মানব, দানব এবং ফেরেশতাকুলকে
জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন
আল্লাহ্ তা’আলা জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন অবাধ্য ও নাফরমান মানব ও দানবের জন্য। আর এদের দিয়েই জাহান্নামকে পূর্ণ করা হবে। সুতরাং আল্লাহ্তা ‘আলা এরশাদ ফরমান—
وَ لَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوْبُ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُونَ بِهَا
আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে অথচ তা দ্বারা তারা বিবেচনা করে না। তাদের চোখ রয়েছে, অথচ তা দ্বারা তারা দেখে না। –সূরা আ’রাফ-১৭৯
অন্যত্র এরশাদ ফরমান— وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لَاَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
আপনার পালনকর্তার ফয়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে যে, আমি অবশ্যই জাহান্নামকে মানব ও দানব জাতি দ্বারা পূর্ণ করে দেব। —সূরা হুদ ১১৯
অন্যত্র এরশাদ ফরমান— وَ لكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنَى لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ اجْمَعِيْنَ
তবে আমার পক্ষ থেকে একথা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে যে, আমি অবশ্যই মানব ও দানব দ্বারা জাহান্নামকে পূর্ণ করব। —সূরায়ে সাজদা-১৩
অন্যত্র এরশাদ ফরমান— যেদিন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সকলকে একত্রিত করবেন এবং বলবেন, হে জিন সম্প্রদায় তুমি মানুষদের মধ্যে অনেককেই অনুগামী করেছিলে । তাদের মানব বন্ধুরা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা পরস্পরে পরস্পরের জাহান্নামের বর্ণনা মাধ্যমে লাভবান হয়েছি। আমাদের জন্য যে সময় নির্ধারণ করেছিলেন, আমরা তাতে উপনীত হয়েছি। আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন, আগুন হল তোমাদের বাসস্থান। তথায় তোমরা চিরকাল বসবাস করবে। -সূরা আন’আম-১২৮
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে—জিনদের বক্তব্য
وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُوْنَ وَ مِنَّا الْقُسِطُوْنَ ، فَمَنْ أَسْلَمَ فَأَلْبِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا وَ وَأَمَّا الْقَسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا *
আমাদের কিছু সংখ্যক আজ্ঞাবহ এবং কিছু সংখ্যক অন্যায়কারী, যারা আজ্ঞাবহ হয় তারা সৎপথ বেছে নিয়েছে। আর যারা অন্যায়কারী অপরাধী তারা তো জাহান্নামের ইন্ধন হবে। —সূরা জিন ঃ ১৪-১৫
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে— سَنَفْرُغُ لَكُمْ أَيُّهَا الثَّقَلَانِ ، فَبِأَيِّ الَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ﴿
হে মানব ও দানব গোষ্ঠি! আমি শিঘ্রই তোমাদের হিসাব-কিতাবের জন্য অবসর হচ্ছি। অতএব, তোমরা আপন পালনকর্তার কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? –সূরা রহমান ঃ ৩১-৩২
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে— يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌ مِنْ نَّارٍ ، وَ تُحَاسُ فَلَا تَنْتَصِرْنِ . فَبِأَي الَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبُنِ فَإِذَا انْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالذِهَانِ فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبُنِ . فَيَوْمَيذٍ لَّا يُسْتَلُ عَنْ ذَنْبِةٍ إِنْسٌ وَلَا جَانٌ . فَبِأَيِّ الَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبْنِ . يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيْمُهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِي وَ الْأَقْدَامِ
