জাহান্নামীদের অপমান, আফসোস এবং নিজেদের ধ্বংস কামনা
যখন জাহান্নামীরা তাদের অবস্থানস্থল অবলোকন করবে তখন তারা কঠিনভাবে লজ্জিত হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ –
‘এবং তারা লজ্জা গোপন করবে, যখন তারা আযাব দেখবে এবং তাদের মাঝে ন্যায়ভিত্তিক ফায়ছালা করা হবে। আর তারা যুলমের স্বীকার হবে না’ (সূরা ইউনুস ১০/৫৪)।
আর যখন তাদের আমলনামা তাদের বাম হাতে অর্পন করা হবে এবং তারা তাদের কুফরী ও শিরকের পাপ আমলনামায় লিপিবদ্ধ দেখবে, তখন তারা নিজেদের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ – فَسَوْفَ يَدْعُو ثُبُوْرًا – وَيَصْلَىٰ سَعِيْرًا – ‘আর যাকে তার আমলনামা পিঠের পেছনের দিকে দেওয়া হবে, সে ধ্বংস আহ্বান করতে থাকবে। আর সে জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।’ (সূরা ইনশিকাক ৮৪/১০-১২)।
আর যখন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা পুনরায় নিজেদের ধ্বংস অহবান করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَإِذَا أُلْقُوْا مِنْهَا مَكَانًا ضَيِّقًا مُقَرَّنِيْنَ دَعَوْا هُنَالِكَ ثُبُورًا – لا تَدْعُوا الْيَوْمَ تُبُوْرًا وَاحِدًا وَادْعُوْا تُبُوْرًا كَثِيرًا –
‘আর যখন তাদেরকে গলায় হাত পেঁচিয়ে জাহান্নামের সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, সেখানে তারা নিজেদের ধ্বংসকে আহবান করবে। (তখন বলা হবে) ‘একবার ধ্বংসকে ডেকো না; বরং আরো অনেকবার ধ্বংসকে ডাকো’ (সূরা ফুরকান ২৫/১৩-১৪)।
অতঃপর যখন জাহান্নামের কঠিন শাস্তি তাদেরকে ঘিরে ধরবে তখন তারা জাহান্নাম থেকে বের হয়ে পুনরায় দুনিয়ায় এসে সৎ আমল করার জন্য আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَهُمْ يَصْطَرِحُوْنَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ نَصِيرٍ –
‘আর সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করে দিন, আমরা পূর্বে যে আমল করতাম, তার পরিবর্তে আমরা নেক আমল করব। (আল্লাহ বলবেন), আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি যে, তখন কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত? আর তোমাদের নিকট তো সতর্ককারী এসেছিল । কাজেই তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর, আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (সূরা ফাতির ৩৫/৩৭)।
সেই দিন জাহান্নামীরা তাদের ভ্রষ্টতা, কুফরী এবং জ্ঞান শূন্যতার কথা স্বীকার করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَقَالُوْا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ –
‘আর তারা বলবে, ‘যদি আমরা শুনতাম অথবা বুঝতাম, তাহলে আমরা জ্বলন্ত অগ্নির অধিবাসীদের মধ্যে থাকতাম না’ (সূরা মুলক ৬৭/১০)।
তিনি অন্যত্র বলেন, قَالُوْا رَبَّنَا أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَى حُرُوج مِن سَبِيْلٍ –
‘তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আপনি আমাদের দু’বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু’বার জীবন দিয়েছেন। অতঃপর আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি। অতএব (জাহান্নাম থেকে) বের হবার কোন পথ আছে কি’? (সূরা মু’মিন ৪০/১১)।
কিন্তু আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করবেন এবং তাদের সমুচীত জবাব দিবেন ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا صَالِيْنَ – رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُوْنَ – قَالَ احْسَتُوْا فِيْهَا وَلاَ تُكَلِّمُون –
‘তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! দুর্ভাগ্য আমাদের পেয়ে বসেছিল, আর আমরা ছিলাম পথভ্রষ্ট। হে আমাদের রব! এ থেকে আমাদেরকে বের করে দিন, তারপর যদি আমরা ফিরে যাই তবে অবশ্যই আমরা হব যালিম।’ আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা ধিকৃত অবস্থায় এখানেই থাক, আর আমার সাথে কথা বল না’ (সূরা মু’মিনুন ২৩/১০৬-১০৮)।
আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামীদের উপর তার ওয়াদা সম্পূর্ণ করবেন, এক্ষেত্রে তাদের ফরিয়াদ কোন কাজে আসবে না এবং তাদের পুনরায় দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনের কোন সুযোগ থাকবে না ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلَوْ تَرَى إِذِ الْمُجْرِمُونَ نَاكِسُوْ رُءُوسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ رَبَّنَا أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوْقِنُونَ وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلِّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنّي لَأَمْلَأَنْ جَهَنَّمَ مِنَ الْجَنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ – فَذُوقُوْا بِمَا نَسِيْتُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا إِنَّا نَسِيْنَاكُمْ وَذُوقُوا عَذَابَ الْخُلْدِ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ –
‘আর যদি তুমি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের রবের সামনে মাথানত হয়ে থাকবে। (বলবে) হে আমাদের রব! আমরা দেখেছি ও শুনেছি, কাজেই আমাদেরকে পুনরায় পাঠিয়ে দিন, আমরা সৎকর্ম করব। নিশ্চয়ই আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী। আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করতাম। কিন্তু আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, “নিশ্চয়ই আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব’। কাজেই তোমরা তোমাদের এই দিনের সাক্ষাতকে যে ভুলে গিয়েছিলে, তার স্বাদ তোমরা আস্বাদন কর।নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ভুলে গিয়েছি, আর তোমরা যা করতে, তার জন্য তোমরা চিরস্থায়ী আযাব ভোগ কর’ (সূরা সাজদাহ ৩২/১২-১৪)।
জাহান্নামীরা তাদের আবেদনে নিরাশ হয়ে জাহান্নামের প্রহরীগণের নিকট আসবে এবং কিছুটা হলেও শাস্তি কমানোর জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট সুপারিশ করার আবেদন করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَقَالَ الَّذِيْنَ فِي النَّارِ لِخَزَنَةِ جَهَنَّمَ ادْعُوا رَبَّكُمْ يُحَفِّفْ عَنَّا يَوْمًا مِنَ الْعَذَابِ قَالُوْا أَوَلَمْ تَكُ تَأْتِيْكُمْ رُسُلُكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوْا بَلَى قَالُوْا فَادْعُوْا وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِيْنَ إِلَّا فِي ضَلَالِ –
‘আর যারা জাহান্নামে থাকবে তারা জাহান্নামের দারোয়ানদেরকে বলবে, ‘তোমাদের রবকে একটু ডাকো না! তিনি যেন একটি দিন আমাদের আযাব লাঘব করে দেন।’ তারা বলবে, ‘তোমাদের নিকট কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের রাসূলগণ আসেননি? জাহান্নামীরা বলবে, ‘হ্যাঁ’ অবশ্যই । দারোয়ানরা বলবে, ‘তবে তোমরাই দো’আ কর। আর কাফিরদের দো‘আ কেবল নিষ্ফলই হয়’ (সূরা মু’মিন ৪০/৪৯-৫০)।
অবশেষে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ধ্বংসের জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট আবেদন করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ إِنَّكُمْ مَاكِثُوْنَ –
