সালাতুল ফজরের সাথে নির্দিষ্ট সুন্নাত
১। ফজরের নামাযের সুন্নাত ক্বিরাত
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ، أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، كَانَ يَقْرَأُ فِي رَكْعَتَى الْفَجْرِ فِي الْأُولَى مِنْهُمَا: { قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا} [البقرة: m] الْآيَةَ الَّتِي فِي الْبَقَرَةِ، وَفِي الْآخِرَةِ مِنْهُمَا: {آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدُ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ} [آل عمران:٥٢]
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ফজরের দু’রাকা’আতের প্রথম রাকাআতে সূরা আল বাক্কারার ১৩৬নং আয়াত এবং দ্বিতীয় রাকা’আতে আলে ইমরানের ৫২নং আয়াত তিলাওয়াত করতেন। (মুসলিম, হাদীস নং: ৭২৭।)
প্রথম রাকাআতে قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِي مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِي النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ .
“তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ্র উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক ইয়াকুব এবং তাঁর বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমুদয়ের উপর। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী। আল কুর’আন: সূরা বাক্বারা ২:১৩৬।
দ্বিতীয় রাকা’আতে: فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدُ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ.
“অতঃপর ঈসা আ. যখন বনি ইসরাইলের কুফরী সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারলেন, তখন বললেন, কারা আছে আল্লাহ্র পথে আমাকে সাহায্য করবে? সঙ্গী-সাথীরা বললো, আমরা রয়েছি আল্লাহ্র পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহ্ প্রতি ঈমান এনেছি। আর তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা হুকুম কবুল করে নিয়েছি। (আল কুর’আন: সূরা আলে ইমরান ৩:৫২)
অথবা, আলে ইমরানের ৬৪নং আয়াত তিলাওয়াত করা । قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِن دُونِ اللَّهِ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ.
“বলুন! (হে রাসূলুল্লাহ সা.) হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান-যে, আমরা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করব না, তাঁর সাথে কোনো শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তাউপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, তোমরা সাক্ষী থাকো আমরা তো অনুগত। (আল কুর’আন: সূরা আলে ইমরান ৩:৬৪)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، ” أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرَأَ فِي رَكْعَتَي الْفَجْرِ : قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ، وَقُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ
“হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ফজরের দু’রাকা’আতের নামাযে সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করতেন।মুসলিম, হাদীস নং: ৭২৬।
প্রথম রাকা’আতে সূরা কা-ফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকা’আতে সূরা ইখলাস পাঠ করা।
২। ফজরের নামাযের কির’আত দীর্ঘ করা সুন্নাত
ফজরের দুরাকা‘আত ফরজ সালাতে কির’আত ৬০ হতে ১০০ আয়াত পর্যন্ত লম্বা করা সুন্নাত।
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে, قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ، يَقُولُ: «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُؤَخِّرُ الْعِشَاءَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ، وَيَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَهَا، وَالْحَدِيثَ بَعْدَهَا، وَكَانَ يَقْرَأُ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ مِنَ الْمِائَةِ إِلَى السِّيِّينَ، وَكَانَ يَنْصَرِفُ حِينَ يَعْرِفُ بَعْضُنَا وَجْهَ بَعْضٍ.
“(রাবী সায়য়ার হতে বর্ণিত) তিনি বলেন, আমি আবু বারঝা আল আসলামীকে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সা. ফজরের নামাজে ৬০ হতে ১০০ আয়াত পর্যন্ত পড়তেন। এবং এমন সময় সালাত শেষ করতেন যখন আমরা পরস্পরকে মুখ দেখে চিনতে পারতাম। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৪৭ ।
৩। ফরযের পূর্বে দু’রাকা’আত সংক্ষিপ্তভাবে সালাত আদায় করা সুন্নাত
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে أَنَّ حَفْصَةَ أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ ، أَخْبَرَتْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ إِذَا سَكَتَ الْمُؤَذِّنُ مِنَ الْأَذَانِ لِصَلَاةِ الصُّبْحِ، وَبَدَا الصُّبْحُ، رَكَعَ رَكْعَتَيْنِ خَفِيفَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ تُقَامَ الصَّلَاةُ.
“উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন মুয়াযযিন ফজরের আযান দিতো এবং সকাল হওয়া আরম্ভ হতো তখন নবী করীম সা. ফজরের আযান এবং ইকামতের মধ্যে সংক্ষিপ্ত দু’রাকা’আত সালাত আদায় করতেন। (আল বুখারী, হাদীস নং: ১৬৯, এবং মু সলিম, হাদীস নং: ৭২৩)
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. এর অন্য হাদীস- عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: «كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي رَكْعَتَى الْفَجْرِ إِذَا سَمِعَ الْأَذَانَ، وَيُخَفِّفُهُما.
“হযরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. যখন ফজরের আযান শুনতেন তখন দু’রাকা’আত সালাত পড়তেন এবং তা সংক্ষেপ করতেন। সহীহ মুসলিম শরীফ, প্রাগুক্ত ।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. এর অন্য হাদীস- عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ : ” كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا طَلَعَ الْفَجْرُ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ ، أَقُولُ: هَلْ يَقْرَأُ فِيهِمَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ؟
“হযরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ফজরের সুন্নাতকে তিনি এত সংক্ষেপ করতেন যে, আমি বলতাম তিনি কী এতে সূরা ফাতেহা পড়েছেন?’ সহীহ মুসলিম শরীফ, প্রাগুক্ত ।
৪। সুন্নাত সালাতের পর ডান কাতে শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া সুন্নাত
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ عَائِشَةَ رضى اللهُ عَنْهَا، قَالَتْ : كَانَ النَّبِي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا صَلَّى رَكْعَتَيِ الفَجْرِ اضْطَجَعَ عَلَى شِقِّهِ الأَيْمَنِ.
“হযরত আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সা. ফজরের দু’রাকআত (সুন্নাত) নামায পড়ার পর ডান কাতে “গা-গড়াগড়ি” দিতেন। আল বুখারী, হাদীস নং: ১১৬০ ৷
৫। ফজরের দু’রাকাআত নামাযকে রাসূল সা. খুব গুরুত্ব দিতেন
ফজরের দু’রাকা’আত নামাযকে রাসূল সা. খুব গুরুত্ব দিতেন এবং তা কখনো ত্যাগ করতেন না । এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ عَائِشَةَ رضى اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: لَمْ يَكُنِ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى شَيْءٍ مِنَ النَّوَافِلِ أَشَدَّ مِنْهُ تَعَاهُدًا عَلَى رَكْعَتَيِ الفَجْرِ .
হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ফজরের দু’রাকা’আত সালাত কঠোরভাবে আদায় করার মত অন্য কোন অতিরিক্ত (সুন্নত সালাত) অধিক কঠোরতা অবলম্বন করেননি ৷”সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১১৬৯ ৷
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: رَكْعَتَانِ لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَعُهُمَا سِرًّا وَلاَ عَلانِيَةً : رَكْعَتَانِ قَبْلَ صَلاةِ الصُّبْحِ.
“হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) গোপনে ও প্রকাশ্যে কখনই ফজরের দু’রাকা’আত সুন্নাতকে ছেড়ে দেননি ।”সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৫৯২।
৬। ফজরের দু’রাকা’আত সুন্নাত সালাত দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় কাজ
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ عَائِشَةَ، عَنِ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ فِي شَأْنٍ الرَّكْعَتَيْنِ عِندَ طُلُوعِ الْفَجْرِ : لَهُمَا أَحَبُّ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا جَمِيعًا.
“হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সা. ফজরের দু’রাকাআত সুন্নাতের ব্যাপারে বলেন, এ দু’রাকা’আত সালাত আমার নিকট সমস্ত দুনিয়ার চেয়েও উত্তম। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৭২৫।
عَنْ عَائِشَةَ، عَنِ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ: رَكْعَتَا الْفَجْرِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا.
“হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: ফজরের দু’রাকা’আত সুন্নাত সালাত দুনিয়া ও এতে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম ৷” সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৭২৫।
রাসূলুল্লাহ সা. এর সাধারণ অভ্যাস ছিল তিনি বাড়িতে ফজরের সুন্নাত আদায় করতেন। ফজরের দু’রাকা’আত সুন্নাত পড়ার পর কিছু সময়ের জন্য ডান কাতে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করা, এতটুকু সময় যতটুকু সময়ে দু’রাকা’আত নামায পড়া যায় ।
৭। ফজরের সালাতের পরে বসা
ফজর সালাতের পর বসা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ : أَنَّ النَّبِي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا صَلَّى الْفَجْرَ جَلَسَ فِي مُصَلَاهُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ حَسَناً. “হযরত জাবির বিন সামুরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী করীম সা. ফজরের সালাত আদায় করতেন, তিনি ঐ স্থানে বসে থাকতেন যতক্ষণ না সূর্য ভালোভাবে উদিত হয় । সহীহ মুসলিম, নং:৬৭০
তথ্যসূত্র :
বই: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ১০০০ সুন্নাত
লেখক: শাইখ খালীল আল হোসেনান
অনুবাদক: মাওলানা ডক্টর শাহ্ মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম