মদ পানের শাস্তি
মদপান ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণ হারাম এবং এটি একটি বড় পাপ। কুরআন ও হাদিসে মদপানের নিষিদ্ধতা এবং এর দুনিয়াবী ও আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে স্পষ্ট সতর্কতা রয়েছে।
কুরআনের আলোকে মদের শাস্তি
১. মদপান শয়তানের কাজ
আল্লাহ তাআলা মদকে শয়তানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তির পুজো এবং ভাগ্য নির্ধারণকারী তীর শয়তানের কাজের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এগুলো থেকে দূরে থাকো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সূরা আল-মায়েদা: ৯০)
এ আয়াতে মদকে নোংরা ও শয়তানের কৌশল বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।
২. বুদ্ধি বিনষ্ট হওয়া
মদ মানুষের বিবেক ও বুদ্ধি নষ্ট করে। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا “তারা তোমাকে মদ ও জুয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। বলো, এতে রয়েছে বড় পাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও; কিন্তু তাদের পাপ উপকারের চেয়ে অনেক বড়।” (সূরা আল-বাকারা: ২১৯)
তাফসির অনুযায়ী, মদের সামান্য উপকার থাকলেও তার ক্ষতি এবং পাপ এত বেশি যে তা একেবারে নিষিদ্ধ।
হাদিসের আলোকে মদের শাস্তি
১. মদ সকল পাপের মূল
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: إِنَّ الْخَمْرَ أُمُّ الْخَبَائِثِ “নিশ্চয়ই মদ সকল পাপের জননী।” (মুসনাদে আহমদ: ২৩৮৭১)
মদপান মানুষকে নৈতিক অধঃপতনে নিয়ে যায় এবং আরও অনেক পাপের পথ উন্মুক্ত করে।
২. দুনিয়াতে শাস্তি ও আখিরাতে ক্ষতি
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: مَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ فِي الدُّنْيَا فَمَاتَ وَهُوَ يُدْمِنُهَا لَمْ يَشْرَبْهَا فِي الْآخِرَةِ “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদপান করে এবং মদের প্রতি আসক্ত অবস্থায় মারা যায়, সে আখিরাতে মদ পান করতে পারবে না।” (সহিহ মুসলিম: ২০০৩)
৩. দুনিয়াতে শারীরিক শাস্তি
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “মদপানকারীর উপর লাঞ্ছনার শাস্তি দেওয়া হবে।” (বুখারি: ৬৭৯২) ইসলামী আইনে মদপানকারীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে।
মদের দুনিয়াবী শাস্তি
১. বুদ্ধি-বিবেক ধ্বংস: মদপানের ফলে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট হয়, যা তাকে অন্যায় পথে পরিচালিত করে।
২. শারীরিক ক্ষতি: মদ শারীরিকভাবে ক্ষতিকর। এটি লিভার, হৃদপিণ্ড, ও মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর।
৩. সমাজে অপমানিত হওয়া: মদপানকারী সমাজে সম্মান হারায় এবং তার চরিত্র কলুষিত হয়।
৪. আইনি শাস্তি: ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, মদপানকারীকে চাবুক মারার শাস্তি দেওয়া হয়।
৫. পরিবার ও সমাজ ধ্বংস: মদপানের ফলে পরিবারে অশান্তি এবং সমাজে অপরাধ বৃদ্ধি পায়।
মদপানের সামাজিক ক্ষতি
মদপান শুধু ব্যক্তির জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হয়। নিচে মদপানের সামাজিক ক্ষতিগুলো তুলে ধরা হলো:
১. পারিবারিক অশান্তি
মদপানকারী ব্যক্তি নিজের পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ ও অশান্তির কারণ হয়। মদপানের ফলে:
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ বেড়ে যায়। সন্তানদের সঠিক লালন-পালনে ব্যর্থতা দেখা দেয়।পারিবারিক সম্পদ অপচয় হয়।
২. অপরাধের বৃদ্ধি
মদপানের ফলে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়, যা অপরাধপ্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। সমাজে:
খুন, ধর্ষণ, এবং চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধ বৃদ্ধি পায়। মদপানের সময় বা এর পরে ঝগড়া-মারামারি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
৩. দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
মদপান একটি ব্যয়বহুল অভ্যাস। ফলে: ব্যক্তি নিজের উপার্জন মদের পেছনে অপচয় করে।
পরিবার দারিদ্র্যসীমায় চলে আসে। সমাজের সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪. স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর চাপ
মদপান জনিত অসুস্থতার কারণে সমাজের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। যেমন:
লিভার সিরোসিস, ক্যান্সার, এবং মানসিক রোগ। সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায়, যা চিকিৎসার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে।
৫. নৈতিক অবক্ষয়
মদপান ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংস করে। এর ফলে: সততা ও ন্যায়বিচারের অভাব দেখা দেয়।
সমাজে অসামাজিক কার্যকলাপ যেমন জুয়া, অবৈধ সম্পর্ক ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।
৬. সামাজিক সম্পর্কের বিনাশ
মদপানকারীর কারণে: আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুরা তাকে এড়িয়ে চলে। সামাজিক মেলামেশায় তার প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞা সৃষ্টি হয়।
৭. তরুণ প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব
মদপানকারী ব্যক্তি তরুণদের জন্য ভুল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ফলে তরুণরা মদপানে আগ্রহী হয়ে ওঠে, যা সমাজে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধ্বংস ডেকে আনে।
৮. সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি
মদপানকারী প্রায়শই অশোভন আচরণ করে, যা: সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করে। শান্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।
উপসংহার:
মদপানের সামাজিক ক্ষতি অত্যন্ত গভীর এবং ব্যাপক। এটি একটি ব্যক্তিগত অভ্যাস হলেও পুরো সমাজকে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। তাই মদপান থেকে বিরত থাকা এবং সমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।
মদ শুধু দুনিয়া নয়, আখিরাতেও মানুষের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। মদ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে এবং পবিত্র জীবনের জন্য দোয়া করতে হবে। মদপানকারীর দুনিয়াবী শাস্তি যেমন কঠোর, তেমনি আখিরাতেও তা চিরস্থায়ী শাস্তির কারণ হবে।
তথ্যসূত্র:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স