‘তারা চিৎকার করে বলবে, ‘হে মালিক! তোমার রব যেন আমাদেরকে শেষ করে দেন!’ সে বলবে, “নিশ্চয়ই তোমরা অবস্থানকারী হবে’ (সূরা যুখরুফ 80/99)1
অতএব, জাহান্নামীদের সকল আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে। তাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের কোন পথ থাকবে না, এমনকি শাস্তি হতে সামান্যটুকুও কমানো হবে না এবং তাদেরকে ধ্বংসও করা হবে না। বরং তাদের উপর জাহান্নামের শাস্তি চিরস্থায়ী হবে।
আর তাদেরকে বলা হবে, فَاصْبِرُوا أَوْ لَا تَصْبِرُوْا سَوَاءٌ عَلَيْكُمْ إِنَّمَا تُجْزَوْنَ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ –
তোমরা ধৈর্য ধারণ কর বা না কর, উভয়ই তোমাদের জন্য সমান; তোমাদেরকে তো কেবল তোমাদের আমলের প্রতিফল দেওয়া হচ্ছে’ (সূরা তূর ৫২/১৬)।
শেষ পর্যন্ত যখন তাদের কোন চেষ্টাই কাজে আসবে না তখন তারা এমনভাবে কাঁদতে থাকবে যে, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে পানির পরিবর্তে চোখ দিয়ে রক্ত নির্গত হতে থাকবে ।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ قَيْسٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ أَهْلَ النَّارِ لَيَبْكُوْنَ حَتَّى لَوْ أُخْرِيَتِ السُّفُنُ فِي دُمُوْعِهِمْ لَجَرَتْ، وَإِنَّهُمْ لَيَبْكُوْنَ الدَّمَ يَعْنِي مَكَانَ الدَّمْعِ
আব্দুল্লাহ ইবনু কায়েস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই জাহান্নামবাসীরা এমনভাবে কাঁদতে থাকবে যে তাদের চোখের পানিতে নৌকা চালালে তা চলবে এবং তারা রক্ত কান্না করবে, অর্থাৎ চোখের পানির স্থানে রক্ত নির্গত হবে। (মুসতাদরাক হাকিম হা/৮৭৯১; আলবানী, সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহা হা/১৬৭৯।)
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُرْسَلُ الْبُكَاءُ عَلَى أَهْلِ النَّارِ، فَيَبْكُونَ حَتَّى يَنْقَطِعَ الدُّمُوعُ ، ثُمَّ يَبْكُوْنَ الدَّمَ حَتَّى يَصِيرَ فِي وُجُوهِهِمْ كَهَيْئَةِ الأُخْدُودِ، لَوْ أُرْسِلَتْ فِيْهِ السُّفُنُ لَجَرَتْ
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, জাহান্নামবাসীদের উপর কান্না প্রেরণ করা হবে। তারা অনবরত কাঁদতে থাকবে, এমনকি চোখের পানি শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর তারা রক্ত কান্না করবে। শেষ পর্যন্ত তাদের চেহারা আছহাবুল উখদুদ (গর্তের অধিপতিদের) চেহারা সদৃশ হবে। যদি (তাদের চোখের পানিতে) নৌকা চালানো হয় তাহলে তা চলবে। ইবনু মাজাহ হা/৪৩২৪, আলবানী, সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহা হা/১৬৭৯।
আর কাঁদতে কাঁদতে আফসোস করতে থাকবে এবং তারা যাদের অনুসরণ করত তাদের কঠোর শাস্তি কামনা করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَوْمَ تُقَلِّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُوْلاً – وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيْلا – رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنا كَبِيرًا –
‘যেদিন তাদের চেহারাগুলো আগুনে উপুড় করে দেওয়া হবে, তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের আনুগত্য করতাম! তারা আরো বলবে, হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতৃবর্গ ও বিশিষ্ট লোকদের আনুগত্য করেছিলাম, তখন তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব! আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দিন এবং তাদেরকে বেশী করে লা’নত করুন’ (সূরা আহযাব ৩৩/৬৬-৬৮)।
তথ্যসূত্র:
জাহান্নামের ভয়াভহ আযাব
শরীফুল ইসলাম বিন জয়নাল আবেদীন