তোমাদের প্রতি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এবং ধুম্রকুঞ্জ ছাড়া হবে। তখন তোমরা তা মোটেও প্রতিহত করতে পারবে না। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে। যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে, তখন সেটি রক্তবর্ণে রঞ্জিত চামড়ার মত হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে। সেদিন মানুষ না তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে অ’র না জিন। অতএব, তোমরা উভয়ে আপন পালনকর্তার কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে। অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা থেকে। অতঃপর তাদের কপালের চুল ও পা ধরে টেনে নেয়া হবে। —সূরা রহমান ঃ ৩৫-৪১
ফায়দা : হাদীসে বর্ণিত আছে যে, উক্ত সূরাটি হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিন সম্প্রদায়ের সামনে পাঠ করে তাদের নিকট দ্বীনের তাবলীগ করেছেন। কারণ, জন্ম-মৃত্যু, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং কৃতকর্মের শাস্তি ও প্রতিদান তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। আর উক্ত আয়াতে এগুলোর আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে।
ফেরেশতাদেরকে ভীতি প্রদর্শনের বর্ণনা
কুল মাখলুকাতের মধ্য থেকে ফেরেশতা এমন এক মাখলুক, যাদের কোন গোনাহ নেই । এ দিক দিয়ে তারা অপরাপর সকল মাখলূকাত অপেক্ষা আশরাফ ও শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকেও জাহান্নাম থেকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন, যা দ্বারা মানুষদেরকে সতর্ক করা উদ্দেশ্য। নিম্নে এতদবিষয়ক আলোচনা উল্লেখ করা হল ।
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান- তাদের মধ্যে যে বলবে, তিনি ব্যতীত আমি উপাস্য, তাকে আমি জাহান্নামের শাস্তি দেব। আমি যালেমদের প্রতিফল এভাবেই দিয়ে থাকি। —সূরা আম্বিয়া-২৯
হারূত-মারূতকে আযাব
সাহাবা, তাবেঈন এবং তৎপরবর্তী বুযুর্গানেদ্বীনের এক জামাত থেকে এ বর্ণনা প্রসিদ্ধ যে, হারুত মারুত উভয়ে ফেরেশতা ছিলেন। তাদের থেকে একটি গোনাহ প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল। ফলে তাদেরকে দুনিয়ার শাস্তি এবং আখেরাতের শাস্তি এ দুয়ের একটি গ্রহণে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। সুতরাং তারা এদিকে লক্ষ্য করে দুনিয়ার শাস্তিকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন যে, দুনিয়ার শাস্তি সহজেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আখেরাতের আযাব তো কখনোই শেষ হবার নয় ।
হযরত মিকাঈল (আঃ)-এর ভয়-ভীতি
হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন—
مَا لِيْ لَا أَرى مِيْكَابِيْلَ عَلَيْهِ السَّلَامَ يَضْحَكُ فَقَالَ جِبْرَبِيْلُ مَا ضَحِكَ مِیكَابِيْلُ مُنْذُ خُلِقَتِ النَّارُ –
কি ব্যাপার! আমি কখনও মিকাঈল (আঃ)-কে হাসতে দেখি না। উত্তরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যেদিন থেকে জাহান্নাম তৈরী হয়েছে, সেদিন থেকে মিকাঈল কখনোই হেসে দেখে নি । —আহমদ
হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর ভয়-ভীতি
হাদীস ঃ হযরত আবু উমরান আল নী (রহঃ) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে মুরসাল (যে হাদীস বর্ণনায় তাবেয়ী সাহাবীর মাধ্যম উল্লেখ করেন না) হাদীস রেওয়ায়ত করেন, একদা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) রাসূলে পাক (সাঃ)-এর খেদমতে কাঁদতে কাঁদতে হাজির হলেন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে জিব্রাঈল! আপনাকে কোন বস্তু এভাবে কাঁদাল । তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি ক্রন্দন করেন না? যে দিন থেকে জাহান্নাম তৈরী হয়েছে, সেদিন থেকে আজ নাগাদ আমার চক্ষুদ্বয় এ ভয়ে শুষ্ক হয়নি যে, না জানি আমি কখনও কোন নাফরমানি করে বসি কিনা। যে কারণে আমাকেও ঐ জাহান্নামে ফেলে দেয়া হয় । —কিতাবুয যুহদ, ইমাম আহমদ
হাদীস : হযরত ইমরান (রাযিঃ) বলেন, একদা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে মাথা ঝুকিয়ে আগমন করলেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে জিব্রাঈল! কী হল ? তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে । উত্তরে তিনি আরয করলেন, আমি জাহান্নামের প্রবল বাতাসের একটি ঝাপটা দেখেছি। এরপর থেকেই আমি কখনও প্রফুল্ল নাই । —তাবরানী
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাযিঃ) বলেন, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) একবার নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এমন সময় আগমন করলেন, যে সময় ইতিপূর্বে কখনও আগমন করেননি। তখন নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন—يَا جِبْرَيِيْلُ مَا لِي اَرَاكَ مُتَغَيّرَ اللَّوْنِ
হে জিব্রাঈল! তোমার কি হল, আমি তোমাকে বিবর্ণ দেখতে পাচ্ছি? এর উত্তরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি আপনার দরবারে তখনই এসেছি, যখন জাহান্নামের আগুনকে বৃদ্ধি করার আদেশ দেয়া হয়েছে।
অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন— হে জিব্রাঈল আমার নিকট জাহান্নামের কিছু বিবরণ দাও। এরপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) জাহান্নামের লম্বা বিবরণ দিতে থাকলেন। অতঃপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, যথেষ্ট হে জিব্রাঈল! আমার হৃদয়কে টুকরো টুকরো হতে দিও না। নয়ত আমি মারা যাব। অতঃপর তিনি জিব্রাঈল (আঃ)-এর দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখতে পেলেন, তিনি খুব ক্রন্দন করছেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন—
تَبْكِي يَا جِبْرَيِيْلُ وَ اَنْتَ مِنَ اللَّهِ بِالْمَكَان الَّذِي أَنْتَ فِيْهِ
হে জিব্রাঈল! আপনিও কি ক্রন্দন করছেন? অথচ আপনি আল্লাহ্তা ‘আলার নিকট ঐ মর্যাদায় রয়েছেন, যে মর্যাদায় আপনি এখানেও রয়েছেন?এর উত্তরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেন— وَ مَا لِي لَا أَبْكِي ، أَنَا اَحَقُّ مِنْكَ بِالْبُكَاءِ ، لَعَلَّى أَنْ أَكُوْنَ فِي عِلْمٍ اللهِ عَلَى غَيْرِ الْحَالِ الَّتِي أَنَا عَلَيْهَا وَ مَا أَدْرِي لَعَلَّى أَبْتَلِي بِمَا أُبْتُلِيَ بِهِ إِبْلِيسُ فَقَدْ كَانَ مَعَ الْمَلَائِكَةِ وَ مَا أَدْرِي لَعَلَّى أَبْتَلِي بِمَا أُبْتُلِيَ بِهِ هَارُوتَ وَمَارُوتَ –
কেনই বা আমি ক্রন্দন করব না? অথচ আমিই তো আপনার চেয়ে বেশি ক্রন্দনের হকদার। থেকে পারে আল্লাহ্ তা’আলার জ্ঞানে আমি ঐ অবস্থাতে নই, যেমন আমি এখন আছি । আমার জানা নেই, হয়ত আমি ঐ অবস্থায় পতিত হয়ে যাব, যে অবস্থায় ইবলিস পতিত হয়ে গিয়েছে। অথচ সেও তো ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল । আমার জানা নেই, হতে পারে আমাকে ঐ অবস্থায় পতিত করা হবে, যে অবস্থায় হযরত হারুত ও মারুতকে পতিত করা হয়েছে।
হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ক্রন্দন করলেন। সেই সাথে ক্রন্দন করলেন হযরত জিব্রাঈল (আঃ)ও। এভাবে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তারা উভয়ে কাঁদতে থাকলেন । ইতিমধ্যে আওয়াজ দেয়া হল, হে মুহাম্মদ! হে জিব্রাঈল! আল্লাহ্ তা’আলার নাফরমানী থেকে তোমাদেরকে হেফাজত করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের দ্বারা তাঁর নাফরমানী প্রকাশ পাবে না । অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) চলে গেলেন । হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এক দিকে চলতে থাকলেন। পথিমধ্যে তিনি এক আনসারী সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যারা খুব হাসছিল। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কি হাসছ? অথচ জাহান্নাম তোমাদের পেছনে ধাওয়া করছে। যদি তোমরা ঐ বিষয় জানতে যা আমি জানি, তাহলে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। তখন তোমরা সুস্বাদু খাবার ভোজন করতে না; বরং কোন অজানা ও অচেনা পাহাড়ে চলে যেতে । সেখানে গিয়ে তোমরা আল্লাহ্ তা’আলাকে পাওয়ার অভিপ্রায়ে ব্যস্ত থাকতে । অতঃপর গায়েব থেকে আওয়াজ আসল— يَا مُحَمَّدُ لَا تَقْنَط عِبَادِى إِنَّمَا بَعَثْتُكَ مَيْسَرًا وَ لَمْ اَبْعَتُكَ مُعْسِرًا –
হে মুহাম্মদ! আমার বান্দাদেরকে নৈরাশ করবেন না। আমি আপনাকে সহজ করণার্থে প্রেরণ করেছি। কঠিন করণার্থে প্রেরণ করিনি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন— سَدِدُوا وَ قَارِبُوْا তোমরা নেক আমলের উপর অবিচল থাক এবং অপরের সাথে মিলেমিশে থাক ।
হযরত আবু ফুযালা (রহঃ) স্বীয় মাশায়েখগণ থেকে রেওয়ায়ত করেন যে, তারা বলেছেন —
إِنَّ لِلَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ مَلَابِكَةً لَمْ يَضْحَكَ اَحَدُهُمْ مُنْذُ خُلِقَتْ جَهَنَّمُ مَخَافَةً أَنْ يَغْضِبَ اللهُ عَلَيْهِمْ فَيُعَذِّبَهُمْ
আল্লাহ্ তা’আলার কিছু ফেরেশতা রয়েছে এমন, যারা জাহান্নামের সৃষ্টিলগ্ন থেকে আজ নাগাদ এ ভয়ে হাসেনি যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাদের উপর নারায হয়ে তাদেরকে জাহান্নামে ফেলে দেন কি না ?
হযরত বকর আল আবেদ বলেন, আমি ইবনে আবী লাইলার এক শাগরিদ আবুল হাসানকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফেরেশতারাও কি হাসে? তিনি উত্তরে বললেন, যেদিন থেকে জাহান্নাম সৃজিত হয়েছে, সেদিন থেকে আরশের তলদেশের ফেরেশতারা মোটেও হাসেনি। —ইবনে আবিদ্দুয়া
প্রখ্যাত মুফাসসির মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (রহঃ) বলেন, যখন জাহান্নামকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তখন ফেরেশতাদের রূহ তাদের দেহ থেকে বের হয়ে গিয়েছে। এরপর যখন মানুষকে বানানো হল, তখন পুনরায় তাদের রূহ তাদের দেহে প্রত্যাবর্তন করেছে।
ইমাম তাউস (রহঃ) বলেন, যখন জাহান্নামকে বানানো হয়েছে, তখন ফেরেশতাদের অন্তর উড়তে শুরু করল, এরপর যখন মানুষকে সৃষ্টি করা হল, তখন তা আবারও তাদের দেহে ফিরে আসল এবং তারা স্থির হল । —আবু নুয়াইম
ফায়দা : আলোচ্য রেওয়ায়েতদ্বয় সনদগতভাবে দুর্বল। যদি এগুলোকে সঠিকও মনে করে নেয়া হয় তবে বুঝতে হবে, ফেরেশতাদের রূহ উড়ে যাওয়া এবং দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একারণে যে, যখন জাহান্নামকে প্রস্তুত করা হয়েছে, তখন একমাত্র ফেরেশতারা ছাড়া আর কেউ দুনিয়াতে ছিল না। তাই তারা এ আশংকা বোধ করেছে যে, হয়ত তাদের জন্যই জাহান্নাম প্রস্তুত করা হয়েছে। একারণেই তারা খুব অস্থির ও ব্যাকুল ছিল। আর একেই রূহ উড়ে যাওয়া বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এরপর যখন মানব জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তখন তারা বুঝতে পেরেছে, জাহান্নাম মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, তারা মাটির তৈরী, ফলে তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং হিংসা-বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকবে। এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। একথা ভেবে মানব সৃষ্টির পর তারা শান্ত ও স্থির হয়েছে। আর একেই ‘দেহে রূহ প্রত্যাবর্তন করেছে’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
পশু-পাখীর ভয়-ভীতি
হযরত ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর বলেন, আমাদের নিকট একথা পৌঁছেছে যে, যখন হযরত দাউদ (আঃ)-এর চিন্তার দিন আগমন করত, তখন বন-জঙ্গল থেকে বন্যপ্রাণী, হিংস্র জীব-জন্তু, বাঘ-ভাল্লুক ও সিংহ, পাখীর ঝাক মানবজাতি এক ময়দানে একত্রিত হয়ে যেত। হযরত দাউদ (আঃ) সেখানে তাশরীফ আনতেন। অতঃপর মিম্বরে দাঁড়িয়ে সর্বাগ্রে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা করতেন। এতেই সকল মানব-দানব ও পশু-পাখী চিৎকার করে করে কাঁদতে থাকত। অতঃপর তিনি জাহান্নামের আলোচনা শুরু করে দিতেন। এ আলোচনা শুনে সকল জাতি-প্রজাতি থেকে এক একটি করে মরে যেত। এরপর তিনি মউত ও তার ভয়াবহতা এবং কেয়ামত ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এরপর আবার প্রত্যেক জাতি-প্রজাতি থেকে এক এক দল মরে যেত। —ইবনে আবিদ্দুয়া
নিষ্প্রাণ পদার্থসমূহের ভয়-ভীতি
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান— وَ اِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْاَنْهرُ ط وَ إِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَقَّقُ يَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ ط وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ
আর কোন কোন পাথর এমনও আছে যা থেকে ঝরণা প্রবাহিত হয়, অতঃপর তা থেকে পানি নির্গত হয়। যা আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে খসে পড়তে থাকে । —সূরা বাকারা-৭৪
ফায়দা ঃ যে কোন পাথর, যা থেকে পানি উত্থিত হয় বা প্রবাহিত হয় বা যে পাহাড়ের চূড়া ধ্বসে পড়ে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ভয়েই ধ্বসে পড়ে । কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এর উল্লেখ রয়েছে ।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, পাহাড়ের যে সকল বড় বড় পাথর উপর থেকে ধ্বসে পড়ে, তাকে যদি মানবের বিশাল এক সম্প্রদায় অপসারনের চেষ্টা করে, তাহলেও অক্ষম হয়ে যাবে। এগুলো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ভয়েই ধ্বসে পড়ে। —জাওয়াজানী
হযরত ঈসা (আঃ)-এর যুগের এক পাহাড়
হযরত ফুযায়েল ইবনে আব্বাস ছিলেন আবদালগণের মর্যাদায় উন্নীত। অধিক ক্রন্দনের ফলে তার চেহারায় অশ্রুর নল হয়ে গিয়েছিল। বছর ভর রোযা রাখতেন। রাতে শুধু একটি পাতলা রুটি দ্বারা ইফতার করতেন। তিনি বলতেন—হযরত ঈসা (আঃ) একদা এমন এক পাহাড়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, যা দু’টি নদীর মধ্যখানে অবস্থিত ছিল। একটি নদী তার ডানে ও অপরটি তার বামে প্রবাহিত হচ্ছিল। তাঁর একথা জানা ছিল না যে, এ পানিগুলো কোত্থেকে প্রবাহিত হয়ে আসে। বর্ণিত আছে, ঐ পাহাড়ই আপন ভাষাতে বলতে থাকল, যে নদী আমার ডান দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তা আমার ডান চোখের পানি। আর যা আমার বাম দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তা আমার বাম চোখের পানি হযরত ঈসা (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, এমনটি কেন ? সে উত্তরে বলল, এ ভয়ে আমি ক্রন্দন করি যে, আল্লাহ্ তা’আলা যাতে আমাকে জাহান্নামের ইন্ধন না বানিয়ে দেন । হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, আমি দোয়া করে দিচ্ছি যাতে আল্লাহ্ তা’আলা তোকে আমার মালিকানায় দিয়ে দেন। সুতরাং তিনি দোয়া করলেন। ফলে পাহাড়টি তাকে দিয়ে দেয়া হল। অতঃপর হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ, তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।
এরপর আবদাল বললেন, অতঃপর ঐ পাহাড় থেকে পানির একটি ঝাপটা এসে হযরত ঈসা (আঃ)-কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ঈসা (আঃ) বললেন, হে পানি! আল্লাহ্ তা’আলার হুকুমে থেমে যা। আল্লাহ্ তা’আলার নিকট দোয়া করার ফলে তোকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এরপরও এত পানি কেন? পাহাড় থেকে জবাব আসল, পূর্বে কান্না ছিল জাহান্নামের ভয়ের কান্না। আর এখনকার কান্না হল শোকর আদায়ের কান্না । —ইবনে আবিদ্দুয়া
চন্দ্ৰও কাঁদে
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) বলেন, চাঁদও আল্লাহ্ তাআলার ভয়ে কাঁদে । হযরত তাউস (রহঃ) বলেন, চাঁদও আল্লাহ্র ভয়ে কাঁদতে থাকে । অথচ তার কোন ধরনের দোষ-ত্রুটি নেই। তার কোন সওয়াল-জওয়াব নেই ।নেই কোন হিসাব-নিকাশ ।
দুনিয়ার আগুনও জাহান্নামের আগুনকে ভয় করে
হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান—
إِنَّ نَارَكُمْ هَذِهِ لَجُزْءُ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنْ نَارٍ جَهَنَّمَ ، وَ لَوْلَا أَنَّهَا أَطْفَئَتْ بِالْمَاءِ مَرَّتَيْنِ مَا انْتَفَعْتُمْ بِهَا ، وَإِنَّهَا لَتَدْعُو الله أن لا يُعِيدَهَا
তোমাদের দুনিয়ার এ আগুন জাহান্নামের সত্তুর ভাগের এক ভাগ । ঐ আগুনকে যদি দুই বার পানি দ্বারা নিস্তেজ না করা হত, তাহলে তোমরা তা দ্বারা উপকৃত হতে পারতে না। দুনিয়ার এ আগুন প্রত্যহ এ দোয়া করতে থাকে, যেন তাকে পুনরায় জাহান্নামে নিক্ষেপ না করা হয় ।
হযরত আবু রজা বলেন, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হল, তখন আল্লাহ্ তা’আলা আগুনের নিকট ওহী প্রেরণ করলেন যে, যদি তুমি ইবরাহীমকে কষ্ট দাও, তাহলে আমি আবার তোমাকে জাহান্নামের বড় আগুনে নিক্ষেপ করে দিব। অতঃপর দুনিয়ার আগুন তিন দিন পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল । দুনিয়াবাসীদের কেউ তখন আগুন দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি। —ইবনে আবিদ্দুয়া
হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ)-এর আশ্রয় প্রার্থনা
আবু ইমরান আল জুনী (রহঃ) বলেন, আমাদের নিকট আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ)-এর একথা পৌঁছেছে যে, তিনি যখন আগুনের আওয়াজ শুনেন তখন বলেন, আমাকেও তো অনুরূপ বলা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি এটা কি বললেন? উত্তরে তিনি বললেন, কসম ঐ জাতের, যার কুদরতি হাতে আমার জীবন, দুনিয়ার এই আগুন জাহান্নামের বড় আগুন থেকে প্রত্যহ পানাহ চাইতে থাকে, যাতে তাকে পুনরায় জাহান্নামে নিক্ষেপ না করা হয়। অনুরূপ আমাকেও বলা হয়েছে যে, তুমিও জাহান্নামের আগুন থেকে এভাবে আশ্রয় প্রার্থনা কর।
ইমাম আ’মাশ (রহঃ) হযরত মুজাহিদ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে ।
তথ্যসূত্র:
বই :জাহান্নামের বর্ণনা মূল :আল্লামা মুফতী মোহাম্মদ এমদাদুল্লাহ আনওয়ার অনুবাদ :মাওলানা নাজমুল হুদা মিরপুরী