কুরআনের আলোকে তাকলীদ
তাকলীদকে শরয়ীভাবে সাব্যস্ত করার জন্য উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ গ্রন্থসমূহে কুরআনে কারীমের অনেকগুলো আয়াত প্রমাণ হিসাবে পেশ করেছেন। ওগুলো ছাড়াও আরো অনেক আয়াত দলীল হিসাবে উপস্থাপন করা যায়। এখানে আমরা তাকলীদের সমর্থনে কুরআনে কারীমে ‘ কয়েকটি আয়াত ব্যাখ্যাসহ পেশ করব।
প্রথম আয়াত ঃ يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأولى الأمْرِ مِنْكُمْ. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর ইতা’আত কর এবং রাসূলের ইতা’আত কর। আর তোমাদের মধ্যে যারা ‘উলুল আমর’ তাদেরও।”সূরা আলে ইমরান ৫
উলুল আমরের তাফসীর
উপরোল্লিখিত আয়াতে তিনটি জিনিসের হুকুম করা হয়েছে। ১. আল্লাহ তা’আলার ইতা’আত । ২. আল্লাহর রাসূলের ইতা’আত । ৩. উলুল আমরের ইতা’আত ।
প্রথম দু’টির ব্যাপারে আহলে ইলমের মাঝে কোন রকমের মতবিরোধ নেই। হ্যাঁ তৃতীয় বিষয়টির ব্যাখ্যায় মতবিরোধ রয়েছে।
প্রায় সকল তাফসীরকারকের মতে আলোচ্য আয়াতের ‘উলিল আমর’ শব্দটি দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহর ইলমের অধিকারী ফকীহ ও মুজতাহিদগণকেই বোঝানো হয়েছে। এমতের স্বপক্ষে রয়েছেন হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.), হযরত মুজাহিদ (রহ.), হযরত ‘আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহ.), হযরত ‘আতা ইবনে সাইব (রহ.), হযরত হাসান বসরী (রহ.) ও হযরত আলিয়াহ (রহ.) সহ জগদ্বরেণ্য আরো অনেক তাফসীরকারক। দু’একজনের মতে অবশ্য আলোচ্য ‘উলিল আমরের’ অর্থ হলো মুসলিম শাসকবর্গ। কিন্তু সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরকারক ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ.) প্রথম তাফসীরের সমর্থনে বিভিন্ন সারগর্ভ যুক্তি-প্রমাণের অবতারণা করে শেষে বলেছেন, বস্তুত আলোচ্য আয়াতে, না তা শব্দ দু’টি সমার্থক।
ইমাম আবূ বকর জাস্সাস (রহ.)-এর মতে أولى الأمْرِ শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ধরে নিলে উভয় তাফসীরের মাঝে মূলত কোন বিরোধ থাকে না। কারণ, তখন আয়াতের মর্ম দাঁড়াবে, রাজনীতি ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে তোমরা প্রশাসকবর্গের এবং আহকাম ও মাসায়িলের ক্ষেত্রে আলিমগণের ইতা’আত কর। অন্য দিকে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)-এর মতো অর্থ মুসলিম শাসক ধরে নিলে বিশেষ কোন অসুবিধা নেই। কারণ, আহকাম মাসায়িলের ক্ষেত্রে শাসকবর্গ আলিমগণের ইতা’আত করতে বাধ্য। সুতরাং শাসকবর্গের ইতা’আত আলিমগণের ইতা‘আতের নামান্তর মাত্র।আহকামুল কুরআন ২/২৫৬, উলিল আমল প্রসঙ্গ, তাফসীরে কাবীর ৩/৩৩৪, ই’লামুল মুয়াক্বিয়ীন ১/৭।
মোটকথা, আলোচ্য আয়াতের আলোকে আল্লাহ তা’আলা ও রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ইতা’আত যেমন ফরয সাব্যস্ত হয়, তেমনি কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যাকার হিসেবে আলিম মুজতাহিদের ইতা’আত করাও ফরয সাব্যস্ত হয়। আর এরই পারিভাষিক নাম হল তাকলীদ।
একটি সন্দেহ ও তার উত্তর
অবশ্য আয়াতের শেষাংশ কারো মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে- فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤمِنونَ باللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِر.
“কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তোমরা তা আল্লাহ ও তার রাসূল সমীপে পেশ কর। যদি আল্লাহ এবং আখিরাতের উপর ঈমান এনে থাক।”সূরা নিসা ৫৯।
এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য এই যে, আয়াতের প্রথমাংশে সর্ব সাধারণকে এবং শেষাংশে মুজতাহিদদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। আহকামুল কুরআন প্রণেতা হযরত আল্লামা আবূ বকর জাসাসের ভাষায়- وقوله تعالى فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ يَدُلُّ عَلَى أَنَّ أَوْلِي الْأَمْرِ هُمُ الْفُقَهَاءُ لِأَنَّهُ اَمَرَ سَائِرَ النَّاسِ بِطَاعَتِهِمْ ثُمَّ قَالَ فَإِنْ تنَازَعْتُمْ إلخ فَأَمَرَ أُولِي الأمْرِ بِرَدَّ الْمُتَنَازَعَ فِيهِ إِلَى كِتابِ اللهِ تَعَالَى وَسُنَّةِ نَبِيِّهِ لا وَإِذَا كَانَتِ الْعَامَّةُ وَمَنْ لَيْسَ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ لَيْسَتْ هَذِهِ مَنْزِلَتَهُمْ لِأَنَّهُمْ لَا يَعْرِفُونَ كَيْفِيَةَ الرَّدَّ إِلَى كِتَابِ اللهِ تَعَالَى وَالسُّنَّةِ وَوُجُوْهِ دَلَائِلِهِمَا عَلَى أَحْكَامِ الْحَوَادِثِ فَثَبَتَ أَنَّهُ خِطَابُ لِلْعُلَمَاءِ .
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ অংশটি সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে,أَوْلِي الْأَمْرِ এর অর্থ ফকীহ ও মুজতাহিদ ছাড়া অন্য কেউ নয়। অর্থাৎ, সর্ব সাধারণকে উলিল আমর বা মুজতাহিদদের ইতা’আত করার হুকুম দিয়ে তাদেরকে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাধান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা,সাধারণ লোকের সে যোগ্যতা নেই। সুতরাং অবধারিত ভাবেই বলা যায় যে, আয়াতের শেষাংশে আলিম ও মুজতাহিদদেরকেই সম্বোধন করে বলা হয়েছে।”
সুপ্রসিদ্ধ আহলে হাদীস পণ্ডিত আল্লামা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ভূপালী’ (রহ.) স্বীয় ওলা গ্রন্থে এ কথা স্বীকার করেছেন।
তার ভাষায়- وَالظَّاهِرُ أَنَّهُ خِطَابٌ مُسْتَقِلٌ مُسْتَأنِفٌ مُوجَةٌ لِلْمُجْتَهِدِينَ. “স্পষ্টতই এখানে মুজতাহিদগণকে স্বতন্ত্রভাবে সম্বোধন করা হয়েছে।”
মোটকথা, আলোচ্য আয়াতের প্রথমাংশের নির্দেশ মতে, সাধারণ লোকেরা,أَوْلِي الْأَمْرِ তথা মুজতাহিদগণের বাতলানো মাসায়িল মোতাবিক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের ইতা’আত করবে। পক্ষান্তরে আয়াতের শেষাংশের নির্দেশ মতে মুজতাহিদগণ তাদের ইজতিহাদ প্রয়োগের মাধ্যমে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। সুতরাং ইজতিহাদের যোগ্যতা বঞ্চিত লোকেরাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; এধরণের জ্ঞানহীন উক্তির কোন অবকাশ আলোচ্য আয়াতে নেই।
দ্বিতীয় আয়াত ঃ وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الأمْنِ أَوِ الْحَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رُدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أَوْلِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِيْنَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ.
“আর যখন তাদের কাছে শাস্তি অথবা শংকা সংক্রান্ত কোন খবর এসে পৌঁছে তখন তারা তার প্রচারে লেগে যায়। অথচ বিষয়টি যদি তারা রাসূল এবং উলিল আমরের কাছে পেশ করত তাহলে ইসতিম্বাত ও সুক্ষ্ম বিচারশক্তির অধিকারী ব্যক্তিগণ বিষয়টি (মূল রহস্য) উদ্ঘাটন করতে পারত।সূরা নিসা ৮৩।
আয়াতের শানে নুযূল
সুযোগ পেলেই মদীনার মুনাফিকরা যুদ্ধ ও শাস্তি সম্পর্কে নিত্যনতুন গুজব ছড়াতো। আর সে গুজবে কান দিয়ে দু’ একজন সরলমনা সাহাবীও অন্যদের কাছে তা বলে বেড়াতেন। ফলে মদীনায় এক অস্বস্তিকর ও আরজক অবস্থা সৃষ্টি হত। তাই ঈমানদারদের সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যুদ্ধ ও শান্তি সংক্রান্ত যে কোন খবরই আসুক না কেন নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে তাদের কর্তব্য হল, উলিল আমরের শরণাপন্ন হওয়া এবং অনুসন্ধান ও বিচার বিশ্লেষণের পর যে সিদ্ধান্ত তারা দেন অম্লান বদনে তা মেনে নিয়ে সে মোতাবিক আমল করা।
এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে আয়াতটি নাযিল হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে। যে, উসূলে তাফসীর ও উসূলে ফিকহের সর্বসম্মত মূলনীতি অনুযায়ী ‘আহকাম ও বিধান আহরণের ক্ষেত্রে আয়াতের বিশেষ প্রেক্ষাপটের পরিবর্তে শব্দের স্বাভাবিক ব্যাপকতার বিষয়টি অগ্রাধিকার লাভ করে থাকে। الْمَوْرِدُ خَاصٌ وَالْحُكْمُ عَام .
সুতরাং আলোচ্য আয়াত থেকে এ মৌলিক নির্দেশ আমরা পাই যে, কোন জটিল বিষয়ে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে সর্ব সাধারণের জন্য কর্তব্য হল, প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিগণের শরণাপন্ন হওয়া এবং কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে ইজতিহাদের মাধ্যমে তাদের নির্ধারিত পথ ও পন্থা অম্লান বদনে মেনে নেয়া। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এরই নাম তাকলীদ।
আয়াতের তাফসীর :
আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ.) বলেছেন- إذا نَبَتَ هَذَا فَتَقُولُ الآيَةُ دَالَّةٌ عَلَى أَمُورٍ: أَحَدُهَا أَنَّ فِي أَحْكام الحَوَادِثِ مَا لَا يُعْرَفُ بِالنَّصَّ بَلْ بِالْإِسْتِنْبَاطِ، وَثَانِيهَا أَنَّ الْإِسْتِنْبَاط حُجَّةٌ، وَثَالِتُهَا أَنَّ الْعَامِي يَجِبُ عَلَيْهِ تَقْلِيْدُ الْعُلَمَاءِ فِي أَحْكامِ الحوادث.
“মোটকথা, আমাদের বক্তব্য হল, এ আয়াত থেকে তিনটি বিষয় স্থীর হয় । ১. কুরআন ও সুন্নাহর প্রত্যক্ষ নির্দেশের অবর্তমানে ইজতিহাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২. ইজতিহাদ ও ইসতিম্বাত শরীয়ত স্বীকৃত হুজ্জাত । ৩. উদ্ভুত সমস্যা ও মাসায়িলের ক্ষেত্রে সাধারণ লোকের পক্ষে আলিমগণের তাকলীদ করা অপরিহার্য।” তাফসীরে কাবীর ১/২০০, আহকামুল কোরআন ২/২১৫।
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
অবশ্য কারো কারো মৃদু আপত্তি এই যে, এটা যুদ্ধকালীন বিশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কিত আয়াত। সুতরাং যুদ্ধ বহির্ভূত ও শান্তিকালীন অবস্থাকে এর আওতাভূক্ত করা যায় না। ২
কিন্তু এধরনের স্থুল আপত্তির উত্তরে আগেই আমরা বলে এসেছি যে,আহকাম ও মাসায়িলের ক্ষেত্রে শানে নুযূলের বিশেষ প্রেক্ষাপট নয়; বরং শব্দের স্বাভাবিকতাই বিচার্য। তাই ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ.) লিখেছেন- إِنَّ قَوْلَهُ وَإِذَا جَاءَ هُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ عَامَ فِى كُلِّ مَا يَتَعَلَّقُ بِالْحَرُوْبِ وَفِيمَا يَتَعَلَّقُ بِسَائِرِ الْوَقَائِعِ الشَّرْعِيَّةِ لِأَنَّ الْأَمْنَ وَالْخَوْفِ حَاصِلٌ فِي كُلِّ مَا يَتَعَلَّقُ بِبَابِ التَّكْلِيفِ فَثَبَتَ أَنَّهُ لَيْسَ فِي الْآيَةِ مَا يُوجِبُ تَحْصِيْصَهَا بِأَمْرِ الْحَرُوبِ.
“যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিসহ শরীয়তের যাবতীয় আহকাম ও বিধান আলোচ্য আয়াতের বিস্তৃত পরিধির অন্তর্ভুক্ত। কেননা, আহকাম সম্পর্কিত সকল ক্ষেত্রেই শান্তি ও শংকার পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। মোটকথা, এখানে এমন কোন শব্দ নেই যা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সাথে আয়াতের সীমাবদ্ধ সম্পর্ক দাবী করে। ”তাফসীরে কাবীর ১০/২০১।
আরো সম্প্রসারিত আকারে একই উত্তর দিয়েছেন, ইমাম আবূ বকর জাসসাস (রহ.)। সেই সাথে বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, সন্দেহেরও অত্যন্ত চমৎকার সমাধান পেশ করেছেন তিনি।আহকামুল কুরআন লিল-জাস্সাস ১/২৬৩।
এমনকি সুপ্রসিদ্ধ আহলে হাদীস পণ্ডিত নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহ.) আলোচ্য আয়াতের আলোকে কিয়াসের বৈধতা প্রমাণ করে লিখেছেন- في الْآيَةِ إِشَارَةٌ إِلَى حَوَازِ الْقِيَاسِ وَإِنَّ مِنَ الْعِلْمِ مَا يُدْرَكُ بالنص وَهُوَ الْكِتَابُ وَالسَّنَةَ . وَمِنْهُ مَا يُدْرَكُ بِالاسْتِنْبَاطِ وَهُوَ الْقِيَاسُ عَلَيْهِمَا.
এখানে কিয়াসের বৈধতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ইজতিহাদ ও ইসতিম্বাতের প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু আমাদের বিনীত জিজ্ঞাসা, শান্তিকালীন অবস্থার সাথে আয়াতের কোন সম্পর্ক না থাকলে এর সাহায্যে কিয়াসের বৈধতা কিভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে? তাফসীরে ফাতহুল বয়ান ৩/১৮৭।
তৃতীয় আয়াত :
فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلْيُنْذِرُوا قَوْمُمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهُمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ.
“দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রত্যেক দল থেকে একটি উপদল কেন বেরিয়ে পড়ে না, যেন ফিরে এসে স্বজাতিকে তারা সতর্ক করতে পারে? ”সূরা তাওবা ১২৩।
আয়াতের মূল বক্তব্য অনুযায়ী উম্মাহর মধ্যে এমন একটি দল বিদ্যমান থাকা একান্তই জরুরী যারা দিবারাত্র কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জনে নিমগ্ন থাকবে এবং ইলম অর্জনের সুযোগ বঞ্চিত মুসলমানদেরকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করবে। আরো পরিস্কার ভাষায়- একটি নির্বাচিত জামা’আতের প্রতি নির্দেশ হল, কুরআন ও সুন্নাহর পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের এবং সর্ব সাধারণের প্রতি নির্দেশ হল, তাদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকবে। তাকলীদও এর বেশী কিছু নয়।
উক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে হযরত আবূ বকর জাস্সাস (রহ.) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আহকামুল কুরআন”-এ লিখেছেন- فَأُوْجَبَ الْحَذَرَ بِإِنْدَارِهِمْ وَالزَمَ المُنْذِرِينَ قَبُولَ قَوْلِهِم.
এ আয়াতে আল্লাহ পাক আলিমদেরকে সতর্ক করার এবং সর্ব সাধারণকে সে সতর্কবাণী মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন ।
চতুৰ্থ আয়াত :
فَاسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ. “তোমাদের ইলম না থাকলে আহলে ইলমকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।” সূরা নাহাল ৪৩, সূরা আম্বিয়া ৭।
আলোচ্য আয়াতও দ্ব্যর্থহীনভাবে তাকলীদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করছে। কেননা, এখান থেকে এ মৌলিক নির্দেশ আমরা পাই যে, অনভিজ্ঞ ও অপরিপক্কদেরকে অভিজ্ঞ ও পরিপক্ক ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হয়ে তাদের নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত মুতাবিক আমল করতে হবে। তাকলীদের সারমর্ম এটাই।
তাফসীরে রূহুল মা’আনীতে আল্লামা মাহমূদ আলূসী (রহ.) লিখেছেন-“আলোচ্য আয়াতে শরীয়তের জটিল বিষয়ে আলিমদের সিদ্ধান্ত মেনে চলার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হচ্ছে। ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী (রহ.)-এর মতেও এ আয়াত মাসায়িলের ক্ষেত্রে সাধারণ লোকদের জন্য তাকলীদের বৈধতা প্রমাণ করছে।”তাফসীরে রূহুল মা’আনী ১৪/১৪৮, সূরা নাহাল ।
অনেক মুফাসসিরের অভিমত হল, এক বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আয়াতটি নাযিল হয়েছে। পূর্ণ আয়াত এরূপ- وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ.
“আপনার পূর্বেও মানুষকেই আমি রাসূলরূপে পাঠিয়েছি। তোমাদের ইলম না থাকলে আহলে ইলমকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।”
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করার অজুহাত হিসেবে মক্কার মুশরিকরা বলে বেড়াত, কোন ফিরিশ্তা রাসূল হয়ে আসলে তার কথা অম্লান বদনে আমরা মেনে নিতাম। তা না করে আল্লাহ তোমাকে কেন রাসূল করে পাঠালেন? কুরাইশদের এই অনর্থক কথাই আলোচ্য আয়াতের শানে নুযূল।
আয়াতে কারীমার তাফসীর
তদুপরি আয়াতে উল্লিখিত أَهْل الذِّكْرِ শব্দের অর্থ নিয়ে তাফসীর- কারকদের ৩টি ভিন্ন মত রয়েছে। ১. বিজ্ঞ আহলে কিতাব। ২. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী আহলে কিতাব। ৩. কুরআনী ইলমের ধারক বাহক আলিমগণ।
সুতরাং শানে নুযূলের আলোকে আয়াতের অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আহলে যিকিরগণ বেশ জানেন যে, অতীতের সব নবী-রাসূলই মানুষ ছিলেন। অতি মানব বা ফিরিশতা ছিলেন না একজনও। তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ না কেন?
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তাকলীদ ও ইজতিহাদ প্রসঙ্গের সাথে আয়াতের পূর্বাপর কোন সম্পর্ক নেই।
এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের বক্তব্য এই যে, (পরোক্ষ ইঙ্গিত) এর মাধ্যমে এখানে তাকলীদের বৈধতা প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা, আহলে যিকিরের যে অর্থই করা হোক, এটাতো স্বীকৃত যে, অজ্ঞতার কারণেই তাদেরকে আহলে যিকিরের শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এ নির্দেশের কারণে অভিজ্ঞ ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হবে। আর এ মূলনীতির আলোকেই তাকলীদ এক স্বতঃসিদ্ধ ও অনস্বীকার্য প্রয়োজনরূপে সুপ্রমাণিত। তদুপরি আগেই আমরা বলে এসেছি যে, উসূলে তাফসীর ও উসূলে ফিকহের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে আয়াতের উপলক্ষ্য বা শানে নুযূল নয় বরং শব্দের স্বাভাবিক দাবীই হল মূল বিচার্য। সুতরাং আয়াতটি মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ্যে নাযিল হলেও সম্প্রসারিত অর্থে এখানে এ মূলনীতি অবশ্যই প্রমাণিত হচ্ছে যে, সাধারণ মুসলমানদের জন্য আহলে ইলমের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী।
তাই আল্লামা খতীব বাগদাদী (রহ.) লিখেছেন- أَمَّا مَنْ يَسُوعُ لَهُ التَّقْلِيدُ فَهُوَ الْعَامِي الذِّيْ لَا يَعْرِفُ طُرُقَ الْأَحْكَامِ الشَّرْعِيَّةِ فَيَجُوزُ لَهُ أَن يُقَلَّدَ عَالِماً وَيَعْمَلُ بِقَوْلِهِ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى فَاسْتَلُوا أهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ.
“শরঈ আহকাম থেকে বঞ্চিত সাধারণ লোকদের উচিত কোন প্রজ্ঞাবান আলিমের নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তার তাকলীদ করে যাওয়া। কেননা, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, তোমাদের ইলম না থাকলে আহলে ইলমকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।”
অতঃপর আল্লামা খতীব আবূ বকর বাগদাদী (রহ.) নিজস্ব সনদ ও সূত্রযোগে সাহাবী হযরত ‘আমর ইবনে কায়েস (রহ.)-এর মতামত উল্লেখ করে লিখেছেন, أَهْل الذِّكْرِএর অর্থ আহলে ইলম ছাড়া অন্য কিছু নয়।
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।