হিংসা: ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি
হিংসা হলো মানুষের অন্তরের একটি মারাত্মক রোগ। এটি এমন একটি গুণ, যা অন্যের প্রতি ক্ষতিকারক মনোভাব তৈরি করে এবং একজন ব্যক্তিকে আল্লাহর নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কোরআন ও হাদিসে হিংসাকে তীব্রভাবে নিন্দা করা হয়েছে এবং এর ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
হিংসার সংজ্ঞা
ইসলামে হিংসা বলতে বোঝায়: “অন্যের ভালো বা কল্যাণ দেখে অসন্তুষ্ট হওয়া এবং তা কেড়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: لَا تَحَاسَدُوا “তোমরা পরস্পরের প্রতি হিংসা করো না।” (সহিহ মুসলিম: ২৫৫৯)
হিংসার ইহকালীন শাস্তি
১. অন্তরের অশান্তি
হিংসুক ব্যক্তি কখনোই শান্তি পায় না। সে অন্যের ভালো দেখে কষ্ট পায় এবং নিজের মনে অসন্তোষ বজায় রাখে।
আল্লাহ বলেন: وَمَن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ “আমি হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে।” (সুরা আল-ফালাক: ৫)
২. সমাজে ফিতনা সৃষ্টি হওয়া
হিংসা সমাজের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করে। এটি একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায় এবং ঐক্যকে নষ্ট করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: إِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ “হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে, যেমন আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়।” (আবু দাউদ: ৪৯০৩)
৩. সম্পর্ক ধ্বংস হওয়া
হিংসা মানুষের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে। এটি মনের বিদ্বেষকে জাগিয়ে তোলে, যা মানুষকে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
৪. আল্লাহর নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হওয়া
হিংসুক ব্যক্তি আল্লাহর দেওয়া বরকত ও নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ সে আল্লাহর ফয়সালার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে।
হিংসার পরকালীন শাস্তি
১. হাশরের ময়দানে লজ্জিত হওয়া
কিয়ামতের দিন হিংসুক ব্যক্তির সব নেক আমল ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ তার হিংসা অন্যের ক্ষতি করেছে এবং তার পাপ অন্যের আমলনামায় যুক্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟… يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاتٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا… “তোমরা জানো, কে মফলিস? সে হলো, যে কিয়ামতের দিন অনেক সালাত, রোজা ও যাকাত নিয়ে আসবে, কিন্তু সে অন্যকে গালি দিয়েছে, অপবাদ দিয়েছে…” (সহিহ মুসলিম: ২৫৮১)
২. জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া
আল্লাহর হুকুম অমান্য করে হিংসা করা কুফরির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা জাহান্নামে নিক্ষেপের কারণ হবে।
আল্লাহ বলেন: وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ “তোমরা এমন কিছু কামনা করো না, যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের একের ওপর অন্যকে মর্যাদা দিয়েছেন।” (সুরা আন-নিসা: ৩২)
৩. জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়া
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ “যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহিহ মুসলিম: ৯১) হিংসা অহংকারের একটি শাখা, যা জান্নাতে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করবে।
কোরআনের হিংসার দৃষ্টান্ত
১. হাবিল ও কাবিলের কাহিনি
হিংসার প্রথম উদাহরণ হলো হাবিল ও কাবিলের ঘটনা। আল্লাহ বলেন: فَطَوَّعَتْ لَهُ نَفْسُهُ قَتْلَ أَخِيهِ فَقَتَلَهُ فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ “তখন তার অন্তর তাকে তার ভাইকে হত্যার জন্য প্ররোচিত করল, এবং সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।” (সুরা আল-মায়িদা: ৩০)
২. ইবলিসের অহংকার ও হিংসা
ইবলিস আদম (আ.)-এর প্রতি হিংসা করেছিল এবং তার অবাধ্যতার কারণে চিরস্থায়ী অভিশপ্ত হয়েছে। আল্লাহ বলেন: قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ “সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ আর তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছ।” (সুরা সাদ: ৭৬)
হিংসার প্রতিকার ও করণীয়
১. আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা
যে ব্যক্তি আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে, সে কখনো হিংসা করবে না।
২. অন্যের কল্যাণ কামনা করা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ “তোমাদের কেউ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই কামনা করে, যা সে নিজের জন্য কামনা করে।” (সহিহ বুখারি: ১৩)
৩. আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ “আমি হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে।” (সুরা আল-ফালাক: ৫)
উপসংহার
হিংসা এমন একটি গুণ, যা ইহকাল ও পরকালে ভয়াবহ শাস্তির কারণ হতে পারে। এটি মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে বাধা দেয়। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হলো, হিংসার বদলে অন্যের জন্য কল্যাণ কামনা করা, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা এবং নিজের অন্তরকে পবিত্র রাখা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হিংসার মতো নিন্দিত গুণ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স