আল্লাহর দীদার সম্বন্ধে আকীদা
দুই ধরনের দীদার প্রসঙ্গে আলোচনা রয়েছে :
১. মে’রাজে নবী (সাঃ)-এর দীদার : মে’রাজে রাসূল (সাঃ) আল্লাহর দীদার লাভ করেছিলেন কিনা এ ব্যাপারে চারটি মত পাওয়া যায়।
১. দীদার হয়নি। এটা হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মত। হযরত ইবনে মাসউদ ও হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর প্রসিদ্ধ মতও এটাই। হযরত মাছরুক থেকে বর্ণিত : তিনি হযরত আয়শা (রাঃ)কে জিজ্ঞাসা করলেন- মুহাম্মাদ (সাঃ) কি তাঁর রবকে দেখেছিলেন ? আয়শা (রাঃ) জওয়াবে বললেনঃ তোমার কথায় আমার লোম খাড়া হয়ে গিয়েছে। যে তোমাকে বলেছে, মুহাম্মাদ তাঁর রবের দর্শন লাভ করেছেন সে মিথ্যা বলেছে।(বুখারী ও মুসলিম)
২. আল্লাহর দীদার হয়েছে কলব দ্বারা। এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর একটি মত। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত : রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন ? তিনি উত্তর দিলেন আমি তাকে দেখেছি আমার অন্তর দ্বারা। (ইবন জারীর)
৩. তিনি আল্লাহকে দেখেছেন স্বচক্ষে। এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর প্রসিদ্ধ মত। শায়খ আবুল হাসান আশআরীর মতও এই। আল্লামা নববী মুসলিম শরীফের শরাহ্-র মধ্যে বলেনঃ এটাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের নিকট প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত।
৪. আল্লাহর দীদার হলেছিল কি-না এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা । এটা সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রহঃ)-এর মত। আল্লামা তাফতাযানী শরহে আকাইদ গ্রন্থে এ মতকেই চয়ন করেছেন। তার কারণ এই হাদীছ দ্বারা এটা সমর্থিত, হাদীছের কোন স্পষ্ট ভাষ্য চাক্ষুষ দেখার ব্যাপারে স্পষ্ট নয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি সম্ভবত তার এজতেহাদ। আর যাবের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ -আমি আমার রবকে সামনা সামনি দেখেছি এতে কোন সন্দেহ নেই। এ হাদীছের ছুবূতের ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। গাউছুল আযম আব্দুল কাদের জিলানীর নামে প্রচলিত গুনিয়াতুত তালিবীন গ্রন্থের বর্ণনা দ্বারা ধোকায় পতিত হওয়া ঠিক নয়। এটি মূলতঃ গাউছুল আযমের লিখিত গ্রন্থ নয়। তাঁর প্রতি এর সম্বন্ধকরণ সহীহ নয়। এর মধ্যে প্রচুর মওযূ’ (জাল) হাদীছ রয়েছে।
২. পরকালে আল্লাহর দীদার :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিকট জান্নাতে আল্লাহর দীদার লাভ হবে। প্রত্যেকে তার আমল অনুযায়ী আল্লাহর দীদার লাভ করবে। কেউ সর্বদা আল্লাহর জামাল ও সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করণে ডুবে থাকবে। আবার কেউ জীবনে একবার দীদার লাভ করবে।
সহীহ মত অনুযায়ী নারীগণও দীদার লাভ করবে।” জান্নাতে আল্লাহর দীদার লাভ হওয়ার দলীল
(১) কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : সেদিন বহু মুখমণ্ডল উজ্জ্বল থাকবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। (সূরাঃ ৭৫-কিয়ামাঃ ২২-২৩)
(২) বোখারী ও মুসলিমের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে- রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন : তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে প্রকাশ্যভাবে। মু’তাযিলাগণ আল্লাহ্ দীদার সম্ভব নয় বলে মত পোষণ করেন। তাদের আলী (যুক্তিগত) দলীল হল কোন কিছু দেখার জন্য নিম্নোক্ত কয়েকটি শর্ত রয়েছে :
১. যা দেখা হবে তা কোন নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে হবে।
২. সেটা নির্দিষ্ট কোন দিকে থাকতে হবে।
৩. সেটা যে দেখবে তার সামনে থাকতে হবে।
৪. দ্রষ্টা ও দৃশ্য বস্তুর মধ্যে খুব বেশী দূরত্ব বা খুব বেশী নৈকট্য কোনটাই থাকতে পারবে না।
৫. দৃশ্য বস্তু পর্যন্ত দৃষ্টির জ্যোতি পৌঁছুতে হবে।
এ সমস্ত শর্ত আল্লাহকে দর্শনের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত বিধায় আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। এর জওয়াব হলঃ দর্শনের এ সব শর্ত দৈহিক দর্শনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আর আল্লাহ তা’আলা এরূপ দৈহিক বিশেষণ থেকে পবিত্র। অতএব তাঁকে দর্শনের ক্ষেত্রে এসব শর্ত কার্যকরী নাও থাকতে পারে। তদুপরি জান্নাতে আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে এমন দৃষ্টিশক্তি দান করবেন যা এসব শর্ত ছাড়াও দেখতে সক্ষম হবে।
মু’তাযিলাদের প্রথম নলী (বর্ণনাজাত) দলীল হল : তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন কিন্তু দৃষ্টি তাঁর অধিগম্য। (সূরাঃ ৬-আনআমঃ ১০৩) এর জওয়াব হল – এখানে সব দৃষ্টির কথা বলা হয়নি, কিছু দৃষ্টি এর থেকে ব্যতিক্রম রয়েছে। কিংবা বলা হবে এখানে সব স্থান ও সব সময়ের কথা বলা হয়নি। কিংবা বলা হবে এখানে এদরাক অর্থাৎ, বেষ্টন করা বা সম্যক ভাবে দেখা না যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, মোটেই দেখা যায় না তা বলা হয়নি।
মু’তাযিলাদের দ্বিতীয় নলী দলীল হল ঃ সে (মূসা) বলল হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দাও,আমি তোমাকে দেখব। তিনি বললেন, তুমি কোনক্রমেই আমাকে দেখতে পাবে না। (সূরাঃ ৭-আ’রাফঃ ১৪৩) এর জওয়াব হল মূসা (আঃ)-এর সম্প্রদায় হটকারিতা পূর্বক আল্লাহ তা’আলাকে দেখতে চেয়েছিল, তাই তাদেরকে দর্শন দেয়া হয়নি। তদুপরি মূসা (আঃ)-এর আবেদনই একথা বোঝায় যে, আল্লাহ্ তা’আলার দর্শন সম্ভব; নতুবা আল্লাহর নবী অসম্ভব জিনিসের আবেদন করতেন না বরং শুরু থেকেই বলে দিতেন যে, আল্লাহর দীদার সম্ভব নয়।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