ইবাদত

জানাযার নামাযের আলোচনা

জানাযার নামায

ব্যক্তি মুসলমান হলে গোসল দেয়া, তার কাফন- দাফনের ব্যবস্থা করা, তার জানাযার নামায পড়া এই বিষয়গুলো ফরযে কেফায়া। অর্থাৎ এক দুইজন বা কতিপয় লোক আদায় করলে বাকি সকল মুসলমানদের ফরয দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। নতুবা সকলেই গুনাহগার হবে। (ফাতাওয়া শামী : ২/২০৭)

জানাযার নামাযের শর্ত

জানাযার নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো এই

১. মৃত ব্যক্তি হওয়া ।

২. মৃত ব্যক্তির শরীর ও কাফন- দাফন নাজাসতে হাকীকি ও হুকমী থেকে পবিত্র হওয়া।

৩. মাইয়্যেতের সতর আবৃত থাকা ।

৪. কেবলামুখী হওয়া ।

৫. নিয়ত করা।

৬. মৃত ব্যক্তির লাশ মুসল্লীদের সম্মুখে উপস্থিত থাকা ।

৭. মাইয়্যেত বা মাইয়্যেতের খাট জমিনের উপর থাকা ।

৮. গায়েবানা জানাযার নামায পড়া একমাত্র রাসূল সা. এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভূক্ত। অন্যদের জন্য গায়েবানা জানাযার নামায পড়া জায়েয নেই। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৬১,১৬৪)

জানাযার নামাযের রোকন বা ফরয

জানাযার নামাযের রোকন বা ফরয মাত্র দুইটি,

১. কিয়াম অর্থাৎ দাঁড়িয়ে জানাযার নামায পড়া। যদি কোন ব্যক্তি শরয়ী ওজর ব্যতীত বসে জানাযার নামায পড়ে, তাহলে নামায হবে না।

২. চারবার বাবা বলে তাকবীর বলা। চার তাকবীর চার রাকাতের স্থলাভিষিক্ত ধরা হয়। (ফাতাওয়ায়ে শামী : ২/২০৯)

জানাযার নামাযের ওয়াজিব

জানাযার নামাযের ওয়াজিব মাত্র একটি। আর তা হলো মাইয়্যেতের জন্য দু’আ করা। যদি নাবালেগ বাচ্চার জানাযা হয়, তাহলে নিজের জন্য দু’আ করবে। (ফাতাওয়ায়ে শামী : ২/২১৫)

জানাযার নামাযের সুন্নাত

জানাযা নামাযের সুন্নাত দুইটি,

১. সানা ও তাসবীহ পড়া।

২. দুরূদ শরীফ পড়া। (ফাতাওয়া শামী : ২/২০৯)

জানাযার নামাযের নিয়ত

আরবী নিয়ত : نَوَيْتُ أَنْ أُوَدِّى صَلوةَ الْجَنَازَةِ مَعَ أَرْبَعِ تَكْبِيرَاتٍ فَرْضِ الْكِفَايَةِ الثَّنَاءُ لِلَّهِ تَعَالَى وَالصَّلوةُ عَلَى النَّبِيِّ وَالدُّعَاءُ لِهَذَا الْمَيِّتِ مُتَوَجِهَا إِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ اللَّهُ أَكْبَرُ –

বাংলা নিয়ত : আমি ইমামের পিছনে উক্ত মাইয়্যেতের জন্য জানাযার নামায চার তাকবীরের সাথে আদায় করতেছি, আল্লাহু আকবার।

বি. দ্র. মুর্দার স্ত্রীলোক হলে লি- হাযাল মাইয়্যিত এর স্থলে লি- হাযিহিল মাইয়্যিত বলতে হবে।

জানাযার নামায পড়ার নিয়ম

১. উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে নিচু আওয়াজে আল্লাহু আকবার বলবে।

২. তাকবীরের পর ইমাম ও মুক্তাদি উভয়ে নিচু আওয়াজে এই সানা পড়বে। سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاؤُكَ وَلَا إِلَهَ

৩. সানা পড়ার পর ইমাম সাহেব উচ্চ আওয়াজে আর মুক্তাদীগণ নিচু আওয়াজে হাত না উঠিয়ে বরং হাত বাঁধা রেখেই দ্বিতীয় বার আল্লাহু আকবার বলবে। তারপর নামাযের দুরুদ শরীফ পড়বে। (আল বাহরুর রায়েক : ২/১৮৩)

দরুদ শরীফ নিম্নরুপ-

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى الِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيْدٌ اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيْدٌ – (بخاری ۱ ، ۷۷)

৪. দুরুদ শরীফ পড়ার পর ইমাম উচ্চ আওয়াজে আর মুক্তাদী নিচু আওয়াযে তৃতীয় তাকবীর বলবে। কিন্তু হাত উঠাবে না। তারপর মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আ করবে।

৫. যদি মাইয়্যেত বালেগ পুরুষ বা মহিলা হয়, তাহলে এই দোয়া পড়বে,

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَتِنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّافَاَحْيِهِ عَلَى الْإِسْلَامِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى

৬. যদি মৃত ব্যক্তি নাবালেগ বা পাগল হয়, তাহলে এই দু’আ পড়বে। اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرَطَا وَّ اجْعَلْهُ لَنَا أَجْرَاوَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَّ مُشَفْعًا –

৭. মৃত ব্যক্তি যদি নাবালেগা বা জন্মগত পাগলী হয়, তাহলে এই দু’আ পড়বে। اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرَطاوُاجْعَلْهَا لَنَا اَجْرًا وذُخْرًا وَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَمُشَفْعَةً

৮. দু’আ পড়া শেষ হলে ইমাম উচ্চ আওয়াজে আর মুক্তাদিগণ নিচ আওয়াজে চতুর্থ তাকবীর বলবে। কিন্তু হাত উঠাবেনা। এরপর will as the tall বলে প্রথমে ডান দিকে পরে বাম দিকে সালাম ফিরাবে।

৯. কারো জানাযার দু’আ মুখস্থ না থাকলে শুধু agai alia 115 পড়ে নেবে।

কারো যদি দু’আও মুখস্থ না থাকে, শুধু চারবার আল্লাহু আকবার বললেও জানাযার নামায হয়ে যাবে । কারণ দু’আও দুরুদ শরীফ ফরয নয় বরং সুন্নাত। কিন্তু এসব লোক দু’আ মুখস্থ করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। যাতে নামায সুন্নাত মোতাবিক আদায় করতে পারে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৬৪)

জানাযার নামাযে কেরাত পড়া

১. যদি কোন ব্যক্তি জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহাকে কেরাতের নিয়তে পড়ে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। কেননা, জানাযার নামাযে কুরআন তিলাওয়াত শরীয়তে প্রমানিত নেই। অবশ্য সানার স্থলে সানা এবং হামদ হিসেবে সূরা ফাতিহা পড়লে কোন অসুবিধা নেই। (কাযিখান : ১/১৯৩)

২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হযরত ইমাম নাখয়ী, মুহাম্মাদ বিন সিরীন, আবুল আলিয়া, ফুযালা বিন উবাইদ, আবূ বুরদাহ, আতা, তাউস, মায়মুন, বকর বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা জানাযার নামাযে কেরাত পড়তেন না। (উমদাতুল কারী : ৮/১৩৯)

৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত : إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يُوَقِّتْ فِيْهَا قَوْلًا وَلَا قِرَاءَةً –

অনুবাদ : নিশ্চয় রাসূলে কারীম সা. জানাযার নামাযে কোন নির্দিষ্ট দু’আ এবং কেরাত নির্ধারণ করেননি। (উমদাতুল কারী : ৮/১৩৯) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. জানাযার নামাযে কেরাত পড়তেন না । (মুয়াত্তা মালেক : ২১০)

৫. জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া কোন সহীহ বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত নেই।

৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর রেওয়ায়েতে আছে, আমি জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা এজন্য পড়েছি যে, যাতে তোমরা জানতে পার যে, এটাও সুন্নাত। এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা হলো, হযরত উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আলী, আবু হুরাইরা রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়াকে অস্বীকার করতেন। আর তাবেয়ীদের মধ্যে হযরত আতা, তাউস, সাঈদ ইবনুল মাসাইয়্যিব, ইবনে সীরিন, সাঈদ ইবনে যুবায়ের, শা’বী, মুজাহিদ রহ. তাদের ছাড়া হাম্মাদ, সুফিয়ান সাওরী রহ. ও অস্বীকার করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর উক্তির ব্যাখ্যা হলো, তিনি সূরা ফাতিহাকে শুধু সানা হিসেবে পড়তেন। এতে কোন অসুবিধা নেই। উলামায়ে আহনাফ এর উপর আমল করতেন। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৭৪)

জানাযার নামাযে হাত কখন ছাড়বে?

জানাযার নামাযে সালাম ফেরানোর সময় কখন হাত ছাড়বে, এ সম্পর্কে তিনটি উক্তি রয়েছে।

১. চতুর্থ তাকবীর বলে সালাম ফেরানোর আগে উভয় হাত ছেড়ে দিবে। এরপর উভয় দিকে সালাম ফেরাবে। (সিআয়া : ২/১৫৯)

২. চতুর্থ তাকবীর বলে উভয় দিকে সালাম ফেরানোর পর উভয় হাত ছেড়ে দিবে। (হেদায়া : ১/১০২)

৩. চতুর্থ তাকবীর বলে ডান দিকে সালাম ফিরিয়ে ডান হাত ছেড়ে দেবে, বাম দিকে সালাম ফিরিয়ে বাম হাত ছেড়ে দেবে। উক্ত মতগুলোর মাঝে দ্বিতীয় মতানুসারে আকাবিরদের আমল এবং দারুল উলূম দেওবন্দ ও বিন্নুরী টাউন এর ফতোয়া রয়েছে। কেননা সালাম আল্লাহ তাআলার নাম হওয়ার কারণে সুন্নাত। যিকিরের অন্তর্ভূক্ত, আর সুন্নাত যিকিরের মধ্যে হাত বেঁধে রাখা উচিত । (ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ৫/২১৮)

জানাযার নামাযের পর দোয়া

জানাযার নামাযে সালাম ফেরানোর পরই সেখানে দাঁড়িয়ে একাকী বা সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে দোয়া করা কুরআন, হাদীস, সাহাবা, তাবেয়ী তাবে- তাবেয়ী এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীন থেকে প্রমাণিত নেই। ফুকাহায়ে কেরাম একে বিদআত এবং মাকরুহ বলেছেন। কারণ জানাযার নামায নিজেই দোয়া। অবশ্য সুন্নাত পদ্ধতি হলো, মাইয়্যেতকে দাফন করার পর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একাকী বা সম্মিলিতভাবে দোয়া করা। (মুসলিম শরীফ : ১/৩১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৮০)

জানাযার নামায একাধিকবার পড়া

অভিভাবক নিজে জানাযার নামায পড়ালে বা তার অনুমতিক্রমে একবার জানাযার নামায পড়ানো হলে, দ্বিতীয়বার জানাযার নামায পড়া মাকরুহ; বরং অন্যদের দ্বিতীয়বার জানাযার নামায পড়ার অধিকার নেই। তবে অভিভাবক যদি জানাযার নামায না পড়ে থাকে বা অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে জানাযার নামায না পড়ানো হয়, তাহলে অভিভাবক দ্বিতীয়বার জানাযার নামায পড়তে পারবে। (ফাতাওয়া শামী : ২/২২৩)

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *