সমিতি ও কোম্পানির উপর যাকাত প্রসঙ্গ।
সমিতি ও কোম্পানির উপর বিভিন্ন কারণে যাকাত ফরয হবে না। যার সারসংক্ষেপ নিম্নে তুলে ধরা হলো । ১. যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নেসাবের মালিক হওয়া আবশ্যক । অথচ সমিতি ও কোম্পানিতে বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য থাকে । কারো অংশ বেশি থাকে কারো কম। তাই অনেক সদস্য এমনও থাকে যে, নেসাব পরিমাণ মালের মালিকই নয়। এমতাবস্থায় সমিতি সবার মালের গড়ে যাকাত আদায় করলে এমন ব্যক্তির মাল থেকেও যাকাত আদায় করা হবে যার উপর যাকাত ফরয হয়নি। এ পর্যায়ে তার সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করলে পূর্বোল্লিখিত মূলনীতির পরিপন্থী হবে। এছাড়া নেসাব নির্ধারণ করার মূল হিকমতও অবশিষ্ট থাকে না। যাকাতের নেসাব নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অন্যের মালের সাথে নিজের মালের সংমিশ্রণ কোনো প্রভাব ফেলবে না। ইমাম তাহাবী রাহ. এ প্রসঙ্গে বলেন-“গবাদি পশুর দুই অংশীদার ভিন্ন দু’জনের ন্যায়। এখানে প্রত্যেকের সম্পদ আলাদাভাবে হিসাব করা হবে । যাকাতের নেসাবের ক্ষেত্রে অংশীদারির কোনো গ্রহণ যোগ্যতা নেই।(শরহু মুখতাসারুত তাহাবী: ২/২৫১,মাকতাবাকারীমিয়া,কোয়েটা,পাকিস্তান। ফাতাওয়ায়ে শামীতে আছে- আল্লামা হাসকাফী রাহ. বলেন, আমাদের হানাফী মাযহাবে যাকাতযোগ্য পশু ও ব্যবসার মাল যদি সম্মিলিতভাবে নেসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার উপর যাকাত আবশ্যক নয় । আল্লামা শামী রাহ. বলেন, সম্মিলিত নেসাব বলতে বুঝায় যা এক অংশীদারের অংশ অপরের অংশের সাথে মিলানোর কারণে নেসাবের গণ্ডিতে গিয়ে পৌঁছেছে, পক্ষান্তরে যদি এই সম্পদ পৃথক করা হয়, তাহলে কোনোটিই নেসাবের আওতায় আসে না।(আদ্দুররুল মুখতার:৩/২৩৫,মাকতাবায়ে যাকারিয়া,দেওবন্দ
মালেকী মাযহাবের ইমাম ইবনে রুশদ রাহ. এ প্রসঙ্গে বলেন-“ইমাম মালেক ও আবু হানীফা রাহ. এর মতে যৌথ সম্পদে প্রত্যেক শরীক ভিন্ন ভিন্নভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে যাকাত আবশ্যক হবে না। আর শাফে‘য়ী রাহ. এর নিকট যৌথ সম্পদের হুকুম এক ব্যক্তির সম্পদের ন্যায় (অর্থাৎ যৌথ সম্পদ নেসাব পরিমাণ হলে যাকাত আবশ্যক হবে) । তাদের ইখতিলাফের মূল ভিত্তি হলো রাসূল এর এ সর্ববাদী বাণী, ‘স্বর্ণের পরিমাণ পাঁচ উকিয়ার কম হলে সদকা নেই ।’ উক্ত বাণী থেকে নির্গত হুকুমটি তথা নেসাবের নির্ধারিত পরিমাণটি যেমন এক মালিকের সম্পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, একাধিক মালিকের সম্পদেও হতে পারে। তবে নেসাব শর্ত করার ভিত্তি যেহেতু দয়া ও অনুগ্রহের উপর, তাই উল্লিখিত হাদীসে যাকাতের নির্ধারিত পরিমাণ এক মালিকের জন্য হওয়াই অধিক স্পষ্ট ও যুক্তিযুক্ত। আর শাফে‘য়ী রাহ. যৌথ সম্পদকে ‘খুলতা’ অর্থাৎ মিশ্রিত সম্পদের সাথে তুলনা করেছেন। অথচ যাকাতের ক্ষেত্রে খুলতার প্রভাব একটি মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়। (বিদায়াতুল মুজতাহিদ: ১/২০৬, দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন)
২. যাকাত ফরয হওয়া না হওয়া ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত, যৌথ সমিতি বা কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত নয়। কারণ যাকাত একটি ইবাদত যা ফরয হওয়ার জন্য মুকাল্লাফ (অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আদেশ নিষেধ পালনে আদিষ্ট ব্যক্তি) হওয়া শর্ত । যা একজন ব্যক্তির মাঝেই পাওয়া সম্ভব। কোনো সমিতি বা কোম্পানি মুকাল্লাফ নয়। তাই তার উপর যাকাত ফরয হবে না।
৩. যাকাত ফরয হতে হলে মালের মালিক হতে হয় আর সমিতি বা কোম্পানি মালের মালিক নয়। বরং সমিতির সকল সম্পদের প্রকৃত মালিক সদস্যগণ, তাই যাকাত ফরয হলে সদস্যদের উপর হবে, সমিতির উপর নয়।
সমিতির সদস্যদের উপর যাকাত। সমিতি বা কোম্পানির সমষ্টির উপর যাকাত ফরয না হলেও কোনো সদস্যের যদি সমিতি বা কোম্পানিতে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে কিংবা সমিতি বা কোম্পানিতে জমাকৃত মালকে তার অন্যান্য সম্পদের সাথে হিসাব করলে নেসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। তবে যাকাতের ক্ষেত্রে কোম্পানিতে জমাকৃত সম্পদের হিসাব অন্য যে কোনো ব্যবসায়িক সম্পদের মতই হবে। অর্থাৎ সমিতি ও কোম্পানি পরিচালনার জন্য যে সকল আসবাবপত্র প্রয়োজন হয়। যেমন কম্পিউটার, মেশিন, চেয়ার টেবিল ইত্যাদি এগুলো নেসাবের হিসাবে আসবে না। কারণ ব্যবসার মাধ্যম ও যন্ত্রপাতি যাকাতের মালের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইমাম আলী আল-মারগীনানী রাহ. বলেন- “বসবাসের বাড়িতে, পরিধেয় বস্ত্রে, গৃহসামগ্রী এবং কর্মজীবীর কাজের মাধ্যম ও যন্ত্রপাতিতে কোনো যাকাত নেই ।(হেদায়া: ১/১৮৬, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া, দেওবন্দ)
উক্ত সদস্য অংশীদার হওয়ার তারিখে যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় এবং এক বছর পূর্তিতে নেসাব ঠিক থাকে, তাহলে যাকাত আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে নেসাব হিসাব করার সময় বছরের মাঝের লভ্যাংশগুলো মূল সম্পদের সাথে হিসাব হবে। ফাতাওয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে- “যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ আছে, বছরের মাঝামাঝি সময়ে যদি তার কাছে থাকা সম্পদের অনুরূপ আরো কিছু সম্পদ তার হস্তগত হয়, তাহলে এই সম্পদকে মূল নেসাবের সাথে মিলিয়ে যাকাত আদায় করতে হবে। বর্তমানে প্রাপ্ত সম্পদ তার মূল সম্পদলব্ধ হোক বা ভিন্নভাবে অর্জিত হোক এবং এই সম্পদ যে কোনো প্রক্রিয়ায় তার হস্তগত হোক না কেন (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী: ১/১৭৫,মাকতাবায়ে রশীদীয়া,কোয়েটা)
কোম্পানিগুলোতে রিজার্ভ ফান্ড নামে একটা বিশেষ ফান্ড থাকে। কোনো সময় যদি কোম্পানির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তাহলে যেন সেখান থেকে পূরণ করা যায়। সেখানে প্রত্যেক সদস্যের একটা অংশ থাকে। কিন্তু কেউ ফান্ড থেকে নিজের অংশ নিতে পারে না এবং কোনো হস্তক্ষেপও করতে পারে না। মূলকথা হলো, এ ফান্ড সম্পূর্ণরূপে কোম্পানির কাছে রক্ষিত থাকে এবং সদস্যের প্রভাবমুক্ত থাকে । যাকাতের হিসাবের সময় এ ফান্ডের টাকার হিসাব করতে হবে। কারণ তার হস্তক্ষেপ করার অধিকার না থাকলেও সদস্যগণ যেহেতু স্বেচ্ছায় এ শর্ত গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তীতে এ ধরনের শর্তের মাঝে রদবদল করাও সম্ভব। এ ছাড়াও কোম্পানি ভেঙ্গে গেলে ঐ ফান্ডসহ হিসাব করে সদস্যদের মূলধন বুঝিয়ে দেয়া হবে এবং প্রত্যেক সদস্যের অংশের বাজারমূল্য নির্ধারণের সময় ঐ ফান্ডের জমা টাকাও হিসাবে আসে তাই যাকাত আদায় করার সময় ঐ ফান্ডের টাকাও নেসাবের অর্ন্তভুক্ত হবে।
তথ্যসূত্রঃ
দরসূল ফিকহ,(হাটহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত।