত্যাদি যাবতীয় সবকিছুর স্থান-কাল এবং এ সবের শুভ-অশুভের পরিমাণ ও পরিণাম পূর্ব হতে নির্ধারিত করা।

আল্লাহ তা’আলা সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বে সৃষ্টি জগতের একটা নকশাও লিখে রেখেছেন, সবকিছুর পরিকল্পনাও লিখে রেখেছেন, এই নকশা ও পরিকল্পনাকেই বলা হয় তাকদীর। এই পরিকল্পনা এবং নকশা অনুসারেই সবকিছু সংঘটিত হয় এবং হবে। অতএব ভাল মন্দ সবকিছুই আল্লাহর তরফ থেকে পূবাহ্নেই নির্ধারিত এবং সেই নির্ধারণ বা তাকদীর অনুযায়ী সবকিছু সংঘটিত হয়- এই বিশ্বাস রাখতে হবে। ভাল এবং মন্দ, ঈমান ও কুফর, হেদায়েত ও গোমরাহী, ফরমাবরদারী ও নাফরমানী সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ – এই বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য।

কুরআন শরীফে বলা হয়েছে : তুমি বলে দাও, আল্লাহ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি একক, মহাপরাক্রমশালী। (সূরাঃ ১৩-রা’দঃ ১৬)

এর বিপরীত কেউ যদি ভাল বা ‘সু’-র জন্য একজন সৃষ্টিকর্তা আর মন্দ বা “কু”-র জন্য অন্য একজন সৃষ্টিকর্তা মানে তাহলে সেটা ঈমানের পরিপন্থী কুফর ও শিরক হয়ে যাবে। যেমন অগ্নিপূজারীগণ কল্যাণ ও ‘সু’-র সৃষ্টিকর্তা “আমান” কে মানে ৷ হিন্দুগণ ‘সু’-র সৃষ্টিকর্তা লক্ষ্মীদেবী এবং ‘কু’-র সৃষ্টিকর্তা শনি দেবতাকে মানে। এটা কুফর ও শির্ক।

এখানে এ প্রশ্ন করা যাবে না যে, সবই যখন আল্লাহর পরিকল্পনা অনুসারে হয়, তখন আমলের প্রয়োজন কি, যা হওয়ার তা তো হবেই ? এ প্রশ্ন করা যাবে না এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা কর্ম জগতের নক্শায় লিখে রেখেছেন, যদি মানুষ ইচ্ছা করে তাহলে এরূপ হবে আর যদি ইচ্ছা না করে তাহলে এরূপ হবে। এমনি ভাবে আল্লাহ তা’আলা মন্দ-এর সৃষ্টিকর্তা হলেও তিনি দায়ী নন বরং মানুষ মন্দ করার জন্য দায়ী। এ কারণে যে, তাকে আল্লাহ ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, সে নিজের ক্ষমতা ও ইচ্ছা শক্তি মন্দের জন্য ব্যয় করল কেন ? এরপরও তাকদীর সম্পর্কে এরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে এবং মনে তাকদীর ও ভাগ্য সম্পর্কে নানান প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, এরূপ প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, কেননা তাকদীরের বিষয়টি এমন এক জটিল রহস্যময়, যার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করা মানব মেধার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তা উদঘাটনের চেষ্টা করাও নিষিদ্ধ। আমাদের কর্তব্য তাকদীরে বিশ্বাস করা, আর আল্লাহ পাক আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন তাই আমল করে যাওয়া।

তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান রাখার অর্থ হল নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখা :

১. সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা সবকিছু লিখে রেখেছেন। তিনি পূর্বাহ্নেই সবকিছুর নকশা করে রেখেছেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগত ভাবে তোমাদের উপর যে মুসীবত আসে তা সংঘটিত করার পূর্বেই কিতাবে (লওহে মাহফুযে) লিপিবদ্ধ থাকে। আল্লাহর পক্ষে তা খুবই সহজ । (সূরাঃ ৫৭-হাদীদঃ ২২)

২. সবকিছু ঘটার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলার অনাদি-জ্ঞান সে সম্বন্ধে অবহিত এবং তাঁর জানা ও ইচ্ছা অনুসারেই সবকিছু সংঘটিত হয়। তবে কোন পাপ করে তার দায় থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য তাকদীরের দোহাই দেয়া জায়েয নয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ; তাঁর অজ্ঞাতসারে একটা পাতাও পড়ে না; মাটির অন্ধকারে কোন শস্যকণা কিংবা কোন রসযুক্ত বা শুস্ক কোন কিছু সব সম্পর্কেই তিনি অবগত, সবই সুস্পষ্ট কিতাবে (লওহে মাহফুযে) রয়েছে। (সূরাঃ ৬-আনআমঃ ৫৯)

৩. তিনি ভাল ও মন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তবে মন্দ সৃষ্টির জন্য তিনি দোষী নন বরং যে মাখলূক মন্দ উপার্জন করবে সে দোষী, কেননা মন্দ সৃষ্টি মন্দ নয় বরং মন্দ উপার্জন হল মন্দ। মন্দ সৃষ্টি এজন্য মন্দ নয় যে, তার মধ্যেও বহু রহস্য এবং বহু পরোক্ষ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাই ভাল কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং মন্দ কাজে তিনি অসন্তুষ্ট ।

৪. আল্লাহ তা’আলা কলম দ্বারা লওহে মাযে (সংরক্ষিত ফলকে) তাকদীরের সবকিছু লিখে রেখেছেন । তাই লওহ, কলম ও লওহে যা কিছু লিখে রাখা হয়েছে সব কিছুতে বিশ্বাস রাখা তাকদীরে বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত।

৫. মানুষ একদিকে নিজেকে অক্ষম ভেবে নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করবে না এই বলে যে, আমার কিছুই করার নেই, তাকদীরে যা আছে তা-ই তো হবে! আবার তাকদীরকে এড়িয়ে মানুষ খোদার সৃষ্টির বাইরেও কিছু করে ফেলতে সক্ষম- এমনও মনে করবে না। মোটকথা তাকদীরের সাথে তাদবীর বা চেষ্টা-চরিত্রের কোন বিরোধ নেই । আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, সে (ইয়া’কূব [আঃ]) বলল, ‘হে আমার পুত্র! তোমরা এক দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করবে না. ভিন্ন ভিন্ন দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি না। বিধান আল্লাহরই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি। এবং যারা নির্ভর করতে চায় তারা তাঁরই উপর নির্ভর করুক।’ (সূরাঃ ১২-ইউসুফঃ ৬৭)

৬. মানুষের প্রতি আল্লাহর যত হুকুম ও আদেশ নিষেধ রয়েছে, তার কোনটি মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। কোন অসাধ্য বিষয়ে আল্লাহ কোন হুকুম ও বিধান দেননি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে বিধান দেন না। (সূরাঃ ২-বাকারাঃ ২৮৬)

৭. আল্লাহ তা’আলার উপর কোন কিছু ওয়াজিব নয়, তিনি কাউকে কিছু দিতে বাধ্য নন, তাঁর উপর কারও কোন হুকুম চলেনা, যা কিছু তিনি দান করেন সব তাঁর রহমত ও মেহেরবানী মাত্র। ইরশাদ হয়েছে : তিনি (আল্লাহ) যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না,বরং তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। (সূরাঃ ২১-আম্বিয়াঃ ২৩)

৮. কোন অপরাধের দায় থেকে বাঁচার জন্য তাকদীরকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো জায়েয নয়।

৯. তাকদীর সম্পর্কে বিতর্ক করা নিষেধ। রাসূল (সাঃ) তাকদীর সম্পর্কে বিতর্ক করতে দেখলে প্রচন্ড রাগান্বিত হতেন। তাছাড়া হাদীছে আরও এসেছে তাকদীর সম্বন্ধে বিতর্ক করলে কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, তাকদীর সম্পর্কে কেউ বিতর্ক করলে কিয়ামতের দিন এ ব্যাপারে তাকে জবাবদিহী করতে হবে।

১০. তাকদীর সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা হল এটা আল্লাহ্ তা’আলার এমন এক জটিল রহস্যময় বিষয় যার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করা মানব মেধার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তা উদঘাটনের চেষ্টা করাও নিষিদ্ধ। হযরত আলী (রাঃ) বলেন ঃ তাকদীর হল এক আধারাচ্ছন্ন পথ তাতে চল না, একটা গভীর সমুদ্র তাতে ডুব দিও না, সেটা হল আল্লাহর এক রহস্য যা তোমার কাছে প্রচ্ছন্ন, তুমি তা উদঘাটনের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়ো না ।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সর্বসম্মত ফয়সালা হল কাযা ও কদর সত্য। অণু পরিমাণ কোন কিছু এর আওতা বহির্ভূত নয়। কেউ এর অণু পরিমাণ কোন কিছুর ব্যতিক্রম ঘটাতে সক্ষম নয়। এই বিশ্বাস রাখা ফরয। এ বিশ্বাস ব্যতীত ঈমান পূর্ণাঙ্গ হবে না।

হাদীছে বলা হয়েছে : চারটা বিষয়ে ঈমান আনা ব্যতীত কেউ মু’মিন হবে না। এ কথার সাক্ষ্য ব্যতীত যে, আল্লাহ এক ও আমি তাঁর রাসূল; তিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন। মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থান সম্বন্ধে ঈমান ব্যতীত এবং তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান ব্যতীত।(তিরমিযি , ইবনে মাজাহ)

কাযা ও কদর এর মাঝে পার্থক্য হল – কাযা শব্দের আভিধানিক অর্থ ফায়সালা করা, হুকুম দেয়া ইত্যাদি ।পরিভাষায় কাযা বলা হয় : অনাদিতে সৃষ্ট বস্তু সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলার যে ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল তাকেই কাযা বলে। আর কদর হল ঐ সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনার বিস্তারিত ও বাস্তব রূপ। যেমন প্রথমে একটি ইমারত নির্মাণের পরিকল্পনা করা হল। নির্মাণের পূর্বে মনে মনে তার একটি চিত্র কল্পনা করা হল। তারপর সেই কল্পিত চিত্র অনুসারে বাস্তবে ইমারত তৈরি করা হল। এখানে প্রথমটি হল কাযা আর দ্বিতীয়টি হল কদর। হযরত কাছেম নানুতবী (রহঃ)-এর মতে সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনার নাম কদর আর বিস্তারিত রূপের নাম কাযা ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *