ইসলাম

শিক্ষাদান পদ্ধতি

তৎক্ষালীন দরস দানের পদ্ধতি ছিলো, উস্তাদ কোনো উচ্চ আসনে বসে তাকরীর করতেন। ছাত্ররা চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে অত্যন্ত নিবিষ্টতার সাথে তাকরীর শ্রবণ করতো। অনেকেই তাকরীর শুনে তা আয়ত্ব করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করে রাখতো। এসব তাকরীর উস্তাদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে যিনি তকরীর করতেন তাঁর নামেই সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতো। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দির কিতাবগুলো এভাবেই সংকলিত হয়েছে।

ইমাম আবু হানীফার রহ. এর শিক্ষাদান কার্যক্রমেও সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। কোনো কোনো মাসআলায় বিতর্ক শুরু হয়ে যেতো। সে বিতর্ক কয়েকদিন পর্যন্ত চলতো। শেষ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যা সাব্যস্ত হতো সেটাই লিপিবদ্ধ হতো।

কোনো কোনো মাসআলায় উস্তাদ ও শাগরিদের মধ্যকার মতভেদ অমীমাংসিতই থেকে যেতো। সেই মত পার্থক্যগুলোও স্ব স্ব যুক্তিসহ কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হতো। এভাবেই হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্থগুলো সংকলিত হয়েছে।

ইমাম সাহেবের দরসগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক প্রয়োজন মিটানোর জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্থানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়- স্বজনরা সমবেত হতো। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে তুলনামূলক উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন ৷

কর্মদিবসগুলোতে তিনি ইশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজ করতেন। যোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কাজে নিয়োজিত থাকতেন। ফাতওয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিলো। তবে অবস্থা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো ।

দরসের মজলিসে শিক্ষার্থীদের সাথে অনেক সাধারণ লোকও শরীক হতো। তর্কচ্ছলে অনেকে আপত্তিকর মন্তব্যও করতো। কিন্তু কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে পরম ধৈর্যের সাথে উত্তর দিতেন। চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শনের মুকাবিলাতেও তাঁর ধের্যচ্যুতি ঘটতো না।

প্রায় সময়ই তিনি একটা কবিতাংশ আবৃত্তি করতেন। যার অর্থ ছিলো, ইয়া আল্লাহ! যাদের অন্তর আমাদের দিক থেকে সংকোচিত হয়ে আছে, আমাদের অন্তর তাদের প্রতি প্রশস্ত করে দিন।

প্রতিটি তাকরীরের শেষে তিনি বলতেন, এটি আমার অভিমত। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, তা আমি বললাম। কেউ যদি আমার চেয়েও মজবুত দলীল ও যুক্তির অবতারণা করতে পারেন, তবে তা-ই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে ।

একদা একটি বিষয় আলোচনার সময় একজন ছাত্র বলেছিলেন, আপনার এই অভিমতটি খুবই চমৎকার। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে, এক পর্যায়ে এটি ভুল প্রমাণিত হবে।

ইমাম আবু ইউসুফ রহ. তাঁর সব আলোচনাই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতেন। ইমাম সাহেব বলতেন, আমার তাকরীর শুনে তা অনুধাবন করতে বেশি যত্নবান হও। এমনও হতে পারে যে, আজকের এই কথাগুলো পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হবে।

যারা বিরূপ মন্তব্য করতো, তাদের সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মন্তব্য ছিলো, যদি কেউ আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমার মধ্যে নেই, তবে সে আমার দিকে ভুল নিসবত করছে। আর আলেমদের কিছু না কিছু দোষ চর্চা তো তাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে ৷

ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধু ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুণী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও অনেকে শরীক হতেন।

বিখ্যাত তাবিয়ী মুসআব ইবনে কিদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দান করতে উৎসাহ দিতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত সে সময়ের মুসলিম-বিশ্বের এমন কোনো অঞ্চল ছিলো না, যেখানের শিক্ষার্থীরা ইমাম আবু হানীফ রহ. এর দরসে সমবেত হয়নি।

মক্কা, মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জাযিরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তীন, ইয়ামান, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকান্দ, বুখারা, কাবুল-হিমস প্রভৃতি জনপদসহ বিখ্যাত এমন কোনো জনপদ ছিলো না, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ইমাম আবু হানীফা রহ.- এর নিকট শিক্ষা লাভ করেনি।

মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ণা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীদের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব।

তথ্যসূত্র:

বই : ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. এর ঈমানদীপ্ত গল্প

লেখক : মুফতি মাহফুজ মোসলেহ

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *