ইসলাম

হাদীসের আলোকে তাকলীদ

তাকলীদের সমর্থনে কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াতের পাশাপাশি নবীজীর বিশাল হাদীস ভাণ্ডার থেকে অসংখ্য হাদীসও পেশ করা যেতে পারে। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরের কথা বিবেচনা করে এখানে কয়েকটি মাত্র হাদীস ব্যাখ্যাসহ পেশ করা হল।

প্রথম হাদীস :

عَنْ حُذَيْفَةَ رَضِيَ الله تَعَالَى قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ إِنِّي لَا أَدْرِى مَا بَقَائِي فِيْكُمْ فَاقْتَدُوا بِالَّذِيْنَ مَنْ بَعْدِى أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُمَا.

“হযরত হুযাইফা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জানি না আর কতদিন তোমাদের মাঝে আমি বেঁচে থাকব। তবে আমার পরে তোমরা আবূ বকর ও ওমর (রাযি.)-এর ইকতিদা করে যাবে।”তিরমিযী ৫/৩৭৫, ইবনে মাজাহ ১/৩৭, মুসনাদে আহমাদ ৬/৫৫৮, হাদীস নং ২২৯১০, মুস্তাদরাকে হাকিম ৩/৭৫।

এখানে اقْتَدُاإِ শব্দটির ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ধর্মীয় আনুগত্যের অর্থেই শুধু এর ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রশাসনিক আনুগত্যের অর্থে নয় ।

সুপ্রসিদ্ধ আরবী ভাষাবিদ ও আভিধানিক আল্লামা ইবনুল মানযূর আল আফ্রীকী (রহ.) তাঁর সুবিশাল আরবী অভিধান গ্রন্থ “লিসানুল আরব”-এ লিখেছেন- يُقَالُ قِدْوَةٌ وَقُدْوَةٌ لِمَا يُقْتَدَى بِهِ. وَقَالَ ابْنُ سَيِّدَة الْقُدْوَةُ وَالْقِدْوَةُ مَا تَسَنَنَتَ بِهِ. “যার সুন্নাত বা তরীকা তুমি অনুসরণ করবে, তাকেই শুধু কুদওয়া বলা যাবে।”লিসানুল আরব ১১/৭০ লি ইবনুল মানযূর আল আফ্রীকী।

দীন ও শরীয়তের ক্ষেত্রে নবী ওলীগণের আনুগত্যের নির্দেশ দিতে গিয়ে কুরআনুল কারীমেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- أولئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللهُ فَبِهدَاهُمُ اقْتَدِه. “এরাই হলেন, হেদায়াতপ্রাপ্ত। সুতরাং তোমরা এদেরই ইকতিদা কর।” সূরা আন’আম ৯।

তদ্রুপ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাত সম্পর্কিত হাদীসেও একই অর্থে এর ব্যবহার এসেছে। “আবূ বকর (রাযি.) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামাযের ইকতিদা করেছিলেন, আর পিছনের সবাই হযরত আবূ বকর (রাযি.)-এর নামাযের ইকতিদা করেছিলেন। বুখারী ১/৯৯, হাদীস নং ১৯৮, ৭০৪, মুসলিম ১/১৭৯, নাসাঈ ১/৯৫।

“মুসনাদে আহমাদ” গ্রন্থে হযরত আবূ ওয়াইলের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে- جَلَسْتُ إِلَى شَيْبَةَ ابْنِ عُثْمَانَ رَضِيَ الله عَنْهُ فَقَالَ جَلَسَ عُمَرُ بْنُ الخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي مَجْلِسِكَ هَذَا فَقَالَ لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ لَا أَدَعَ في الْكَعْبَةِ صَفْرَاءَ وَلَا بَيْضَاءَ إِلَّا قَسَمْتُهُمَا بَيْنَ النَّاسِ قَالَ قُلْتُ لَيْسَ ذَلِكَ لَكَ قَدْ سَبَقَكَ صَاحِبَاكَ لَمْ يَفْعَلَا ذَلِكَ فَقَالَ هُمَا الْمَرْء ان يُقْتَدَى بِهِمَا.

“আমি শায়বা ইবনে উসমানের কাছে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, হযরত ওমর (রাযি.) ঠিক তোমার জায়গাটাতে বসে বলেছিলেন, আমার ইচ্ছা হয়, কা’বা ঘরে গচ্ছিত সমুদয় স্বর্ণ-রূপা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেই। শায়বা (রাযি.) বলেন, আমি বললাম, সে অধিকার তো আপনার নেই। কেননা, আপনার আগের দু’জন তা করেননি। শুনে তিনি বললেন, এ দু’জনের ইকতিদা অবশ্যই করা উচিত।মুসনাদে আহমাদ ৪/৪১৬, দারু ইহইয়য়িত তুরাসিল আরাবী। বলাবাহুল্য যে, দ্বীনি বিষয়ে কারো ইকতিদা করার নামই হল তাকলীদ ।

দ্বিতীয় হাদীস :

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- إن اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِرَاعاً يَنتَزِعُهُ مِنَ العِبَادِ وَلكِنْ يَقْبِضُ العِلم بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يَبْقَ عَالِماً اِتَّخَذَ النَّاسُ رُؤوساً جُهَالًا فَسُئِلُوا فَافْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا.

“বান্দাদের হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ পাক ইলমের বিলুপ্তি ঘটাবেন না। বরং আলিম সম্প্রদায়কে উঠিয়ে নিয়ে ইলমের বিলুপ্তি ঘটাবেন। একজন আলিমও যখন থাকবেন না মানুষ তখন জাহিল মূর্খকেই পথপ্রদর্শকের মর্যাদা দিয়ে বসবে। আর তারা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে অজ্ঞতা প্রসূত ফাতওয়া দিয়ে নিজেরাও গোমরাহ হবে, অন্যদেরকেও গোমরাহ করবে। ” বুখারী ১/২০, হাদীস নং ১০০, ৭০১৪, মুসলিম ১/৩৪০, হাদীস নং ২৬৭৩,তিরমিযী ২৬৫২, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/৪৭২।

আলোচ্য হাদীসে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় ফতওয়া প্রদানকে আলিমদের অন্যতম দায়িত্ব বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই সর্ব সাধারণের কর্তব্য হবে শরীয়তের সকল ক্ষেত্রে আলিমদের ফতওয়া হুবহু অনুসরণ করা। বলুন দেখি, তাকলীদ কি ভিন্ন কিছু?

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যখন কোথাও কোন আলিম খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে সেই নাযুক মুহুর্তে বিগত যুগের হক্কানী আলিম মুজতাহিদগণের তাকলীদ ও অনুসরণ ছাড়া দীনের উপর অবিচল থাকার আর কি উপায় হতে পারে?

মোটকথা, আলোচ্য হাদীসের সারমর্ম এই যে, ইজতিহাদের যোগ্যতা সম্পন্ন আলিমগণ যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকবেন ততদিন তাঁদের কাছেই মাসায়িল জেনে নিতে হবে। কিন্তু যখন তাঁদের কেউ বেঁচে থাকবেন না তখন স্বঘোষিত মুজতাহিদদের দরবারে ভিড় না করে বিগত যুগের মুজতাহিদ আলিমদের তাকলীদ করাই অপরিহার্য কর্তব্য

তৃতীয় হাদীস :

আবূ দাউদ শরীফে আবূ হুরায়রা (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- مَنْ أُفْتِى بِغَيْرِ عِلْمٍ كَانَ إِثْمُهُ عَلَى مَنْ أَفْتَاهُ. “পরিপক্ক ইলম ছাড়া কোন বিষয়ে ফতওয়া দিলে সে পাপ ফতওয়া দাতার ঘাড়েই চাপবে।”আবূ দাউদ ৩/৩২১, মিশকাত, কিতাবুল ইলম, আল ফাসলুস সানী।

এ হাদীসও তাকলীদের সপক্ষে এক মজবুত দলীল। কেননা, তাকলীদ শরীয়ত অনুমোদিত না হলে অজ্ঞতাপ্রসূত ফতওয়ার সকল দায়দায়িত্ব মুফতী সাহেবের একার ঘাড়ে না চাপিয়ে উভয়ের ঘাড়ে সমানভাবে চাপানোটাই বরং যুক্তিযুক্ত হত। অজ্ঞতাপ্রসূত ফতওয়া দানকারী মুফতী সাহেব এবং চোখ বুঝে সে ফতওয়া অনুসরণকারী মুকাল্লিদ উভয়েই যেখানে সমান অপরাধী। সেখানে একজন বেকসূর খালাস পাবে কোন সুবাদে?

মোটকথা আলোচ্য হাদীসের আলোকে সাধারণ লোকদের কর্তব্য শুধু যোগ্য ও বিজ্ঞ কোন আলিমের কাছে মাসায়িল জেনে নেওয়া। এর পরের সব দায় দায়িত্ব উক্ত আলিমের উপরেই বর্তাবে। প্রশ্নকারীর উপর নয়। আর এটা তাকলীদের সারকথা। আল্লামা নববী (রহ.) বলেছেন, ফাতওয়া প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বড় মর্যদাপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ কাজ। কারণ, একজন মুফতী মূলত: ওয়ারিসে নবী। আকাবিরে উম্মত ফাতওয়া প্রদানকে অত্যন্ত ভয় করতেন এবং এ কাজ থেকে নিজেকে দুরে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবী লাইলা (রহ.) বলেন, أدْرَكْتُ مِائَةً وَعِشْرِيْنَ مِنَ الْأَنْصَارِ مِنَ الصَّحَابَةِ يُسْأَلُ اَحَدُهُمْ عَنِ الْمَسْأَلَةِ فَيَرُدُّ هَذا إِلَى هَذَا حَتَّى تَرْجِعَ إِلَى الْأَوَّلِ.

“আমি আনসারদের মধ্য থেকে একশত বিশজন সাহাবীকে এমন পেয়েছি, যাদের প্রত্যেকে অপরকে কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করতো, অতঃপর তিনি উত্তর না দিয়ে অন্যের উপর সোপর্দ করে দিতেন। এ ভাবে উক্ত মাসআলাটি প্রথম ব্যক্তির উপর আবার ফিরে আসতো।”আল মাদখাল ৪২২, আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ২/১২, সুনানে দরেমী ১/৫০

চতুর্থ হাদীস :

হযরত ইবরাহীম ইবনে আব্দুর রহমান আল-আযারী কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عَدُوْلُهُ يَنْفُوْنَ عَنْهُ تَحْرِيْفَ الْغَالِينَ وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِيْنَ وَتَأْوِيْلَ الْجَاهِلِينَ.

“সুযোগ্য উত্তরসূরীরা পূর্বসূরীদের কাছ থেকে এই ইলম গ্রহণ করবে এবং অতিরঞ্জনকারীদের অতিরঞ্জন, বাতিল পন্থীদের মিথ্যাচার এবং জাহিলদের ভুল ব্যাখ্যা থেকে এর হিফাযত করবে।সুনানে বায়হাকী, কানযুল উম্মাল ১০/২০৯, হাদীস নং ২০৯১১, আল কামিল ১/১৪৭, আল জারহু ওয়াত তাদীল ৮/৩২১।

শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মূর্খ জাহিলদের তা’বীল ও ভুল ব্যাখ্যাদানের কঠোর নিন্দা করে এখানে বলা হয়েছে যে, অজ্ঞ মূর্খদের হাত থেকে ইলমের হিফাযত হচ্ছে প্রত্যেক যুগের হক্কানী আলিমদের পবিত্র দায়িত্ব। সুতরাং কুরআন ও হাদীসের নির্ভুল অনুসরণ করার জন্য তাদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। এই সরল পথ ছেড়ে তথাকথিত ইজতিহাদের নামে যারা কুরআন-সুন্নাহর বিকৃত ব্যাখ্যাদানের অমার্জনীয় অপরাধে লিপ্ত হবে তাদের জন্য জাহান্নামের আগুনই হবে শেষ ঠিকানা।

বলাবহুল্য যে, কুরআন ও সুন্নাহর তা’বীল বা ভুল ব্যাখ্যা এমন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব যার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বল্প জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু হাদীস শরীফে তাদেরকেও জাহিল আখ্যায়িত করায় প্রমাণিত হয় যে, কুরআন-সুন্নাহ থেকে আহকাম ও মাসায়িল ইসতিম্বাত করার জন্য ভাষার জ্ঞানই যথেষ্ট নয়,ইজতিহাদী প্রজ্ঞারও প্রয়োজন।

পঞ্চম হাদীস ঃ

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন যে, দু’একজন বিশিষ্ট সাহাবী জামা’আতের পিছনে এসে শরীক হতেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে যথা সময়ে মসজিদে এসে প্রথম কাতারে নামায আদায়ের তাকীদ দিয়ে ইরশাদ করেন- “তোমরা (আমাকে দেখে) আমার ইকতিদা কর, আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদের দেখে ইকতিদা করবে।”১

আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেন- وَقِيلَ مَعْنَاهُ تَعَلَّمُوْا مِنِّى أَحْكامَ الشَّرِيعَةِ وَلْيَتَعَلَّمُ مِنْكُمُ التَّابِعُوْنَ بَعْدَكُمْ وَكَذَلِكَ أَتْبَاعُهُمْ إِلَى انْقِرَاضِ الدُّنْيَا. “অনেকের মতে হাদীসের মর্মার্থ এই যে, তোমরা আমার নিকট থেকে শরীয়তের আহকাম শিখে রাখ। কেননা, পরবর্তীতে তোমাদের নিকট থেকে এবং আরো পরবর্তীরা তাদের কাছ থেকে শিখবে। আর এ ধারা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী (রহ.) সহ কারো কারো মতে হাদীসের অর্থ এই যে, “নামাযের প্রথম কাতারের বিশিষ্ট সাহাবীগণ রাসূলের ইকতিদা করবেন। আর পরবর্তী কাতারের সাহাবীরা তাদের ইকতিদা করবেন।” যে ব্যাখ্যাই গ্রহণ করা হোক তাকলীদ যে শরীয়ত স্বীকৃত একটি চিরন্তন প্রয়োজন, তাতে আর সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

তথসূত্র:

তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ

মুফতি হিফজুর রহমান

প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *